প্রকাশিত:শনিবার, ২৮ নভে ২০২০ ০২:১১
বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব আলী যাকের আর নেই। শুক্রবার ভোর ৬টা ৪০ মিনিটে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে শ্রদ্ধা নিবেদন এবং জানাজা শেষে তার মরদেহ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। তার বয়স হয়েছিল ৭৬ বছর। তিনি স্ত্রী অভিনেত্রী সারা যাকের, ছেলে অভিনেতা ইরেশ যাকের ও মেয়ে শ্রিয়া সর্বজয়াকে রেখে গেছেন।
মঞ্চ, ছোট পর্দা কিংবা বড় পর্দা সব জায়গায় বরেণ্য শিল্পী আলী যাকের আলো ছড়িয়েছেন। নাট্যজন হিসেবে ভিন্নমাত্রার অভিনয় দিয়ে পৌঁছে গেছেন মানুষের হৃদয়ে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে শব্দসৈনিক হিসেবে তিনি জাগরণের কথা বলেছেন। এ দেশের আমজনতার প্রিয় অভিনেতা আলী যাকের প্রায় চার বছর ধরে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার করোনাভাইরাস পজিটিভ ধরা পড়ে। গত সপ্তাহে শারীরিক সমস্যা অনেক বেড়ে যাওয়ায় জরুরি ভিত্তিতে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। চিকিৎসকদের পরামর্শে তাকে সিসিইউতে নেয়া হয়। সেখানে তিনি কিছুটা সুস্থ হলে শনিবার বাসায় নেয়া হয়। রোববার আবার তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সোমবার তার কোভিড-১৯ পজিটিভ ধরা পড়ে।
আলী যাকেরের ছেলে অভিনেতা ইরেশ যাকের জানান, মৃত্যুর দুই দিন আগে তার বাবার করোনা শনাক্ত হয়। সঙ্গত কারণে শহীদ মিনারে শেষ শ্রদ্ধার আয়োজন করা হয়নি। শুক্রবার আসরের নামাজের পর বনানী কবরস্থানের মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়। এরপর বনানী কবরস্থানে তার মরদেহ দাফন করা হয়।
দেশবরেণ্য অভিনেতা আলী যাকেরের মৃত্যুতে গভীর শোক জানিয়েছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। শোকবার্তায় রাষ্ট্রপতি বলেন, বরেণ্য অভিনেতা আলী যাকের ছিলেন দেশের সাংস্কৃতিক অঙ্গনে এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। তার মৃত্যুতে দেশ একজন বরেণ্য অভিনেতা ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বকে হারাল। অপর এক শোকবার্তায় প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, দেশের শিল্পকলা ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনে আলী যাকেরের অবদান স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার আত্মার মাগফিরাত কামনা করে প্রধানমন্ত্রী শোকসন্তপ্ত পরিবারের সদস্যদের প্রতি গভীর সমবেদনা জানান।
শোক প্রকাশ করেছেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, তথ্যমন্ত্রী হাছান মাহমুদ, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, শিল্পমন্ত্রী নূরুল মজিদ মাহমুদ হুমায়ুন, কৃষিমন্ত্রী মো. আবদুর রাজ্জাক, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ, নারী ও শিশুবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী ফজিলাতুননেসা ইন্দিরা। শোক জানিয়েছেন বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ, বিরোধীদলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদের। শোক জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। শোক জানিয়েছেন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রফেসর ড. হারুন-অর-রশিদ, পুলিশের মহাপরিদর্শক ড. বেনজীর আহমেদ বিপিএম (বার) প্রমুখ। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, স্বাধীনতা সাংস্কৃতিক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটি, প্রেজেন্টার্স অব বাংলাদেশ শোক জানিয়েছে।
প্রিয় অভিনেতা আলী যাকেরকে শ্রদ্ধা জানাতে বেলা ১১টায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে মানুষজন উপস্থিত হন। তাদের শ্রদ্ধা-ভালোবাসায় শেষ বিদায়ে সিক্ত হন আলী যাকের। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি আলী যাকেরের প্রতি ঘণ্টাব্যাপী শ্রদ্ধা নিবেদন করেন তার বন্ধু-সুহৃদ-স্বজন এবং শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা। শ্রদ্ধা নিবেদন অনুষ্ঠানের শুরুতে ঢাকা জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে গার্ড অব অনার দেয়া হয়। এরপর তার মরদেহে একে একে শ্রদ্ধা জানান সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বিশিষ্টজনরা।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব রামেন্দু মজুমদার, ফেরদৌসী মজুমদার, নাট্যজন মামুনুর রশীদ, সাবেক সংস্কৃতিমন্ত্রী নাট্যজন আসাদুজ্জামান নূর, নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী, মফিদুল হক প্রমুখ। আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক অসীম কুমার উকিল ও প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ সহকারী ব্যারিস্টার বিপ্লব বড়ুয়া আওয়ামী লীগের পক্ষে আলী যাকেরের মরদেহে ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।
আলী যাকের সম্পর্কে তার স্ত্রী নাট্যজন সারা যাকের বলেন, আমার দীর্ঘদিনের সহযাত্রী ছিলেন, সহকর্মী ছিলেন, বন্ধু ছিলেন। বাসা থেকে শেষ যখন তাকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় তখন সে আমাকে খুঁজছিল। তার অসুস্থতায় অনেক মানুষ পাশে ছিলেন, কিন্তু আমি বুঝতে পারিনি আমার ওপর তিনি কতটা নির্ভরশীল! এ নির্ভরশীলতা আমাকে অনেক দায়িত্ব দিয়ে গেল, যা এখন পূরণের পালা। তিনি বলেন, আলী যাকেরের শেষ ইচ্ছা ছিল ‘গ্যালিলিও’ নাটক করার। সেটা সম্ভব হয়েছে। তার শেষ ইচ্ছা পূর্ণ হয়েছে।
রামেন্দু মজুমদার বলেন, ২০২০ সাল হচ্ছে আমাদের প্রিয়জন হারানোর বছর। আমরাও হয়তো হারিয়ে যাব। আমাদের মঞ্চ নাটকের একটা বড় স্তম্ভের পতন হল। আলী যাকেরের মতো এত বড় মাপের অভিনেতা আমরা আর পাব না। ‘গ্যালিলিও’, ‘নূরলদিনের সারাজীবন’ তাকে ছাড়া কল্পনা করা যায় না। আমরা ‘প্রেমপত্র’ নামে একটি নাটক আলী যাকের ও ফেরদৌসী মজুমদারকে নিয়ে করার পরিকল্পনা করেছিলাম। দুই বছর ধরে তার জন্য প্রতীক্ষা করছিলাম। কিন্তু সেটা সম্ভব হল না। তিনি আরও বলেন, আলী যাকের পরিপূর্ণ জীবনযাপন করেছেন। পেশাগত জীবনে তিনি শীর্ষস্থানে পৌঁছেছেন। নাটকের দলের সংগঠক হিসেবেও চূড়ান্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পেরেছিলেন।
ফেরদৌসী মজুমদার বলেন, আমরা কি হারিয়েছি, তা ধীরে ধীরে টের পাব। তিনি আমার বন্ধু ছিলেন, সহ-অভিনেতা ছিলেন, সহমর্মী ছিলেন, সহযোগী ছিলেন। তিনি আমাকে খুব পছন্দ করতেন, সম্মান করতেন। যে মানুষকে আমরা হারিয়েছি হয়তো সময়ের কালে আমরা তাকে ভুলে যাব। কিন্তু তার কথা, কাজ, অভিনয় ভুলব না। তিনি আজ নেই, এটাই আমাদের কাছে চরম সত্য।
মামুনুর রশীদ বলেন, দুই বাংলার নাটকের একটি স্তম্ভের মৃত্যু হয়েছে। বাংলা নাটক যারা বুঝতে পারতেন, তিনি তাদেরই একজন ছিলেন। বাংলাদেশের নাটকের যে উত্থান হয়েছিল তার পেছনে আলী যাকেরের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। মঞ্চে তিনি বিরাট প্রভাব সৃষ্টি করে রাখতে পারতেন। বিশেষ করে নূরলদিনে তার অভিনয় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলা মঞ্চ নাটকের ইতিহাসে।
আসাদুজ্জামান নূর বলেন, আমাদের সম্পর্কটা দীর্ঘ ৫০ বছরের। আমার নাটক, আমার ক্যারিয়ার সবকিছু তার হাতে গড়ে তোলা। একসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা স্মরণ করে তিনি বলেন, ‘প্রথমে রবিউল হুসাইন, এরপর জিয়াউদ্দিন তারিক আলী, আজ ছটলু ভাই। গত এক বছরে এ জাদুঘরের তিন ট্রাস্টিকে হারিয়ে ফেললাম আমরা। এটা আমাদের জন্য বড় বেদনার।’
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি ডা. সারওয়ার আলী বলেন, প্রিয়জনকে মূল্যায়ন করা যায় না। নিকটজন সম্পর্কে বলা কঠিন। আলী যাকের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও আদর্শকে ধারণ করতেন। বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা করতেন। আমরা যখন মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের কাজ শুরু করি, তখন আলী যাকের প্রস্তাব দিলেন আমাদের যে কোনো ব্যক্তির অবদান ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ পর্যন্ত রাখব। এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে আমরা অনেক বিতর্কের বাইরে থাকতে পেরেছি। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তার স্বতন্ত্র অবস্থান বজায় রাখতে পেরেছে। তিনি বলেন, বহু গুণে গুণান্বিত ছিলেন আলী যাকের। তার সম্পর্কে সাধারণ মানুষ অনেক কিছুই জানে। তবে তার বেশ কিছু না জানার মধ্যে একটি হল- তিনি মুক্তিযুদ্ধের আগে ইংরেজিতে ক্রিকেট খেলার ধারাবিবরণী দিতেন।
নাট্যজন নাসির উদ্দীন ইউসুফ বলেন, বাংলা মঞ্চে আলী যাকেরের চরিত্রের শেষ নেই। ‘গ্যালিলিও’, ‘দেওয়ান গাজীর কিস্সা’, ‘নূরলদিনের সারাজীবন’ নাটকে নামভূমিকায় তার ধ্রুপদী উদাহরণ। চরিত্রকে তিনি উচ্চমার্গীয় পর্যায়ে নিয়ে গেছেন।
মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে আলী যাকেরের মরদেহ বনানীতে তার কর্মস্থল এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি ডিগ্রির কার্যালয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব মো. ফাহিমুল ইসলাম। এরপর এশিয়াটিক থেকে আলী যাকেরের মরদেহ বনানী কবরস্থানে নেয়া হয়। বিকাল পৌনে ৫টায় জানাজা শেষে সেখানেই তার মরদেহ দাফন করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার রতনপুর গ্রামে ১৯৪৪ সালে আলী যাকের জন্মগ্রহণ করেন। চার ভাইবোনের মধ্যে তিনি ছিলেন তৃতীয়। তার বাবা মোহাম্মদ তাহের ছিলেন উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা। বাবার চাকরির বদলি সূত্রে অল্প বয়সে কুষ্টিয়া ও মাদারীপুরে কাটান আলী যাকের। ১৯৭২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মুনীর চৌধুরীর ‘কবর’ নাটকে আলী যাকের প্রথম অভিনয় করেন। একই বছরের জুনে তিনি নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ে যোগ দেন। তখন থেকে নাগরিকই তার ঠিকানা।
‘সৎ মানুষের খোঁজে’, ‘বাকি ইতিহাস’, ‘দেওয়ান গাজীর কিসসা’, ‘কোপেনিকের ক্যাপটেন’, ‘গ্যালিলিও’, ‘ম্যাকবেথ’সহ অনেক আলোচিত মঞ্চ নাটকের অভিনেতা ও নির্দেশক তিনি। পাশাপাশি টেলিভিশন নাটকে অভিনয় করেও তিনি পেয়েছেন জনপ্রিয়তা। ‘আজ রবিবার’, ‘বহুব্রীহি’, ‘তথাপি’, ‘পাথর’, ‘দেয়াল’সহ বহু নাটকে অভিনয় করেছেন আলী যাকের। বেতারে ৫০টির বেশি নাটক করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন বেশকিছু চলচ্চিত্রে।
টেলিভিশনের জন্য মৌলিক নাটক লিখেছেন আলী যাকের। নানা বিষয়ে দৈনিক পত্রিকায় দীর্ঘদিন তিনি নিয়মিত লেখালেখি করেছেন। তার ‘সেই অরুণোদয় থেকে’, ‘নির্মল জ্যোতির জয়’ বই প্রকাশিত হয়েছে। শখ করে ফটোগ্রাফিও করেছেন তিনি।
আলী যাকের নাগরিক নাট্য সম্প্রদায়ের সভাপতি ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের অন্যতম ট্রাস্টি তিনি। যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ফটোগ্রাফিক সোসাইটির পূর্ণ সদস্য আলী যাকের একুশে পদক, বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদক, নরেন বিশ্বাস পদকসহ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। বিজ্ঞাপনী সংস্থা এশিয়াটিক থ্রিসিক্সটি গ্রুপের চেয়ারম্যান ছিলেন তিনি।
Head Office :
2152 – B, Westchester Ave,
Bronx, New York 10462
United States Of America.
Tel : 347 656 4623 (News), 718 823 7535 (Office), 929 261 8340 (CEO), 718 823 7538 (Fax).
Email :
report.banglanewsus@gmail.com (News),
riyahdahad@banglanewsus.com (Editorial)
info@banglanewsus.com (Advertisement)
ceo@banglanewsus.com (Event And Others).
First Fully Online Daily For The Worldwide
South Asian Community Jointly Published From
United States Of America, Great Britain
And Canada On Be-Half Of
POSITIVE INTERNATIONAL INC
@ 2014-2020
Developed BY : positiveitusa.com
Design and developed by positiveitusa.com