বিশেষ প্রতিনিধিঃ
উপমহাদেশের স্থাপত্যকলার অন্যতম নিদর্শন কার্জন হল। এ স্থাপনাটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এদেশের মানুষের আবেগ। কার্জন হলের ইতিহাস শতবর্ষী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও পুরোনো। সাতচল্লিশের দেশভাগ, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধসহ এদেশের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের নীরব সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এ স্থাপনাটি। কার্জন হল যেন এক মৌন ভাষাসংগ্রামী ও মহান মুক্তিযোদ্ধা।
ব্রিটিশ ভারতে ভাইসরয় লর্ড কার্জনের নামানুসারে এ ভবনটি টাউন হল হিসেবে নির্মিত হয়। ১৯০৪ সালে লর্ড কার্জন এর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। পরের বছরই বাংলাকে বিভক্ত করা হয় এবং ঢাকা হয় নতুন প্রদেশ পূর্ববঙ্গ ও আসামের রাজধানী। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ হলে এটি ঢাকা কলেজ ভবন হিসেবে ব্যবহূত হতে থাকে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে কার্জন হল এ প্রতিষ্ঠানের ভবন হিসেবে ব্যবহূত হয়। বর্তমানে এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান ও জীববিজ্ঞান অনুষদের কিছু শ্রেণিকক্ষ ও পরীক্ষার হল হিসেবে ব্যবহূত হচ্ছে।
কিন্তু এটি নির্মাণ করা হয়েছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন উদ্দেশ্যে। কার্জন হলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বঙ্গভঙ্গের ইতিহাস। ব্রিটিশ সরকার যখন বঙ্গভঙ্গ করার পরিকল্পনা করছিল, তখন ঢাকা হওয়ার কথা ছিল পূর্ব বাংলার রাজধানী। সে সময় ঢাকায় তেমন কোনো ভালো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কিংবা সরকারি স্থাপনা ছিল না। ঢাকার গুরুত্ব বুঝতে পেরে ব্রিটিশরা ঢাকায় বেশ কিছু স্থাপনা নির্মাণ অনুমোদন করে। তার মধ্যে কার্জন হল অন্যতম।
প্রত্নতত্ত্ববিদ আহমাদ হাসান দানী লিখেছেন, কার্জন হল নির্মিত হয়েছিল টাউন হল হিসেবে। তবে শরীফ উদ্দীন আহমদ এক প্রবন্ধে বলেছেন, এ ধারণাটি ভুল। তার মতে, এটি নির্মিত হয়েছিল ঢাকা কলেজের পাঠাগার হিসেবে। তার মতে, এটি নির্মাণের জন্য অর্থ প্রদান করেন ভাওয়ালের রাজকুমার।
১৯০৪ সালের সাপ্তাহিক ঢাকা প্রকাশে লেখা হয়, ‘ঢাকা কলেজ নিমতলীতে স্থানান্তরিত হইবে। এই কলেজের সংশ্রবে একটি পাঠাগার নির্মাণের জন্য সুযোগ্য প্রিন্সিপাল ডাক্তার রায় মহাশয় যত্নবান ছিলেন। বড়লাট বাহাদুরের আগমন উপলক্ষ্যে ভাওয়ালের রাজকুমারগণ এ অঞ্চলে লর্ড কার্জন বাহাদুরের নাম চিরস্মরণীয় করিবার নিমিত্তে কার্জন হল নামে একটি সাধারণ পাঠাগার নির্মাণের জন্য দেড় লক্ষ টাকা দান করিয়াছেন।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম এলেই নাম চলে আসে ঐতিহাসিক কার্জন হলের। ঢাকার অন্যতম শ্রেষ্ঠ স্থাপত্য হিসেবে বিবেচিত এ ভবনটিতে সংযোজিত হয়েছে ইউরোপ ও মোগল স্থাপত্য রীতির দৃষ্টিনন্দন সংমিশ্রণ। ঐতিহাসিক শিল্পের সঙ্গে মিশ্রিত হয়েছে আধুনিক কারিগরি বিদ্যা। মোগল ধাঁচের খিলান ও গম্বুজে প্রকাশ পায় পাশ্চাত্য ও ইসলামিক স্থাপত্য। আংশিকভাবে মুসলিম স্থাপত্যরীতিও ফুটে উঠেছে। ভবনের বাইরের অংশে গাঢ় লাল রঙের ইট ব্যবহার করা হয়েছে। কিছুটা দূর থেকে এর দৃষ্টিনন্দন খিলান ও গম্বুজগুলো দেখতে চমৎকার দেখায়।
কারুকার্যখচিত দৃষ্টিনন্দন এ ভবনে রয়েছে একটি বিশাল কেন্দ্রীয় হল। ভবনটির সামনে রয়েছে একটি প্রশস্ত বাগান, যেখানে সবুজের বুক চিরে পশ্চিম থেকে পূর্বে চলে গেছে একটি সরু রাস্তা। এর পেছনে রয়েছে একটি বিশাল পুকুর, যার পশ্চিম পাড়ে শেরেবাংলা ফজলুল হক হলের মূল ভবন।
কার্জন হলের রং লাল হওয়ার পেছনে একটি কথা প্রচলিত রয়েছে। এ স্থাপনায় ইউরোপীয় ও মোগল স্থাপত্যরীতির সম্মিলন ঘটেছে। মোগল সম্রাট আকবরের ফতেহপুর সিক্রির দিওয়ান-ই-খাসের অনুকরণে লাল বেলেপাথরের পরিবর্তে ব্রিটিশরা গাঢ় লাল ইট ব্যবহার করেছে। এ স্থাপনার মাধ্যমে ব্রিটিশরা প্রমাণ করতে চেয়েছে উপমহাদেশে তাদের অবস্থান আকবরের মতো। কেননা একমাত্র আকবরকেই তারা শ্রেষ্ঠ ও যোগ্য মোগল শাসক হিসেবে স্বীকার করত।
পুরো ঢাকায় কার্জন হলের সমকক্ষ ঐতিহাসিক স্থাপনা খুব কমই রয়েছে। কার্জন হল একমাত্র স্থাপনা, যা তার প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখনও রূপরস ধরে রেখে রেখেছে। এক শতাব্দীর বেশি সময় ধরে এ স্থাপনা যেন চিরযৌবনা হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাংলার প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামের সাক্ষী কার্জন হল। ভাষা আন্দোলনের জ্বলজ্বলে স্মৃতি নিয়ে কার্জন হল দাঁড়িয়ে আছে। ১৯৪৮ সালে যখন পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এখানে ঘোষণা দেন, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, তৎক্ষণাৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা প্রতিবাদ করেন। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে এ হলের ভূমিকা অপরিসীম। সে সময়ে সব আন্দোলন-সংগ্রামের আঁতুড়ঘর ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণ কার্জন হল। একইভাবে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসেও কার্জন হলের নাম স্মরণীয় হয়ে রয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণভোমরা এ স্থাপনাটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি অন্যান্য দর্শনার্থীর জন্যও একটি আকর্ষণীয় স্থান। ব্রিটিশ স্থাপত্যের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই এখানে অসংখ্য মানুষ ভিড় জমায়। নানা ধরনের সামাজিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের আড্ডা ও পদচারণায় স্থানটি মুখর থাকে। সারাক্ষণ প্রাণচঞ্চল থাকা এ ভবনের পাশেই রয়েছে ফজলুল হক মুসলিম হল ও শহীদুল্লাহ হল। মাঝে এক মনোরম পুকুর স্থাপত্যটিকে দিয়েছে আলাদা আকর্ষণ।
ইতিহাসবিদ মুনতাসীর মামুন সমকালকে বলেন, কার্জন হল ঢাকার স্থাপত্যকলায় একটি বিশেষ অট্টালিকা। এর আগে ঢাকায় এই ধাঁচের কোনো অট্টালিকা তৈরি হয়নি। সবুজ নিসর্গময় পরিবেশে এই ইমারত তৈরি করা হয়। এতে ভারতীয় স্থাপত্যকলার সকল রীতির মিশ্রণ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোনো ইমারত এমন বৈশিষ্ট্য ধারণ করে না। তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রধান কেন্দ্রই ছিল এই কার্জন হল। এটি এখনও তা-ই আছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ের ল্যান্ডমার্ক হলো কার্জন হল।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।