আটোয়ারী (পঞ্চগড়) :
হিমালয় কন্যা পঞ্চগড় জেলার পাঁচ উপজেলার মধ্যে পশ্চাৎপদ কৃষি প্রধান একটি উপজেলার নাম আটোয়ারী উপজেলা। ছয় ইউনিয়ন নিয়ে গঠিত এই উপজেলার প্রায় ৯০ ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কৃষি নির্ভর এই বিরাট অংশের মধ্যে সিংহভাগ কৃষকই মৌসুম ভেদে বানিজ্যিক ভাবে তরমুজ, আলু, বেগুন, কপি, লাউ, করলা, বেগুন, শশা, মরিচ, টমেটো ও জালী সহ রকমারী শাক-সবজী উৎপাদন করে এলাকার চাহিদা মিটিয়ে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে আর্থিকভাবে লাভবান হতো। কিন্ত চলমান পরিস্থিতিতে দেশে জেলায় জেলায় লকডাউন ঘোষিত হওয়ায় এবং করোনা সংক্রমণ রোধে কড়াকড়িতে চলতি মৌসুমে উৎপাদিত সবজি ও ফসল কোথাও সরবরাহ করতে পারছেন না কৃষকরা। এ অবস্থায় স্থানীয় বাজারে কিছু কিছু বাজারজাতের ব্যবস্থা থাকলেও নায্য মুল্য পাচ্ছেন না বলে দাবী কৃষকদের। ফলে তাদের উৎপাদিত সবজি ও ফসল পানির দামে বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন তারা। এতে একদিকে মহাজনের হালখাতা অপরদিকে বিভিন্ন সংস্থা থেকে নেয়া ঋনের বোঝা মাথায় নিয়ে চরম হতাশায় দিন কাটছেন তারা। গতকাল রোববার উপজেলার কলেজ মাঠে অস্থায়ী বাজারে সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কৃষকরা তাদের কষ্টার্জিত লাউ, বেগুন করলাসহ বিভিন্ন সবজি নাম মাত্র মূল্যে ফড়েয়াদের কাছে বিক্রি করছেন। বটতলী গ্রামের জনৈক বেগুন চাষী জহিরুল ইসলাম তার ক্ষেতের ২২ বস্তা বেগুন ৫শ টাকায়, বামনকুমার গ্রামের জনৈক মামুন তার ক্ষেতের উৎপাদিত লাউ প্রতি ৩ টাকা দরে বিক্রি করেন। তারা জানান, স্বাভাবিক পরিস্থিতি থাকলে বেগুন কেজি প্রতি ১০ থেকে ১২ টাকা আর লাউ ১৫ থেকে ২০ টাকা দরে বিক্রি করতে পারতেন। করোনা পরিস্থিতিতে যে দামে তারা সবজি বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন এতে তাদের শ্রমিকের খরচও পাচ্ছেন না।
প্রাণঘাতী করোনায় ইতিমধ্যে জেলায় প্রথম তেঁতুলিয়া উপজেলায় একজন করোনায় আক্রান্তের খবর পাওয়ায় তাৎক্ষনিকভাবে পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন গত শুক্রবার বিকেলে এক জরুরী সভা ডেকে পঞ্চগড় জেলাকে লকডাউন ঘোষনা করেন। এ অবস্থায় তরমুজ, আলু, লাউ, করলা, বেগুন, শশা, মরিচ, টমেটো ও জালী সহ পচনশীল রকমারী শাক-সবজী উৎপাদনকারী কৃষকরা হতাশায় ভুগছেন। তারা আশংকা করছেন, কোভিড -১৯ এর কারনে বুঝি তাদের বেঁচে থাকার স্বপ্ন বুঝি ভঙ্গ হতে বসল।
খোঁজ নিয়ে জানাগেছে, উপজেলার সবজি চাষীদের মধ্যে কেউ এনজিও’তে, কেউ সরকারীভাবে কৃষি ঋন নিয়ে, কেউ মহাজনদের কাছে উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে আবার কেউ কেউ গৃহস্থালী পন্য বিক্রি করে বুক ভরা সোনালী স্বপ্নের আশায় রাত-দিন হাড়-ভাঙ্গা পরিশ্রম করে বানিজ্যিক ভিত্তিতে আলু, বেগুন, করলা, লাউ, শশা ও টমেটোসহ সবজি চাষ করে।
এদের মধ্যে পাশ^বর্তী ঠাকুরগাও জেলার ঢোলার হাট ধর্মপুর এলাকার জনৈক সুন্দর চন্দ্র বর্মনের পুত্র বর্গাচাষী অশি^নী কুমার কাঁন্না জড়িত কণ্ঠে আমাদের প্রতিনিধিকে জানান, তিনি এই উপজেলার কলেজ মোড় এলাকায় প্রায় ১০ একর জমি ২ লক্ষ ৪০ হাজার টাকায় বর্গা নিয়ে আরো প্রায় ১০ লক্ষ টাকা খরচ করে করলা, লাউ, শশা, টমেটো, মরিচ ও পিয়াজের আবাদ করেছেন। কিন্ত তিনি এ পর্যন্ত স্থানীয় বাজারে নাম মাত্র মুল্যে প্রায় দেড় লক্ষ টাকার সবজি বিক্রয় করতে পেরেছেন। একই বেদনার কথা জানান মির্জাপুর পানবারা এলাকার কৃষক তোজাম্মেল হক। তিনি বলেন, প্রায় ১৫ একর জমিতে সবজি চাষে খরচ করেছেন প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা কিন্তু এখন পর্যন্ত বিক্রি করে পেয়েছেন মাত্র ৫০ হাজার টাকা। সুখাতি গ্রামের মোঃ দেলোয়ার, নলপুখুরী এলাকার রফিকুল ইসলাম, মনোজ রায় হিরু, মোঃ নাজির হোসেন সহ উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের প্রায় শতাধিক কৃষকের অবস্থা প্রায় একই। সবজি চাষীরা জানান, প্রতি বছর স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে তাদের উৎপাদিত সবজি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সরবরাহ করে তারা ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করে আর্থিকভাবে লাভবান হতো। কিন্তু এবার প্রাণঘাতী করোনার প্রভাবে তাদের সেই স্বপ্ন ভঙ্গের দ্বারপ্রান্তে। এ অবস্থায়, সবজী চাষীদের জন্য স্বল্প সুদে ঋন সহ পৃথক প্রণোদনার ব্যবস্থা করার দাবী তুলেছেন ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকরা।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা কৃিষ অফিসার মোঃ আবদুল্লাহ আল-মামুন বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনা অনুযায়ী উপজেলার প্রতি বর্গ ইঞ্চি জমিতে চাষা-বাদের ব্যবস্থা করতে কৃষি বিভাগ কৃষকদের উৎসাহিত করে আসছেন। ফলে চলতি মৌসুমে উপজেলায় প্রায় ৫শ ১০ হেক্টর জমিতে এবার সবজি চাষ হয়েছে। ফলনও বাম্পার হয়েছে। কিন্তু করোনা পরিস্থিতিতে কৃষক ভাইয়েরা উৎপাদিত সবজি ঠিকমতো বাজারজাত করতে পারছেন না।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।