প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে বাংলার যুবক - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ২:৫২, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে বাংলার যুবক

editor
প্রকাশিত জুন ১৫, ২০২১
প্যারিসের ল্যুভর মিউজিয়ামে বাংলার যুবক

Napoleon courtyard of the Louvre museum at night time, with Ieoh Ming Pei's pyramid in the middle.

নিউজ ডেস্কঃ

প্যারিস শহরকে শিল্পী, সাহিত্যিক, গবেষকদের আপন শহর বলা হয়। এখানে রয়েছে বিশ্বের অন্যতম বিখ্যাত ও সমৃদ্ধ ল্যুভর মিউজিয়াম। ২০০ বছরে নির্মাণকাজ শেষ হয় ১২০০ সালে। ফ্রান্সের সম্রাট নেপোলিয়ানের শাসনামলে পৃথিবীর মহামূল্যবান দ্রব্যসমাগ্রী ও শিল্পসম্ভার সংরক্ষণ করা হয়।

ইতালির শিল্পী লিওনার্দো দা ভিঞ্চি ১৬ শতাব্দীতে মোনালিসা অঙ্কন করেন। ইউনেস্কো-স্বীকৃত ল্যুভর ও মোনালিসা সম্পর্কে বাংলা ভাষাভাষী পাঠকদের নতুন করে জানানোর কিছু নেই। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের অজান্তে ফ্রান্সের ল্যুভরে স্মৃতি হয়ে আছেন বাঙালি যুবক, তার নাম জামর।

গত ৩ মার্চ যুগান্তর অনলাইনে ‘বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু ফ্রান্স ও ঐতিহাসিক সম্পর্ক’ শিরোনামে ১ম পর্ব প্রকাশিত হয়। ২য় পর্বে জাদুঘরের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক কি, তা তুলে ধরা হবে।

ভারতের বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য মতে, ১৭৭৩ সালে চট্টগ্রামের উপকূলে হানা দেয় ইংরেজ দাস ব্যবসায়ীরা। একটি দলের হাতে ধরা পড়েন ১১ বছরের জামর। জাহাজে করে তাকে পাচার করা হয় আফ্রিকার দেশ মাদাগাস্কারে। সেখান থেকে এক ফরাসি দাস ব্যবসায়ীর মাধ্যমে ফ্রান্সে। বিক্রি করা হয় ফ্রান্সের তৎকালীন রাজা পঞ্চদশ লুইয়ের কাছে। পঞ্চদশ লুই জামরকে তার পত্নী মাদাম ব্যারির কাছে হস্তান্তর করেন। মাদাম ব্যারি জামরকে নিজের ছেলের মতো ভালোবেসে পড়াশোনা করার সুযোগ করে দেন। দর্শন ও সাহিত্যে চর্চায় জামরের আগ্রহ বাড়তে থাকে। তিনি গোপনে বিপ্লবী দার্শনিক ও লেখক জ্য জ্যাক রুশোর সব সাহিত্যকর্ম পড়ে ফেলেন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায়, মানুষ শুকনো কাঠ। আগুন পেলে কাঠ যেমন জ্বলে উঠে, তেমনি সুযোগ পেলে মানুষ যে কোনো সময় জ্বলে ওঠে। জামর তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। মাদাম ব্যারি জামরকে খ্রিস্টান ধর্মে শিক্ষা দেন। সম্রাটের উপাধি যুক্ত করে নাম রাখেন লুই-বেনোয়া জামর।

ফরাসি বিপ্লব বিশ্ববাসীর মুক্তির বার্তা নিয়ে আসে। ১৭৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লব শুরু হলে জামর প্রভাবশালী রাজনৈতিক সংঘ জ্যাকোবিন ক্লাবের সদস্য হন।

বার্তাবাহক হিসেবে জামরের অবদানের জন্য কমিটি অব পাবলিক সেফটির (১৭৮৯-১৭৯২) শাখার জামর সেক্রেটারীর দায়িত্ব পেয়ে সমাজের অভিজাতদের উপর নজর রাখেন।

ফরাসি বিপ্লবের পর ১৭৯৩ সালে গ্রেফতার করা হয় ব্যারিকে। আদালতে সাক্ষী হন জামর। তার জবানবন্দিতে রাজ বংশের কাউন্টেস ব্যারির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়। সেদিন আদালতে দাঁড়িয়ে আত্মপরিচয় দিয়ে বললেন, আমি আফ্রিকার নই, বাংলার চট্টগ্রামের ছেলে।

মাদাম ব্যারিকে সহযোগিতা করায় জামরকেও কারাদণ্ড দেয়া হয়। ছয় সপ্তাহ পর বিপ্লবী বন্ধুরা তাকে মুক্ত করেন। এরপর শুরু হয় জামরের একাকীত্ব জীবন। ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নেপোলিয়ান নির্বাসিত হন। তখন জামর আবার প্রকাশ্য জীবনে ফিরে আসেন। লাতিন কোয়ার্টারের কাছে প্যারিসে বাড়ি নেন। ১৮১৬ সালে জামর শিক্ষকতা শুরু করেন। কড়া মেজাজের জামর অল্পতে রেগে গিয়ে শিক্ষার্থীদের পেটাতেন। এজন্য শিক্ষকতার চাকরি হারাতে হয়।

তখনকার সময়ে কয়েকজন শিল্পী জামরের প্রতিকৃতি এঁকেছিলেন। ফরাসি নারী-শিল্পী মারি ভিক্তোয়ার লোমোয়ের আঁকা ছবি ল্যুভরে সংরক্ষিত আছে। তাতে ঘন কোকড়া চুল, পুরু ঠোঁট, উঁচু কপাল ও গাঢ় কৃষ্ণবর্ণের জামরকে কৃষ্ণাঙ্গ বলে মনে হয়। ফরাসিরা মানুষের প্রতিভা ও কর্মের স্বীকৃতি দিয়ে আসছে আদিকাল থেকে।

লোকচক্ষুর অগোচরে ৭ ফেব্রুয়ারি ১৮২০ নিঃসঙ্গ অবস্থায় জামর মারা যান।

ফরাসি বিপ্লবে জামরের অবদান হয়তো বা অতি সাধারণ কিন্তু বাংলার মাটিতে জন্ম নেয়া জামর পৃথিবীর ইতিহাস বদলে দেওয়া এক বিপ্লবের আত্মত্যাগের নাম। বিশ্ববিখ্যাত ফরাসি সাহিত্যিক লা লাস ফহ ম্যাক্সিসিমের বইয়ে সুন্দর একটি বাক্য রয়েছে- ‘অধিকার বোধ প্রেমের সঙ্গে শুরু হয়, প্রেমের সঙ্গে শেষ হয় না’।

জামর তেমনি এক ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত করেছেন জীবন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে ফ্রান্সের প্যারিস ল্যুভর জাদুঘরে মাথা উঁচু করে স্মৃতি হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন জামর।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।