চলে গেলেন মানুষ গড়ার আদর্শ কারিগর এম এ গনি

Daily Ajker Sylhet

newsup

১৩ মার্চ ২০২১, ০৪:৩৭ পূর্বাহ্ণ


চলে গেলেন মানুষ গড়ার আদর্শ কারিগর এম এ গনি

।। আহবাব চৌধুরী খোকন ।।

অবশেষে না ফেরার দেশে পাড়ী জমালেন কুলাঊড়া সরকারী কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ আমার প্রিয় শিক্ষক শ্রদ্ধেয় এম এ গনি ।
তিনি ছাত্রছাত্রীদের নিকট গনি স্যার নামেই
সর্বাধিক পরিচিত ছিলেন ।গত ২৭শে ফেব্রুয়ারী যুক্তরাষ্ট্রের নিউজার্সী স্টেটে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মানুষ গড়ার এই আদর্শ কারিগর ।অনেক দিন থেকে শুনা যাচ্ছিল স্যারের বার্ধক্যজনিত অসুস্থতার সংবাদ ।
কিন্তু এই করোনা কালীন সীমাবদ্ধতার জন্য শেষ বারের মত প্রিয় স্যারের মুখখানি যেমন দেখার সুযোগ পাইনি তেমনি পারিনি বিদায় বেলা কবরে দুমোটো মাটি দিতে।স্যারের এক অকৃতজ্ঞ ছাত্র হিসাবে এই অপরাধবোধ আমাকে আমৃত্যু পীড়া দেবে ।১৯৬৯ সালে উপাধ্যক্ষ হিসাবে যে কুলাঊড়া ডিগ্রী কলেজে কর্মজীবন শুরু করেছিলেন, ২০০৫ সালে সেই কলেজ থেকেই অধ্যক্ষ হিসাবে চাকুরী জীবনের সমাপ্তি ঠানেন তিনি।কর্মজীবন শেষে তিনি স্বপরিবারে নিউজার্সীর আটলান্টিক সিটিতে পুত্রের সাথে অবসর জীবন যাপন করে আস ছিলেন ।আমার ভগ্নি পতি মরহুম আকমল খান ছিলেন কুলাঊড়া কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক এবং উনার বাসস্থান ছিল কুলাউড়া শহরে।সে কারণে ছোট বেলা থেকে কুলাঊড়ায় আমার আসা যাওয়া ছিল এবং বোন ও ভগ্নিপতির সুবাধে কুলাঊড়া কলেজের প্রায় সকল শিক্ষক-শিক্ষিকার সাথে আমাদের একটি পারিবারিক সম্পর্ক গড়ে উটেছিল।সেই ছোট বেলা থেকে কুলাঊড়া কলেজের যে সকল শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শিক্ষিকার স্নেহ ও ভালোবাসা পেয়েছি তাঁদের অনেকেই এখন আর এই ইহ জগতে নেই।বেঁচে নেই প্রিন্সিপাল ইউছুফ স্যার, খান স্যার,মছব্বির স্যার, কাজী একরাম স্যার, হারুন স্যার, মাহবুবা আপা ,জাফর স্যার ও সর্বোপরি আমার ভগ্নিপতি আকমল খান ।

কুলাউড়া কলেজের যে কজন শিক্ষকের সাথে আমার সবচেয়ে বেশী সম্পর্ক ছিল তাদের মধ্যে শ্রদ্ধেয় স্যার জনাব এম এ গনি ছিলেন একজন।গণি স্যারের স্ত্রী আমার ফুফাতো বোন আলেয়া চৌধুরীর আত্নীয়া হওয়াতে স্যারকে আমরা আমাদের একজন ভগ্নিপতি বলেই জানতাম।মনে পড়ে ১৯৮৬ সালে আমি যখন কুলাঊড়া কলেজে প্রথম ভর্তি হই তখন স্যার ছিলেন এই কলেজের উপাধ্যক্ষ।আমার ভর্তির কাগজপত্র স্যার নিজে ফিলাপ করেন উনার রুমে বসেই।গনি স্যার আমার দেখা খুব শান্ত শিষ্ট এবং সজ্জন একজন মানুষ ছিলেন ।যেমনি ছিলেন সদালাপী তেমনি ধর্মভীরু।তিনি একাধিক বার হ্বজব্রত পালন করেছেন ।আমি যখন কুলাঊড়া কলেজের ছাত্র তখন দেশে চলছিল স্বৈরাচারী শাসন ।ফলে সারা দেশের ন্যায় কুলাঊড়া কলেজে সর্বদা ছাত্র আন্দোলন ছিল তুঙ্গে।কলেজে মারা মারি ও মিছিল মিটিং লেগে থাকতো।তবে দেখতাম যখনই ছাত্র সংগঠন গুলোর মধ্যে সমস্যার উদ্ভব হত গনি স্যার মধ্য খানে দাড়িয়ে সেই সমস্যার সমাধান করতেন ।যে কোন সমস্যা নিমিষেই সমাধান করার একটা অসম্ভব গুন স্যারের মধ্যে ছিল ।স্যার ছাত্রছাত্রীদের খুব স্নেহের চোঁখে দেখতেন ।ফলে যেমনি সোহাগ করতেন তেমনি শাসন ও করার অধিকার রাখতেন।আমি দেখেছি মরহুম ইউছুফ আলী সেই সময়ে কলেজের অধ্যক্ষ হলেও প্রশাসনিক সকল দায়িত্ব গণি স্যারের উপর ন্যস্ত ছিল।

 

 

আমাদের সময়ে স্যার ছিলেন কলেজের উপাধ্যক্ষ ও সেই সাথে যুক্তিবিদ্যা বিভাগের সিনিয়ার শিক্ষক ।পরবর্তীতে আমি কলেজ ছেড়ে আসার পর স্যার কলেজের অধ্যক্ষ নিযুক্ত হন ।সেই সময়ে কলেজে একই বিভাগে অধ্যাপক হারুনুর রসীদ নামে আর ও একজন শিক্ষক ছিলেন ।তারা দুজন মিলে আমাদের যুক্তিবিদ্যার ক্লাস নিতেন।তবে স্যারের ক্লাস নেওয়ার পদ্ধতি এবং বুঝানোর ক্ষমতা ছিল অসাধারণ।স্যার সহজ সরল ভাষায় হেঁসে হেঁসে যুক্তিবিদ্যার বিভিন্ন বিষয় শ্রেণীকক্ষে উপস্থাপন করতেন। তিনি সর্বদা ছাত্রছাত্রীদের প্রতি খুব আন্তরিক ও যত্নশীল ছিলেন।দেখেছি ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে অনেক সময় স্যারের সাথে তাঁর সহকর্মীদের মতবিরোধ দেখা দিত ।আমাদের সময়ে স্যার পরীক্ষা হলের সুপারেন্টেনের দায়িত্ব পালন করেন ।এইচ এস সী ফাইনাল পরীক্ষার সময় হলের পরিবেশ সুন্দর রাখতে স্যার অসম্ভব পরিশ্রম করতেন।স্যার পরীক্ষার সময় প্রতিটি রুমে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের খবর নিতেন ।

প্রতিষ্টালগ্ন থেকে কুলাঊড়া কলেজের সার্বিক উন্নয়নের ব্যাপারে তিনি যেমন ছিলেন সোচ্চার ও সচেতন তেমনি গরীব ছাত্রছাত্রীদের প্রতি মমত্ববোধ ছিল প্রগাঢ ।ফাইনাল পরীক্ষার ফরম ফিলাপের সময় অনেক গরীব ছাত্রছাত্রী টাকার অভাবে পরীক্ষা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে স্যার বেতন মওকুফ করে দিয়ে পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ করে দিতেন ।এই
জন্য অনেক সময় স্যার তাঁর সহকর্মীদের বিরাগভাজন হয়েছেন ।কলেজের আর্থিক অবস্থা তখন ততোটা স্বচ্ছল ছিল না ।ফলে অনেক সময় কলেজের শিক্ষকরা মাস শেষে তাঁদের বেতন পেতেন না ।কিন্তু এরমধ্যেও স্যার নিজের কথা চিন্তা না করে ছাত্রছাত্রীদের স্বার্থে মাসিক বেতন মওকুফ করতে কুন্ঠিত হতেন না । কলেজের উন্নয়নের ব্যাপারে সরকারের উর্ধতন মহলে যোগাযোগ রক্ষা
সহ তৎকালীন শিক্ষা ,অর্থমন্ত্রী ও স্থানীয় সংসদ সদস্যের আনুকূল্য আকর্ষনে তিনি যতেষ্ট পরিশ্রম করেছেন ।তাঁর সময় কালে কুলাঊড়া কলেজে প্রথম দুটি বহুতল একাডেমি ভবন নির্মিত হয়েছিল ।কলেজে সীমানা দেওয়াল নির্মান সহ খেলার মাটের উন্নয়নে তাঁর অনেক অবদান রয়েছে ।প্রতিষ্টা লগ্ন থেকে মফস্বলের একটি ছোট কলেজকে আজকের এই বিশাল প্রতিষ্টানে রূপান্তরিত করতে তাঁর যতেষ্ট ত্যাগ রয়েছে।পাশাপাশি কুলাউড়ার সার্বিক উন্নয়নে তাঁকে দেখেছি সর্বদা সরব ভুমিকা রাখতে ।শুনেছি নিজ এলাকায় সুবিধা বঞ্চিত মানুষের সাহিয্যার্থে তিনি সব সময় মুক্ত হস্তে দান করেছেন ।এলাকায় মসজিদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্টান সমুহের উন্নয়নেও তিনি ভুমিকা রেখে গেছেন।আমি যতদিন এই কলেজের ছাত্র ছিলাম ততোদিন স্যার সবসময় আমার সুবিধা অসুবিধার খবর রেখেছেন।কলেজ ছেড়ে আসার পরও যখনই স্যারের সাথে দেখা
হয়েছে কিংবা ফোনে কথা হয়েছে স্যার সর্বাগ্রে আমার ও পরিবারের খোঁজ খবর নিয়েছেন এবং আমার ছেলে মেয়েরা কি করছে কিভাবে তাদেরকে ইসলামী শিক্ষা এবং লেখা পড়ায় যত্ন নেবো সে ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছেন।
এমন একজন দায়িত্বশীল ও আদর্শ শিক্ষকের স্মৃতি ছাত্রছাত্রীদের হৃদয় থেকে কখনো হারিয়ে যাওয়ার নয় ।দোয়া করি মহান আল্লাহ তাঁকে জান্নাত বাসী করুন ।

লেখক – কলাম লেখক ও কমিউনিটি নেতা । নিউইয়র্ক ।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।