মীর লিয়াকত :::
একটু গভীর ভাবে ভাবুন আমরা ছিলাম কোথায় আর এখন আছি কোথায়! না, বেশি দূরে যেতে হবে না। মাত্র তো মাস তিনেক। এই তিন মাস আগে আমারা কোথায় ছিলাম আর এখন আছি কোথায়। আমাদের অন্ন বস্ত্র বাসস্থান চলাফেরা জীবন পদ্ধতি এখন কোথায়! পৃথিবী থেকে স্বাভাবিক সবকিছুই বিদায় নিয়েছে এবং নিচ্ছে। বদলে যাচ্ছে চলন বলন আয়োজন প্রয়োজন সব কিছু। নতুন ব্যবস্থাপনার ইঙ্গিত দিয়েছে করোনা। কি করতে হবে কিভাবে করতে হবে কেন করতে হবে কেন করতে হবে না এসব কিছুর পাঠই এখন করোনার কাছ থেকে শিখতে হচ্ছে। তার পাঠদান থেকে সরে এসে কিছুই যে করা যাবে না তা পৃথিবীর তাবৎ মানুষ এতোদিনের মরণযজ্ঞে হাড়ে হাড়ে বুঝে গেছে। এতোকাল পৃথিবী যেভাবে চলে এসেছে এখন যে আর সেভাবে চলা যাবে না আর চললেও বিকল্প নতুন ব্যবস্থা নিতে হবে এটাও মানুষ ভালোভাবে বুঝে গেছে। প্লেগ সার্স বার্ড ফ্লুসহ অনেক ভাইরাসের সাথে শত শত বছর ধরে মানুষের পরিচয় হয়েছে। তখেেনা মানুষ একটার পর একটা আবিস্কারের মাধ্যমে প্রতিরোধ প্রতিকার খুঁজে এসেছে, সফলও হয়েছে। করোনার বিষয়ে সময় লাগলেও সফল হবে হয়তো। কিন্তু একটা বিষয় এখনো অস্পষ্ট যে বর্তমান কম্পিউটর প্রযুক্তির মতো অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধা সে সময়ে ছিলো না। যা বর্তমান পৃথিবীতে আছে। সেই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়েও বাঘ বাঘা দেশ করোনাকে থামাতে পারছে না। উল্টো বরং তার কাছে অসহায়ভাবে আত্মসমর্পন করছে। বরেন্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর হলেও করোনা একেবারে নির্মূল হবে না। যদি নির্মুল না হয় আর থেকেই যায় তবু পৃথিবীর এতো কালের স্বাভাবিক অবস্থান আর ফিরে আসবে না। কারন ভাইরাস তো একটি নয়। একটি থেকে আরোও জন্ম নিতে পারে। আর তা যদি হয় তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতি বিশ^জুড়ে থেকেই যাবে।
যেমন পৃথিবীর চিরন্তন অভ্যাস হ্যান্ডশেক করা। গøাভস ছাড়া এই কাজটি আর তাহলে হচ্ছে না। কি বলছি, গøাভস থাকলেও মনে হয় এই সৌহার্দ্যপূর্ণ কাজটি আর কেউ করবেন বলে মনে হয় না। যেমন মাস্ক ছাড়া সর্বদা সব সময় আর থাকা যাবে না, বাইরে তো নয়ই এর মধ্যে মাস্ক ছাড়া আবার জরিমানাও। অনেক দিন, বছর, যুগ পর শ্রেষ্ঠ সামাজিক জীব মানুষ কারো সাথে দেখা হলে সহাস্যে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরা হ্যান্ডশেক করা তো দূরের কথা, থাকতে হবে মেপে মেপে তিনফুট দূরে! কি অবস্থা, কল্পনা করা যায়? কিন্তু এখন এটাই বাস্তব। শুধু তাই নয়, ইচ্ছা মতো বাইরে পোষাক পড়াও যাবে না। তার মানে পোষাকে আষাকেও আসছে স্থায়ী পরিবর্তন। নন্দিত চোখ ধাঁধানো ড্রেস করে মুখ ঢেকে রাখা একটি অভিশাপ দেখা গেলেও কিছুই করার নেই। এটা করে যেতেই হবে। সুরক্ষার জন্য চশমা মুখাবরন ইত্যাদি তো আছেই। মাথার বাহারী চুলটাও কাউকে দেখানো যাবে না। আহারে! বাইরে গেলে পড়ে থাকতে হবে নিদেনপক্ষে পলিথিন জাতীয় কিছু। এয়ারকন্ডিশন সেলুনে গিয়ে পা ছড়িয়ে দিয়ে চোখ বুজে বলতে পারবেন না ‘মাথাটা একটু বানিয়ে দেতো বাপ’! পাছে ভাইরাস এসে ঢুকে যায়! সেই সাথে পিপিই’র কথা তো রয়েই গেলো। সুরক্ষার জন্য এটিও বাদ যাবে না। ঈদের দিনের ঐতিহ্যবাহী কুলাকুলি আর হচ্ছে না। সৌদিয়ান ঐতিহ্যের গালে চুমো খাওয়াটাও রাখতে হবে বাদ। তিনফুট দূর থেকে এটা করাও যাবে না। আন্তরিকতার সাথে কোন সভা সমিতিতে পাশ ঘেষা থাকবে বন্ধ। হাতে হাত রেখে অন্তরঙ্গ হয়ে পার্ক সাফারিতে ঘুরাঘুরিও সম্ভবত বন্ধই হচ্ছে ভাইরাস আক্রমন থেকে রেহাই পেতে। এক কথায় পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়া পর্যন্ত বিশেষত কার্যকর কোন অতি নির্ভরযোগ্য ভ্যাক্সিন না আসা পর্যন্ত বেশির ভাগ সময়ই দুরত্ব অবলম্বন করে থাকতেই হচ্ছে। প্রয়োজনের বাইরে আত্মকেন্দ্রীকভাবে কাটাতে হবে সময়। বাঙালির ঐতিহ্যবাহী আতিথেয়তা আড্ডা ইয়ার্কীর জমকালো অবস্থান বাদ রাখতেই হবে। স্বাভাবিক জীবনে এ এক অস্বস্থিকর জীবন। অনেকে অবশ্য এখনো বলেন এসব ভাইরাস বেশি দীর্ঘায়িত হবে না। কিছুদিনের মধ্যেই চলে যাবে আর স্বাভাবিক জীবন ফিরে আসবে। বিশ^বার্তা কিন্তু তা বলছে না। আমাদের দেশে প্রতিদিনই বেড়ে চলেছে সংক্রমন। বাড়ছে মৃত্যুর হার। করোনায় আক্রান্ত হয়ে চলে গেছেন ড. আনিসুজ্জামান, সাবেক মন্ত্রী মো: নাসিম, মিডিয়ার সংস্কৃতি অঙ্গনের অন্যতম পথ নির্দেশক মোস্তফা কামাল সৈয়দসহ বিশিষ্টজনেরা। রয়েছেন সাংবাদিক আইনজীবি চিকিৎসক ব্যবসায়ী এবং নানা পেশার মানুষ। আগামীতে আরো কি হতে পারে তা জানে ভবিতব্যই। আর আক্রান্ত হবার প্রেক্ষাপট তো তৈরী হচ্ছে প্রতিদিনই। তাহলে কি ভাবে ফিরে আসবে সহসাই আমাদের স্বাভাবিক জীবন?
এখানে বলা দরকার এক সময় সংক্রামক ব্যাধি ডায়রিয়া কলেরাও এভাবে ঘটিয়েছে জীবনহানি। কিন্তু একসময় দেখা গেছে এক চিমটি গুড় লবন আর পানি দিয়ে মূহুর্তে স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব হয়েছে। বেরিয়েছে প্যাকেট স্যালাইন। বলতে গেলে কলেরার মতো মারাত্মক জীবানু এসে গেছে হাতের মুঠোয়। কিন্তু তার জন্যও সময় দিতে হয়েছে। ম্যালেরিয়াও দেখা দিয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দিতে মারাত্মক মহামারীরূপে। এই ম্যালেরিয়ার জীবানু আবিস্কারের জন্য স্যার রোনাল্ড রস (১৮৫৭-১৯৩২) ইংল্যান্ড থেকে ভারতের সিকান্দারাবাদসহ বিভিন্ন স্থানে এসে তার গবেষণা করেছিলেন। অবশ্য তার জন্মও ছিলো বৃটিশ ভারতে। পরে এই স্কটিশ জেনারেলের পূত্র ইংল্যান্ডে পড়াশুনা ও গবেষণা করেন। এ্যানোফিলিশ মশার ওপরে গবেষণার জন্য তাকে ভারতে আসতে বলা হয়েছিলো। রোনাল্ড রস ছিলেন বিশে^র দ্বিতীয় নোবেল বিজয়ী চিকিৎসা বিজ্ঞানী। তাঁর আবিস্কারটি ছিলো সেই সময়ে একটি যুগান্তকারী আবিস্কার। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যে দেশগুলি সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে তার মধ্যে রয়েছে জার্মানী, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, স্পেন, ইতালী, রাশিয়া, চীন।
কোভিড-১৯ কিন্তু উক্ত সবকটি দেশেই বিশেষভাবে আক্রমন চালিয়েছে, লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি ঘটিয়েছে। ১৯০১ সাল থেকে বিশে^ চিকিৎসা বিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার দেয়া হচ্ছে। উল্লিখিত দেশগুলোর সবকটি দেশই সেই থেকে এ পর্যন্ত চিকিৎসা বিজ্ঞানে অবদানের জন্য নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। কিন্তু কোভিড-১৯ এর উপর এখনো কোন আবিস্কার হাতে এসে পৌঁছায়নি। যদিও সারা বিশে^ই এই ভ্যাক্সিন আবিস্কার নিয়ে কাজ অব্যাহত আছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন ইতোমধ্যে তারাও বসে নেই। মানুষের শরীরে ভ্যাকসিন প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। সেই পর্যন্ত অপেক্ষা করে যেতেই হবে। আগেই বলেছি এখন জীবন পদ্ধতি বদলে চলতেই হবে। ঝট করে স্বাভাবিক জীবনে ফেরা সম্ভব নয়। কতোদিন কতো মাস বা কতো বছর তা সময়ই বলে দেবে। কিন্তু পরিবর্তিত রূপকে মেনে নিতেই হবে। পৃথিবীর যুদ্ধবিগ্রহ, হিংসাত্মক আক্রমন অস্ত্র শস্ত্র ও পারমানবিক প্রতিযোগিতা ধ্বসলীলা সম্প্রসারনবাদী চিন্তাচেতনা থেকে আপাতত হলেও সরে থাকতে হবে। এর বদলে অর্থনৈতিক দিক নিয়ে ভাবতে হবে । অস্বাভাবিক ভাবে বেড়ে যাওয়া বেকারত্ব কর্মহীনতা দুর্ভিক্ষ ক্ষুধা ইত্যাদি থেকে বেরিয়ে আসার সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হবে বিশে^র মানবকুলকে। আপাতত হলেও শক্তি প্রতিযোগিতা ভুলে থাকতে হবে।
সদিচ্ছা থাকলে এখান থেকে মানুষ নতুনভাবে শান্তির নতুন পৃথিবী গড়ার কাজে কিন্তু আত্মনিয়োগ করতে পারে। কারন প্রকৃতির ভারসাম্য রক্ষা আপনা আপনিই হবে। এখানে কারো ইচ্ছাকে প্রাধান্য দেয়া যাবে না। হতে পারে করোনার শেষ। কিন্তু এখান থেকে শিক্ষা নিয়ে না এগোলে নতুন ভাই্রাসের আগমনও কিন্তু অমূলক নয়। এ সবই ভবিতব্য। তবে বিশ^বাসী একটা মোক্ষম সিগন্যাল পেয়ে গেছে। এখন এটাকে কাজে লাগানো না লাগানো মানুষের ইচ্ছা। এসব কিছু বুঝে শুনেই চলতে হবে আগামীর পৃথিবী। প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে নিজের ভারসাম্য রক্ষা করছে। ¯্রষ্টা এটাই আমাদের নির্ধারন করে দিয়েছেন। তার সৃষ্টি পৃথিবী যেখানে যেভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে নিজের নিয়মে নিজেই সে পুষিয়ে নেবে। এখন প্রকৃতি তাই নিচ্ছে।
এক কথায় অস্বাভাবিক জীবনের পথে ছুটতেই হচ্ছে আমাদের। তবু সীমিত সক্ষমতা নিয়েই আমাদের পথ চলতে হবে। জীবনের এক মহা পরিবর্তিত রূপ! করোনার হাত ধরেই এই অস্বাভাবিক পরিবর্তন। এখন শুধু অনাগত ভবিতব্যকে সামনে রেখে দেখে যাওয়া ছাড়া আর আমাদের কিছুই করার নেই। যদিও আমরা চাই করোনার এই ভয়াবহতা কাটিয়ে আবার যেন আমরা সুন্দর স্বাভাবিক সুস্থ জীবনে ফিরে যেতে পারি, এই প্রত্যাশা আমাদের আন্তরিক।
লেখক : মীর লিয়াকত, সব্যসাচী লেখক ।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।