হবিগঞ্জের সুতাং নদী: শিল্প-কারখানার দূষণে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত।।
১১ মে ২০২০, ১২:৩৫ অপরাহ্ণ

মনসুর আহমেদ, বিশেষ প্রতিনিধি:- সুতাং নদী বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তসীমান্ত নদী। ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের পাহাড়ি অঞ্চল থেকে উৎপত্তি হয়ে হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে লাখাই উপজেলার মাদনা এলাকা হয়ে কিশোরগঞ্জে মেঘনার শাখা কালনী নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এর দৈর্ঘ্য ৮২ কিলোমিটার, গড় প্রস্থ ৩৬ মিটার। সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ ও জনপ্রতিনিধিদের নজরদারির অভাবে বহমান এ নদীটি কালের আবর্তে বিলীন হতে চলেছে। পাহাড়ি ঢল ও অতি বর্ষণের ফলে ভারত থেকে আসা উজানের পানি ও পলি মাটিতে ভরাট হয়ে নাব্য হারিয়েছে নদীটি। দীর্ঘদিন ড্রেজিং না করায় ও শিল্প-কারখানার বর্জ্য এ নদীটিকে মরণব্যাধিতে আক্রান্ত করেছে। এর প্রধান কারণ কোম্পানিগুলোতে নিয়মিত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ব্যবহার না করা।যেসব কোম্পানিতে ইটিপি রয়েছে, সেগুলো অতিরিক্ত খরচের ভয়ে নিয়মিত চালানো হচ্ছে না। সরকার ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে দেখাতে অনেক কোম্পানি ইটিপি স্থাপন করেছে। কিন্তু এগুলো বন্ধ রেখে কারখানার বর্জ্য ফেলা হচ্ছে সুতাং নদীতে। অথচ শিল্প-কারখানায় ইটিপি ব্যবহার বাধ্যতামূলক। রহস্যজনক কারণে পরিবেশ অধিদপ্তরের দায়িত্বশীলরা এসব দেখেও না দেখার ভান করে আছেন। ফলে নদীর তীরবর্তী সদর উপজেলার নুরপুর, রাজিউড়া, ফান্দ্রাইল, সানাবই, উচাইল, বেকিটেকা, নাজিরপুর, লুকড়া, লাখাই উপজেলার করাব, বুল্লা, বেগুনাই, বরগান্দিসহ বেশ কটি ইউনিয়নের গ্রামগুলোতে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও দৈনন্দিন জীবনে ব্যাপক বিপর্যয়ের পাশাপাশি উদ্বেগজনক মানবিক সংকটের সৃষ্টি হয়েছে। কলকারখানার দূষিত বর্জ্য নদীতে ফেলার কারণে সুতাং নদীর পানি কালো হয়ে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সুতাং নদীর পানি দূষণে সবচেয়ে বেশি ভূমিকায় রয়েছে প্রাণ (আরএফএল) ও স্কয়ার কোম্পানির একাধিক প্রতিষ্ঠান। তারা অলিপুর এলাকায় বিশাল আয়তন নিয়ে একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করেছে। এসব প্রতিষ্ঠানের বর্জ্য সুতাং নদীতে ফেলা হচ্ছে। বিষাক্ত বর্জ্যের মারাত্মক দূষণে পানি বিষাক্ত হয়ে মরে যাচ্ছে নদীর মাছ। এতে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন স্থানীয় জেলেরা। অন্যদিকে চাষাবাদে দুর্গন্ধযুক্ত বিষাক্ত পানি ব্যবহারের কারণে নষ্ট হচ্ছে জমির ফসল।
আদিকাল থেকেই হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলাকে শস্য ও মৎস্য ভান্ডার বলা হয়ে থাকে। উপজেলার খাদ্যের চাহিদা পূরণ করে হবিগঞ্জ জেলাসহ সারা দেশে খাদ্যের চাহিদা পূরণে সহায়তা করে আসছে লাখাইয়ে উৎপাদিত খাদ্যশস্য। কিন্তু সে ঐতিহ্য হারাতে বসেছে। পানি সংকটের কারণে লাখাইর বিস্তীর্ণ এলাকার ইরি বোরো ধানি জমি হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়েছে। এক সময়ের খরস্রোতা নদী বর্তমানে মরা খালে পরিণত হয়েছে। যতদিন যাচ্ছে ততই সুতাং নদী তার জৌলুস হারাচ্ছে। দীর্ঘদিন যাবত খনন না করায় নদীটি শুকিয়ে গেছে। সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে লাখাই উপজেলার প্রায় ১১ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এছাড়া হবিগঞ্জ সদর উপজেলায় প্রায় ১২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো চাষাবাদ হয়। এর বেশির ভাগই সুতাং নদীর পানি ব্যবহার করে। নদীর পানির অভাবে প্রতিবছর চাষাবাদ করতে কৃষকদের হিমশিম খেতে হয়। এতে প্রতি বছর-ই ব্যাহত হচ্ছে বোরো উৎপাদন।
লাখাই উপজেলার করাবের কৃষক জালাল উদ্দীন জানান, শিল্পবর্জ্যে নদীর তলদেশ ভরাটের পাশাপাশি তীব্র দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে। কৃষি কাজের জন্য নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। পানির অভাবে এলাকার ইরি বোরো ধানি জমি চাষাবাদ করতে না পারায় আমাদের খাদ্য সংকটে ভুগতে হবে। বুল্লা গ্রামের কৃষক জমির আলী বলেন, নদী থেকে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত জেলেরা। কালো কুচকুচে পানিতে এখন আর মাছ পাওয়া যায় না। ফলে শত শত জেলে বেকার হয়ে পড়েছে।
হবিগঞ্জ চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রেসিডেন্ট ও সদর উপজেলার চেয়ারম্যান মোতাচ্ছিরুল ইসলাম মুঠোফোনে জানান, আমি দীর্ঘদিন ধরে সুতাং নদীর দূষণ নিয়ে আন্দোলন করে আসছি। গত উপজেলা নির্বাচনের পর পর-ই জেলার পরিবেশ কর্মীদের নিয়ে সভা সমাবেশ করে আমরা সরেজমিনে সুতাং নদীর আশেপাশে গড়ে ওঠা কল কারখানা পরিদর্শন করি এবং নদীর দূষণ দেখে কোম্পানিগুলোর কর্তৃপক্ষকে নিয়মিত ইটিপি (বর্জ্য শোধনাগার) ব্যবহার করতে অনুরোধ করেছি। বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম থেকে শোনেনি তারা এখনো সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আমরা কঠিন ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবো।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক ও নদী গবেষক তোফাজ্জল সোহেল বলেন, সদর উপজেলা ও মাধবপুর উপজেলায় কৃষিজমির ওপর অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন কলকারখানা। এসব কলকারখানার বিষাক্ত বর্জ্য আশপাশের খাল ও নদীতে ফেলার ফলে ভয়াবহ শিল্পদূষণ হচ্ছে। ভরাট হচ্ছে নদীর তলদেশ। এতে মানুষ শ্বাসকষ্ট, চর্মরোগসহ জটিল রোগে আক্রান্তসহ পানির অভাবে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পানি কালো ও দুর্গন্ধময় হয়েছে। নদীতে আর মাছ পাওয়া যায় না, নদীর পানি ব্যবহারকারীরা পানি সংকটে ভুগছেন। এলাকার চাষাবাদ ক্ষতিগ্রস্ত, নদী মাছ শূন্য হয়ে পড়েছে। সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলোকে বারবার অবহিত করার পর সুতাং নদীতে কল-কারখানার দূষণরোধে কোনো ধরণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে না। তিনি অবিলম্বে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সুতাং নদী খননসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান।
উপজেলাবাসীও সুতাং নদী খনন করে শিল্প বর্জ্যরে দূষণ থেকে রক্ষার দাবি জানিয়েছেন।