নূরুল ইসলাম ফরহাদ ফরিদগঞ্জ, (চাঁদপুর) :
নীড়ই মানুষের কাঙ্খিত স্থান। মানুষকে নীড়ে ফিরে আসতেই হয়। কারণ সেখানে রয়েছে নাড়ীর টান। শিকড়কে অস্বীকার করা যায় না। নাড়ীর টানে অথবা মমত্ববোধে একসময় মানুষকে ফিরে আসতে হয়। হয়তো কেউ ফিরে আসে লাশ হয়ে; আবার কেউ ফিরে আসে কীর্তি নিয়ে। তেমনি একজন মানুষ গিয়াস উদ্দিন খান। গ্রামকে ভালোবেসে এই বই প্রেমী মানুষটি তাঁর মা বাবার নামে নিজ এলাকায় গড়ে তুলেছেন ‘রাউফেন মজিদ স্মৃতি পাঠাগার’। ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৬নং গুপ্টি ইউনিয়ন খাজুরিয়া বাজারের পূর্ব মাথায় শৈল্পীক পাঠাগারটি অবস্থিত।
রাস্তার পাশে ১৮ শতাংশ ভূমির উপর গিয়াস উদ্দিন খান ২০১৭ সালে একটি ভবন গড়ে তোলেন। ২০১৮ সালে এই ভবনে ‘রাউফেন মজিদ স্মৃতি পাঠাগার’র কার্যক্রম শুরু করেন। ভবনের পূর্বপাশে ছোট একটি ফুল এবং ফলের বাগান রয়েছে। দক্ষিণে ছোট্ট পুকুর। পুকুরের পশ্চিম পাশে ২৫০-৩০০ সেটের হাঁসের খামার আর টার্কি পালতেন। ছাদের এক পাশে কবুতরের ঘর। আর গোটা ছাদ জুড়ে ফুল আর ফল গাছের আবাদ। নীচতলা পুরোটাই পাঠাগার। ১৫০০ স্কয়ার ফিটের মধ্যে তিনটি রুম এবং দু’টি টয়লেট। বাউন্ডারি গেট দিয়ে ঢুকতেই মূল ভবনের প্রবেশ পথে দুই পাশে ফুলের বাগান। ভবনে প্রবেশের পর ডান পাশের রুমটিই মূলত পাঠাগার কক্ষ। প্রথমে বিস্মিত হবেন কক্ষের সেল্ফের নান্দনিকতা দেখে। রুম ভর্তি ঠাসা বই অথচ বিরক্ত হবেন না। পাঠক বেশী হলে অবশ্যই এই পরিকল্পনা সঠিক নয়। যারাই সাজিয়েছেন হয়তো এই চিন্তা থেকেই সাজিয়েছেন, গ্রামে অতো পাঠক হবে না। তবে বই বিন্যাসে চরম ভুল আছে। হয়তো এক সময় সব ঠিকও হয়ে যাবে। তবে শৈল্পীক সেলফ এবং রুম সাজানোর ভিন্ন চিন্তার জন্য অবশ্যই সাধুবাদ পেতে পারেন জনাব গিয়াস উদ্দিন। পাঠক, বর্ণনাতে সঠিকভাবে বুঝতে পারবেনা কত সুন্দর পাঠাগারটি। একবার এসে দেখেই যান। চেয়ারের বদলে টুল, টেবিলতো আছেই। এক কোনায় একটি ছোট খাটও আছে। আপনি চাইলে শুয়ে শুয়েও পড়তে পারেন। ছোট্ট একটি রুমে প্রায় ২০টির মতো বিভিন্ন স্টাইলের সেল্ফ আছে। টেবিল আছে দু’টি। পাশের রুমে ৩টি সেল্ফ এবং সবগুলোতে ইংরেজি সাহিত্য। পাশেই রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি গ্যালারী। এ রুমের আলাদা বিশেষত্ব হলো এখানে সাংস্কৃতিক পরিবেশনার জন্য রয়েছে চমৎকার একটি মঞ্চ। তৃতীয় রুমটি এখনো পুরোপুরি সাজানো হয়নি। সেখানে কম্পিউটার ট্রেনিং সেন্টার দেওয়ার চিন্তা ভাবনা রয়েছে। গিয়াস উদ্দিনের তথ্যমতে, পাঠাগারটিতে প্রায় ৪ হাজার বই রয়েছে। সপ্তাহের ৭ দিনই পাঠাগারটি খোলা থাকে। সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা এবং বিকাল ৪টা থেকে রাত ৮টা পর্যন্ত পাঠাগারের কার্যক্রম চলে। পাঠাগারের সদস্য ফি ১০০ টাকা এবং মাসিক চাঁদা ৩০ টাকা। সদস্যদের জন্য বই বাসায় নেওয়ার সুযোগ রয়েছে।
বলা হয়ে থাকে আগুন ছাঁই চাপা থাকলেও কোন একদিন তা জ¦লে উঠবেই। তেমনি একটি উদাহারণ গিয়াস উদ্দিন খান। পেশায় একজন ব্যবসায়ী হলেও এক সময় পেয়ে বসে বইয়ের নেশা। হোক না তা বয়সের শেষ সময়ে এসে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এই ধরনের মানুষের প্রতি ইঙ্গিত করে বলেছেন,‘বয়সে কি যৌবন যায়? যৌবন যায় রূপে আর মনে; যার রূপ নাই, সে বিংশতি বয়সেও বৃদ্ধা; যার রূপ আছে, সে সকল বয়সেই যুবতী। যার মনে রস নাই, সে চিরকাল প্রবীন। যার রস আছে, সে চিরকাল নবীন।’ আবার হেলাল হাফিজ বলেছেন,‘এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়’। জনাব গিয়াস উদ্দিন যখন বেলা শেষে এসে সুন্দর সমাজ বিনির্মানে যুদ্ধের জন্য মাঠে কাজ করেন তখন তারুণ্য তার উপর এসে ভর করে। এ বড় প্রেরণার দৃশ্য! আ-হা, বড় ভালোলাগার দৃশ্য; আনন্দে চোখে জল আসার দৃশ্য।
১৯৭৮ সালে তিনি ফরিদগঞ্জের ‘রূপসা আহমদিয়া উচ্চ বিদ্যালয়’ থেকে এস.এস.সি পাশ করে চলে যান ঢাকাতে। সেখানে তিনি ভর্তি হন ‘ঢাকা বিজ্ঞান কলেজ’এ। এইচ.এস.সি’তে পড়াকালীন সময়ে বঙ্কিমচন্দ্রের লেখার ভক্ত হয়ে যান। আড্ডায় এবং লেখায় প্রায়ই বঙ্কিমের লেখার উদ্বৃত্তি দিতেন বলে বন্ধুরা তাকে ২য় বঙ্কিম বলে ডাকতো। তারপর অনেক সময় গড়িয়েছে। জাহাঙ্গীরনগর বিশ^বিদ্যালয় থেকে অনার্স মাস্টার্স পাশ করার পর একটি ব্যাংকে চাকরী হয়। কিন্তু তিনি চাকরী না করে তাঁরই বড় ভাই বিখ্যাত ডাক্তার শাহাবুদ্দিনের পরামর্শক্রমে ১৯৮৮ সালে দুবাই চলে যান। সেখানে তিনি নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর দেখা-শোনা করতেন। ইরাক-কুয়েত যুদ্ধের সময় দেশে চলে আসেন। এসেই ব্যবসায়ী জীবন শুরু করেন। ঢাকার নীলক্ষেতে শুরু করেন ব্যবসী জীবন।
একদিন বৃষ্টি¯œাত, ক্রেতাশূণ্য দোকানে সামান্য সময়ের জন্য তিনি ধ্যানমগ্ন হয়ে পড়েন। কোলাহলযুক্ত শহরে যেন নিস্তব্ধতা নেমে এলো। বাহিরের যান এবং জনের গমগম শব্দের কিছুই তাঁর কানে আসছেনা। একসময় বৃষ্টি থেমে যায় কিন্তু ধ্যান ভাঙ্গে না গিয়াস উদ্দিনের। চিন্তারা খেলা করে তাঁর মস্তিষ্কে। ঠিক সেই মূহুর্তে একটি দৃশ্য তাঁর এলোমেলো চিন্তার স্থিরতা দেয়। এবার তিনি চিন্তা করতে লাগলেন, জীবনে কী করলাম? আর কিইবা পেলাম? আমার কী করার কথা ছিলো অথচ কী করলাম বা করছি ? এর নামই কী জীবন? সমাজ? সংসার? মানবতা? তাঁর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জবাব দিলো- ‘না’। তিনি পেয়ে গেলেন তাঁর কাঙ্খিত উত্তর। আজ মানুষ খুব বেশী যান্ত্রিক হয়ে গেছে। শহুরে মানুষগুলোও কেমন জানি হয়ে গেছে। আবেগ কাজ করে না, মানবতা আজ কংকালসার। সংসারগুলো হয়ে গেছে ঠুনকো। কেমন জানি একটা অস্থিরতা বিরাজ করছে সর্বত্র। সমাজ যেন দিনদিন অসামাজিক হয়ে যাচ্ছে। মানুষ কী যেন হাতছাড়া করে ফেলছে। সবাই ছুটছে তো ছুটছেই। থামার কোনো লক্ষণ নেই। নিজের জন্য, পরিবারের জন্য, সমাজের জন্য, মানবতার জন্য মানুষের কিছু সময়ের জন্য থামা দরকার। মূলে ফিরে যাওয়া দরকার। মূল কোথায়? মূল হলো বিশে^ যে সকল অঞ্চল যার পরশ পেয়ে সভ্য এবং উন্নত হয়েছে সেই ‘বই’। মানুষের মধ্যে সভ্যতা, ভদ্রতা, মানবিকতা, রুচিশীল উন্নত সমাজ উপহার দিতে হলে বইয়ের বিকল্প নেই। বই পারে আমাদের এই সঙ্কটময় কাল দূর করতে। তাই জনাব গিয়াস উদ্দিন খান দৃঢ়তার সাথে সিদ্ধান্ত নিলেন, সুন্দর সমাজ বিনির্মানে তিনি পাঠাগার গড়ে তুলবেন। তাঁর উপলব্ধি হলো, জীবনের বেশীরভাগ সময় যে কাজে সময় অতিবাহিত করলাম তা কোনো কাজই না। যে কাজ আমার অবর্তমানে আমাকে স্মরণ করবে না সেটা আবার কেমন কাজ ? তাই এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়ার আগে সমাজের জন্য এমন কিছু করে যেতে চাই যা আমার মৃত্যুর পর এবং আগে কাজে লাগে। কী চমৎকার ভাবনা! আর এই ভাবনা থেকেই গড়ে উঠে ‘রাউফেন মজিদ স্মৃতি পাঠাগার’।
পাঠক মনে আছে? দৃশ্য কল্পের কথা বলা হয়নি। বৃষ্টি চলে যাওয়ার পরও যখন তার ধ্যান ভাঙ্গেনি। তখন তার সামনে দিয়ে ভ্যান ভর্তি পুরনো বই বয়ে বেড়াচ্ছিল একটি লোক। তারপর তিনি বেরিয়ে পড়লেন। চলে গেলেন রাস্তার পাশে বই বিক্রেতাদের কাছে। তাদের সাথে বসলেন, সময় কাটালেন, কথা বললেন; বুঝলেন এবং জানলেন অনেক না জানা কথা। এভাবেই তাদের সাথে সম্পর্ক গড়ে উঠে তার। একটি, দু’টি করে বই সংগ্রহ করতে থাকেন। এভাবে বেশ কিছু বই সংগ্রহ করলেন। এক সময় দেখা গেল অনেক বই। তিনি প্রায়ই দুঃখ করে বলতেন পৃথিবীতে সবচেয়ে কম মূল্যের জিনিস হলো বই। বই কেজি ধরেও বিক্রি হয়! যথার্থ উত্তোরসূরি না রেখে যাওয়াতে বিশিষ্ট কবি, সাহিত্যিক এবং সাংবাদিকদের তিল তিল করে গড়ে তোলা ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা তার বা তাদের শূণ্যতায় কেজি ধরে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। গিয়াস উদ্দিন সাহেব বিষয়গুলো খেয়াল করতেন। সুযোগ পেলেই তিনি এসব বিখ্যাত এবং মূল্যবান বইগুলো কিনে রাখতেন।
তিনি যখন দেখলেন তার সংগ্রহশালা যথেষ্ট সমৃদ্ধ হলো। তখনই তিনি তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের পাশেই একটি ঘর খালি করে সেখানে গড়ে তুলেন ‘রাউফেন মজিদ স্মৃতি পাঠাগার’। ২০০৬ সালে গড়া এই পাঠাগারে তিনি সময় পেলেই বই নিয়ে বসে যেতেন। একসময় চিন্তা করলেন পাঠাগারটি তিনি গ্রামের বাড়িতে স্থানান্তর করবেন। মনে মনে জায়গাও নির্ধারণ করে রাখেন। একটি সামাজিক প্রতিষ্ঠান দিবেন বলে তৎকালিন ফরিদগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার জসীম উদ্দিন বাদল’র কাছে কিছু ভূমির প্রত্যাশা করেন। অতঃপর ২০০৩ সালে খাজুরিয়া বাজারে ১৮ শতাংশ ভূমি দান করেন জসীম উদ্দিন বাদল সাহেব।
সংসার জীবনে তিনি দুই মেয়ে এবং এক ছেলের বাবা। তাঁর স্ত্রী শামীমা আক্তার ইডেন মহিলা কলেজের দর্শন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।