সময় অসময় ১৬ - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ১২:২৪, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

সময় অসময় ১৬

banglanewsus.com
প্রকাশিত জুলাই ২৮, ২০২১
সময় অসময় ১৬

মীর লিয়াকত::

খবরের কাগজ খুললে পাওয়া যায় বাল্যবিবাহের নানা খবর। এর লাগাম টেনে ধরা যাচ্ছে না কোনোভাবেই। করোনাকালে বেড়েছে আরো। এমন একটি খবর পড়ছিলাম। পত্রিকা পড়তে পড়তে টেলিভিশনের খবরের দিকে মনোযোগ দিতেই দেখলাম বারো বছর থেকে বিশ বছর পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা হতাশায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছে। শুনেই শিউরে উঠলাম। শিক্ষার্থীরা করোনার ভয়াবহতায় পড়াশুনা ঠিক মতো করতে পারছে না, যাচ্ছে না শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে। তারা এখন বলতে গেলে ঘরবন্দী। খেলাধুলা বন্ধ, মিশতে পারছে না বন্ধুবান্ধবদের সাথে, এমনকি বন্ধুবান্ধবদের সাথে দেখাই হচ্ছে না কখনো। শিক্ষকদের সান্নিধ্য থেকেও তারা বঞ্চিত। ছোটকাল থেকে তারা যে পরিবেশে বড় হচ্ছিলো তার প্রায় ছিঁটেফোঁটাও বলতে গেলে এখন আর নেই। তার ওপর অবিভাবকরা বাধ্য হয়ে পড়ার চাপে রাখতে চাচ্ছেন। সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন যাবৎ বন্ধ রেখেছেন। বন্ধ না রেখে উপায়ও নেই। সবার আগে এই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কোন সুযোগই নেই। পরিস্থিতি একটু উন্নতি হলেই সরকার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার চিন্তাভাবনা করার সাথে সাথেই পরিস্থিতির ক্রমাবনতি শুরু হয়। বার বার খোলার সিদ্ধান্ত নিতে গেয়ে সরকার ভয়াবহ অবস্থার আশংকায় আবার পিছিয়ে আসতে বাধ্য হচ্ছে। এটা ঠিক যে সরকারের এই সিদ্ধান্ত যথাযথ। যদি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা রাখা হতো তাহলে এতোদিনে পরিস্থিতি হতো আরো ভয়াবহ যা কোনো অবস্থায় নিয়ন্ত্রন সম্ভব হতো না। কিন্তু শিক্ষার্থীদের এই প্রেক্ষাপটে হতাশার মাত্রা বেড়েই চলেছে। কোন পথ না দেখে তারা আত্মহননের পথ বেছে নিচ্ছে। কিছু বুঝে না বুঝেই তারা আত্মহত্যার মতো এই ভয়াবহ পথ বেছে নিচ্ছে। করুনতম এই খবরটি শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেলো। ভারাক্রান্ত মনে আবারো চোখের সামনে পত্রিকা তুলে ধরে বাল্যবিয়ে সংক্রান্ত খবরে মনোনিবেশ করলাম।
আসলে এখনো কেউ জানে না বা হলফ করে বলতে পারবেন না বৈশি^ক এই ভয়াবহ অতিমারী করোনার করাল গ্রাসের ইতি কবে হবে কিংবা আদৌ হবে কি না! করোনাকালে চৌদ্দ হাজার বাল্যবিয়েÑ আর এই বিয়ে যদি এভাবে বেড়েই চলে তাহলে কি হতে পারে পরিস্থিতি? এ ব্যাপারে বহু অবিভাবকের নানা যুক্তি! কেউ কেউ বলছেন এই সময়টায় বিয়ের কাজটা সেরে ফেলাই উত্তম। এটাই নাকি ভালো সময়। তারা বলতে চান এর কারন বহুবিধ। প্রথমত এই সময় মেয়েদের পড়াশুনা বন্ধ রয়েছে, কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তারও কোনো নিশ্চয়তা নেই্। শিক্ষামন্ত্রী বলছেন এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা এ বছর আদৌ হবে কি না পরিস্থিতিই কেবল তা বলে দিতে পারে। এক কথায় পরিস্থিতির কোনো উন্নতি না হলে এসসি কিংবা এইচএসসি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার প্রশ্নই অবান্তর। দ্বিতীয়ত: অহেতুক মেয়েদের ঘরে বসিয়ে না রেখে বিয়ে দিয়ে দেয়াই সর্বোৎকৃষ্ট সিদ্ধান্ত বলে মনে করেন অনেক অবিভাবক। তৃতীয়তঃ এখন এই সময় বিয়ের কাজটা সেরে ফেলতে পারলে সীমিতভাবে কয়েকজনকে ডেকে সমাধা করায় কোনো সমস্যা নেই। এতে আর্থিক দিক দিয়ে তারা বেঁচে যাবার সুযোগ পাচ্ছেন, এটা হাতছাড়া করার কোনো মানে হয় না। আসলে এখন বাল্যবিয়ে এমন হয়েছে যে ছেলে পাওয়া গেলে এখন আর কোনো দিকে ভ্রƒক্ষেপ করে সময় নষ্ট কেউ করতে চান না। ছেলে দেখা শেষ হলে এবং কথাবার্ত পাকা হলেই প্রায় বিনা খরচেই মেয়ে তুলে আনা সহজ। আর আচার অনুষ্ঠান এমনিতেই ক্রমে সংক্ষিপ্ত হয়ে আসছে। করোনাকালে তো এসবের সুযোগই নেই। কেউ পছন্দও করছেন না। বাল্যবিয়ে যে আইনের চোখে অপরাধ সেটা মনে রেখে কৌশলে অবিভাবকরা দৃষ্টির আড়ালেই কাজ সেরে নিতে আগ্রহী। এখানে আবার লাভালাভির বিষয়ও রয়েছে। নিরিবিলি লোকচক্ষুর অন্তরালে কাজ সমাধা করতে গিয়ে প্রচলিত যৌতুকের বিষয়াবলীও সেভাবে অনেকক্ষেত্রে সামনে আসছে না। সবচেয়ে বড় বিষয়টি হচ্ছে করোনাকাল আর্থিক দৈন্যতায় যারা ভুক্তভোগী তাদের জন্য বাল্যবিয়ের সুযোগ শাপে বর। যে যাই-ই বলুক করোনার ফলাফলে দেশে বেকারত্ব বেড়েই যাবে। এখন দৃশ্যমান না হলেও পরবর্তী সময়ে তা স্পষ্ট হবেই, একথা সহজেই অমুমেয়। বহু মানুষ কাজ হারিয়েছে। মানুষ একের পর এক পেশা বদল করছে। একটি দোকানে গেলে দেখা যেতো আট দশজন সেলস ম্যান সামাল দিতে পারছে না। ২০২০ সাল থেকে ২০২১ সালের মধ্যে একটু লক্ষ করলে দেখা যাবে সেই দোকানে সেলসম্যান দুতিনজনের বেশি নেই। এমনকি মহাজন বা মালিক নিজেই দোকানের সেলসম্যানের কাজে ব্যস্ত রয়েছেন বাধ্য হয়ে। কারন মাস শেষ হলে বেচাকেনার হাল দেখে সেলসম্যান পুষলে মাসোহারা, বোনাস ইত্যাদি দেয়া অসম্ভব। দোকানে জ¦ালাতে হবে লালবাতি! অনেকে বন্ধ করে দিয়েছেন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান। কেউ কেউ ব্যবসার ধরন পাল্টে নিচ্ছেন।
দরিদ্র জনগোষ্ঠীই এখন যাঁতাকলে। তারা বাল্যবিয়েকে মনে করছেন জরুরী দায়িত্ব পালন। অভাবের তাড়নায় মেয়ের জন্য কোনো সুযোগ পেলেই তারা আর হাতছাড়া করতে চান না। ভাবখানা, অন্তত একটা মহাচাপ থেকে তো রেহাই পাওয়া গেলো! বলা হয় স্থানীয়ভাব সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। সচেতনতা বৃদ্ধিই সবচেয়ে উত্তম পথ এটা অস্বীকরের উপায় নেই। কিন্তু এক্ষেত্রে সচেতনতাও হোঁচট খায়। কেউ কেউ সচেতনতা সৃষ্টির আহŸানের জবাবে বলে বসেন,
‘ঠিক আছে, মেয়ে বিয়ে দেবো না। আমাকে কাজ দিন, আমি বেকার! মেয়েকে খাওয়াবো কি, পরিবার কিভাবে প্রতিপালন করবো আমাকে বলে দিন।’
এরকম প্রশ্ন এলে সচেতন হবার আহŸাকারীকে বিব্রত হতেই হবে। সর্বাগ্রে তার প্রশ্নের উত্তরে যেতে হ্েব। সেই প্রশ্নের উত্তর দেয়া কি সম্ভব? কোনো ব্যবস্থা তাৎক্ষনিকভাবে নেয়া কি সম্ভব? সম্ভব যদি হয় তাহলে তো ভালো কথা, আর না হলে কিভাবে তাকে সচেতন করা যাবে? ক্ষুধা যেখানে কথা কয়, আইন তো সেখান বোবা, পড়ে থাকে মুখ থুবড়ে।
কোভিড- ১৯ এর শুরু থেকে ‘সচেনতাসৃষ্টি’ বিশ^ব্যপী একটি বহুল প্রচারিত শব্দ। বিশেষজ্ঞরা এই শব্দের ওপরই জোর দিয়েছেন সবচেয়ে বেশি। স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা অর্থ্যাৎ হাতধোঁয়া, সামাজিক দুরত্ব মেনে চলা, মাস্ক পড়া এর সাথে এসেছে সচেতনতা বৃদ্ধি। সচেতনতা সৃষ্টি হলে কোভিড এর ভয়াবহতা বহুলাংশে কমে আসবে। কিন্তু উন্নত বিশে^ই তা সম্ভব হচ্ছে না আর আমাদের দেশে তা যেন সত্যিই সুদূরপরাহত। কে কার কথা শোনে? সরকার চেষ্টা করছে কিন্তু সরকারের কথা শুনতে যেন সবাই নারাজ। প্রত্যেকের সাথে তো আর একজন করে পুলিশ মোতায়েন সম্ভব নয়। লক ডাউনের সময় একজন লোককে দেখেছি একটা পান খাবার জন্য দোকানে যেতে একজন পুলিশকে কাকুতি মিনতি করছে। অগত্যা পুলিশটি নাছোড়বান্দা বৃদ্ধলোকটিকে বোঝাতে না পেরে বললো,
‘লকডাউন চলছে, কোনো দোকানই তো খোলা নেই, পান খাবেন কি করে?’
বৃদ্ধ বললো,
‘আপনি যেতে দিলেই খেয়ে আসতে পারবো। দোকান বন্ধ থাকলেও দোকানের পেছনের দরজা খোলা থাকে, আমি খেয়েই চলে আসবো। আপনাদের যন্ত্রনায় সামনের দরজা ওরা বন্ধ করে রাখে।’
প্রসঙ্গত বলছি, আমার মনে আছে একবার খালেদা জিয়া পলিথিন নিষিদ্ধ করেছিলেন। গিয়েছিলাম সিলেটের শমশেরনগর বাজারে। একজন বয়োবৃদ্ধ লোককে পলিথিনে করে ছোট চিংড়ী মাছ বহন করতে দেখে তার প্রতিক্রিয়া জানার জন্য আঞ্চলিক ভাষায়ই বললাম,
‘ চাচা, ইটা তো নিষিদ্ধ, আইনত আপনার ইটা ব্যবহার করা ঠিক নায়।’
তিনি কটমট করে আমার দিকে তাকিয়ে তার ভাষায় বললেন,
‘হুনো বা সম্বাদি, হারা দেশ লুটিয়া খাইরা হকলে, আর আমার দশ টেকার ইছার গুড়ায় দোষ করি লাইছে। আমি কিতা অউ কয়টা মাছ পকেটো লইয়া যাইতামনি? না দশ টেকার মাছোর লাগি বিশ টেকাদি পাটোর বস্তা কিনতাম! হক্কল আইনে আমার ইছার গুড়ারে ধরি লাইছে। আমারে আইন দেখাইও না।’
আমি বললাম,
‘এটা তো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর! আইনের উর্দ্ধে তো কেউ নয়। তাই আইন তো মেনে চলা দরকার।’
এবার হঠাৎ চটে উঠলেন বৃদ্ধ! বললেন,
‘আতো লাঠি দেখছনি, সম্বাদিগিরি ছাড়াইলাইমু কইলাম।’
বেগতিক দেখে আমি আর কোনো কথা বাড়াতে সাহস করলাম না। কথা বাড়ালেই যে তিনি হাতের লাঠি ব্যবহার করে বসতে পারেন তা নিশ্চিতই বুঝলাম। মানে মানে কেটে পড়লাম! এই হলো অবস্থা।
যাক সে কথা! বলছিলাম বাল্যবিয়ে ও শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যা নিয়ে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সচেতনতা সৃষ্টি করা দুরুহ হলেও এটা করতে হবে। এসব সংকটকালে সচেতনতাসৃষ্টি বাল্যবিয়ে বিরোধী জনমত সৃষ্টিই সবচেয়ে উৎকৃষ্ট পথ। কিন্তু এটা আবার জবরদস্থি করেও ভালো ফল পাওয়া যাবে বলে মনে হয় না। দারিদ্রকেই বাল্যবিয়ের প্রধান কারন বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাই দারিদ্র থেকে উত্তরণ ঘটানো সম্ভব না হলে সচেতনতাসৃষ্টি বলি আর জনমত সৃষ্টি বলি সকলি হবে গরল ভেল!
একটি গবেষণায় দেখা গেছে করোনা কালে তেরো শতাংশ বাল্যবিয়ে বাড়লেও আসলে গত পচিশ বছরে বাল্যবিয়ের হার সর্বোচ্চ পর্যায়ে। করোনাকালের বেড়ে যাওয়ার প্রধান কারন অবিভাবকদের আয় কমে যাওয়া এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা। এখানে বলা আবশ্যক আমরা খবরের কাগজে বিভিন্ন স্থানে সরকারী বিভিন্ন উদ্যোগের কথাও দেখি। খবর পেলে সরকারী সংশ্লিষ্ট বিভাগ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করেন। কিন্তু আশংকার কথা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় এসব বাল্যবিয়ের বেশির ভাগই সংঘটিত হয়ে আসছে লোকচক্ষুর অন্তরালে, অতি গোপনে। এই গোপনীয়তা এমনভাবে সুরক্ষা করা হয় যে দুতিন বছর যাবার পর বিষয়টি জানাজানি হয়। তখন আর এই ব্যাপরে কিছুই করার থাকে না। কেউ আর মনোযোগিও হন না। দারিদ্র এবং একই সাথে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান লাগাতার বন্ধ থাকা বাড়িয়ে দিচ্ছে হতাশা আর আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়া। সাধারনভাবে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশুনা দৈনন্দিন বাড়ির কাজ কিংবা পরীক্ষার প্রস্তুতি এসব নিয়ে ব্যস্ততার কারনে সহসা হতাশা তাদের মনে বাসা বাঁধতে পারে না। এসময় অবিভাবকের চাপ থাকলেও তাতে কোনো সমস্যা হয় না। কিন্তু করোনাকালে প্রেক্ষাপট ভিন্ন্। দারিদ্রের কষাঘাতে কিংবা অভাবের তাড়নায় অবিভাবককে ব্যস্ত থাকতে হয়, শিক্ষার্থীদের প্রতি সেভাবে খেয়াল নজর নেয়াও সম্ভব হয় না। এই সুযোগে হতাশাগ্রস্থ শিক্ষার্থীরা খেলাধুলা, সহপাঠি বন্ধুদেরও মিস করে। আর অনলাইন কোচিং এর সুবিধা কতোজন শিক্ষার্থী গ্রহন করতে পারে? এখানেও রয়েছে নানা সমস্যা। তাই মানসিকভাবে তারা ভেঙ্গে পরে বুঝে না বুঝে আত্মহণনের ভয়াবহ পথ বেছে নেয়।
উপায়ন্তর না দেখে অবিভাবকরা বাল্যবিয়ের ব্যাপারে বাধ্য হয়ে উৎসাহিত হন এবং পরিস্থিতির লাগাম টেনে ধরতে চান। এই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসতে হলে সরকারী সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে সামাজিকভাবে পরিকল্পিত উদ্যোগ দরকার। সবার সম্মিলিত দৃষ্টি এদিকে নিবদ্ধ করা না হলে অবস্থার অবনতি রোধ করা সম্ভব হবে না।

মীর লিয়াকত: লেখক-সাংবাদিক।

 

 

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।