ডেস্ক রিপোর্ট: ঢাকা: সিরিয়া ও ইরাকে গড়ে ওঠা জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট (আইএস)-কে তাদের শক্তিশালী অবস্থানগুলো থেকে উৎখাত করা হয়েছে। সিরীয় প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদবিরোধী বিদ্রোহীদের অবস্থান সীমিত হয়ে পড়েছে অল্প কিছু স্থানে। তারপরও সাত বছর আগে শুরু হওয়া সিরিয়ার গৃহযুদ্ধ আজও সমাপ্ত হয়নি। যদি নিকট ভবিষ্যতে এই যুদ্ধের ইতি ঘটেও, তাহলেও সেই সমাপ্তির সঙ্গেই শুরু হতে পারে নতুন সংঘাত। তা চলতে পারে আরও কয়েক বছর। জানুয়ারিতে কুর্দি অধ্যুষিত আফরিনে তুরস্কের সামরিক অভিযান, আসাদপন্থী সেনাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের সমর্থিতদের হামলা এবং শুক্র ও শনিবার সিরিয়ায় ইসরায়েলি বিমান হামলার পর এমন আশঙ্কা আরও জোরালো হয়েছে।
সিরিয়ার যুদ্ধে জটিলতাই ধারণা দিতে পারে কেন এখনও সেখানে যুদ্ধ চলমান রয়েছে। যুদ্ধটিতে চারটি বড় ধরনের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট সংঘাত একই সময়ে দৃশ্যমান হয়ে ওঠেছে। সিরিয়ার আসাদের বিরুদ্ধে শুরু হওয়া অভ্যুত্থান থেকে যে সংঘর্ষের শুরু, তা এখন বহুধা বিভক্ত। পরস্পরের স্বার্থবিরোধী বহু পক্ষের উপস্থিতির কারণে সহজে এ সংঘর্ষের কোন শান্তিপূর্ণ ইতি টানার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া, তুরস্ক, ইরান ও ইসরায়েলের মতো বিদেশি শক্তিগুলো যুদ্ধরত ভিন্ন ভিন্ন গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। তাদের দেওয়া অস্ত্রের সরবরাহের কারণে যুদ্ধ আরও তীব্র হয়ে উঠেছে।
আসাদকে উৎখাতে যুদ্ধ করা বিদ্রোহী গোষ্ঠীগুলোকে গত জুন থেকে সামরিক সহায়তা দেওয়া বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু কুর্দি ও আরবদের নিয়ে গঠিত সিরিয়ান ডেমোক্র্যাটিক ফ্রন্ট (এসডিএফ)-কে সহায়তা দিয়ে যাচ্ছে তারা। সিরিয়ার উত্তরাঞ্চলে এসডিএফর সঙ্গে উপস্থিত আছে যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষায়িত বাহিনীর (স্পেশাল ফোর্স) বিপুল পরিমাণ সদস্য। যুক্তরাষ্ট্র ২০১৪ সাল থেকে ৬০টি দেশের জোটকে নেতৃত্ব দিচ্ছে আইএসবিরোধী যুদ্ধে। এতদিন আসাদের বিরুদ্ধে সরাসরি কিছু না করলেও সম্প্রতি ব্যত্যয় ঘটেছে। সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে আসাদবাহিনীর একটি বিমানঘাঁটি আক্রমণ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
গত সেপ্টেম্বরে সাংবাদিকদের ট্রাম্প বলেছিলেন, আইএস ধ্বংস করা ছাড়া আর বিশেষ কিছু করার নেই ইরাক ও সিরিয়ায়। কিন্তু জুলাইতেই সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও বিদ্রোহীদের মধ্যে একটি যুদ্ধবিরতির চুক্তি করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্র ঠিক কী চায় সিরিয়া সংকট সমাধানের জন্য সে বিষয়ও পরিষ্কার নয়। আসাদকে ক্ষমতায় রেখে কোন সমাধান প্রস্তাব যুক্তরাষ্ট্র মানবে কী না তা বোঝা যাচ্ছে না।
অন্যদিকে রাশিয়া দীর্ঘদিন ধরে সমর্থন করছে আসাদ সরকারকে। নিজের সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে অস্ত্র পর্যন্ত সবই রাশিয়া দিয়েছে আসাদের সমর্থনে। এমন কী জাতিসংঘে কূটনৈতিক সমর্থনও নিশ্চিত করেছে সিরিয়ার জন্য। ২০১৫ সালের অক্টোবর থেকে রাশিয়া দেশটিতে সরাসরি যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। তারা সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলা চালিয়েছে। তাদের ভাষায় এইসব সন্ত্রাসীরা আইএসের সদস্য। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র বারবার অভিযোগ করেছে, রাশিয়া আইএস দমনের অজুহাতে তাদের সমর্থিত বিদ্রোহীদের ওপর বিমান হামলা করছে। অন্য দিকে রাশিয়াও অভিযোগ করেছে, যুক্তরাষ্ট্র আইএসের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে এমনভাবে ব্যবহার করছে যেন রাশিয়া ও সিরীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়।
রাশিয়ার ইচ্ছা আসাদকে ক্ষমতায় রাখা। কারণ আসাদ মধ্যপ্রাচ্যে রাশিয়ার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ মিত্র। সিরিয়ায় রাশিয়ার একটি বিমান ঘাঁটি ও একটি নৌঘাঁটি রয়েছে। মধ্যপ্রাচ্যে নিজের সামরিক শক্তি অটুট রাখতে রাখতে রাশিয়া তাই আসাদকেই চায়। শান্তি আলোচনায় রাশিয়া হয়তো সিরিয়ার অন্যান্য গোষ্ঠীগুলোর জন্য সীমিত মাত্রায় স্বায়ত্তশাসন অনুমোদন করতে পারে, তবে সেটা আসাদকে ক্ষমতায় রেখেই হতে হবে।
রাশিয়ার পাশাপাশি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলের সবচেয়ে বড় প্রতিদ্বন্দ্বি ইরানও সমর্থন করে আসাদকে। ২০১২ সাল থেকে তেহরান আসাদ সরকারকে বিশাল পরিমাণে সামরিক সাহায্য ও গোয়েন্দা তথ্য দিয়ে আসছে। ইরান সিরিয়াতে তার সেনাবাহিনীর পাশাপাশি শিয়া মিলিশিয়াদেরও মোতায়েন করেছে। তাছাড়া ইরান সমর্থিত হিজবুল্লাহও আসাদ সরকারের একনিষ্ঠ সমর্থক। ইরান আসাদবিরোধীদের পাশাপাশি আইএসের বিরুদ্ধেও যুদ্ধ করছে।
ইরানের আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব ও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সিরিয়া সবসময় ইরানের পাশে থেকেছে। তাছাড়া লেবাননে হিজবুল্লাহকে অস্ত্র পাঠাতে সিরিয়া দিয়ে যেতে হয় ইরানকে। তাই আসাদকে ক্ষমতায় রাখতে চায় ইরান। লেবাননের হিজবুল্লাহও ইরানের মতো ইসরায়েলবিরোধী। সিরিয়ার প্রতি ইরান ও হিজবুল্লাহর সমর্থনই ইসরায়েলকে এই সংঘাতে সিরিয়ার বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। সাম্প্রতিককালে তারা বিমান থেকে সিরিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় আক্রমণ করছে।
সিরিয়া যুদ্ধের শুরু থেকেই তুরস্ক আসাদবিরোধীদের সমর্থন করছে। কুর্দি ব্যতীত অন্যান্য সরকারবিরোধী শক্তি যেমন ফ্রি সিরিয়ান আর্মির সঙ্গে তারা আসাদবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ জোটের অংশ তুরস্ক আইএসের অবস্থানের ওপর যেমন হামলা করেছে তেমনি একতরফাভাবে কুর্দিদের অবস্থানের ওপরও হামলা করেছে। অপারেশন ইউফ্রেটাস শিল্ডের নামে চলা অভিযানে তারা পদাতিক সেনাও পাঠিয়েছিল সিরিয়ায়।
সিরিয়া যুদ্ধে তুরস্কের মূল লক্ষ্য কুর্দিদের অগ্রযাত্রা ব্যহত করা। তুরস্ক চায় না কুর্দিরা নতুন এলাকার নিয়ন্ত্রণ পাক। তাছাড়া যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে তারা যেন কোন রকম স্বায়ত্তশাসনের সুযোগ না পায় সেদিকেও নজর রয়েছে তুরস্কের। তাদের দাবি, সিরিয়ার কুর্দিরা পিকেকের কুর্দিদের সঙ্গে যুক্ত। পিকেকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে স্বাধীনতার জন্য তুরস্ক সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করছে। দেশটিতে পিকেকে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী হিসেবে আখ্যায়িত করে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার পেছেনে প্রত্যেকেরই নিজস্ব একটা যুক্তি থাকে। অভ্যুত্থান থেকে শুরু হয়ে যে সংগ্রাম যুদ্ধে পরিণত হয়েছিল তা আপাতত শেষ পরিণতির দিকে এগোচ্ছে। বিদ্রোহীদের কোন একক নেতা নেই। তাছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের মতো বিদেশি যেসব শক্তি তাদের সহায়তা দিচ্ছিল, তারাও তা বন্ধ করে দিচ্ছে। বিদ্রোহীদের অবস্থানও সীমিত হয়ে পড়েছে কিছু নির্দিষ্ট স্থানে।
আসাদ সরকারের বিদেশি সাহায্যকারীরা সহায়তা সরবরাহ বাড়িয়ে দিলেও, আসাদের পক্ষে যুদ্ধ করার মতো লোকবলের সংকট দেখা দিয়েছে। পুরো দেশের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে তা রক্ষা করার মতো লোকবল নেই আসাদ সরকারের। যেসব আধাসামরিক বাহিনীর লোকেরা তার পক্ষে বিভিন্ন এলাকায় যুদ্ধ করছে, তারা যুদ্ধ করতে পারলেও, শাসনব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার মতো প্রশাসনিক সক্ষমতা নেই। এমন অনেক স্থান আছে যেখানে আসাদের নিয়ন্ত্রণ নিছক কাগুজে বিষয়। সেসব এলাকায় আসাদের চেয়ে বেশি প্রভাবশালী রাশিয়া ও ইরানের মতো বিদেশি শক্তিগুলো।
আইএস জঙ্গিরা তাদের দখল করা প্রায় পুরো এলাকারই নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে যেখানে তারা তথাকথিত খিলাফত প্রতিষ্ঠা করেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় কুর্দি যোদ্ধারা আইএসের রাজধানী হিসেবে পরিচিত রাকা থেকে তাদের বিতাড়িত করেছে। আইএসের অবশিষ্ট যোদ্ধাদের কোনঠাসা করে সিরিয়ার পূর্ব সীমান্তের ছোট এলাকায় সীমাদ্ধ করে ফেলা হয়েছে।
যদিও এর ভেতরেও আইএসের যোদ্ধারা মরুভূমিতে তাদের গোপন আশ্রয়স্থল থেকে বের হয়ে এসে সিরিয়ার সরকারি বাহিনী ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিভিন্ন গোষ্ঠীর ওপর আচমকা হামলা চালাচ্ছে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এবার আইএসের যোদ্ধারা যুদ্ধের বদলে নাশকতা করা শুরু করবে। কারণ তাদের আর যুদ্ধ করার মতো সক্ষমতা নেই।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।