ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি প্রবহমান নদীর মতো। জাতি, কাল, ভাষা, ধর্মভেদে ঐতিহ্য সংস্কৃতি ভিন্ন হয়ে থাকে। বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি মূলত গ্রামীণ মানুষের আচার-আচরণ, বিশ্বাস, মনন-রুচি, ধ্যান-ধারণার ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে। বাংলার লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি বৈচিত্র্যমণ্ডিত ও বর্ধমান। লোকসংস্কৃতির মাধ্যমেই অতীতকালের মানুষের সুখ-দুঃখ, চিন্তাধারা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য, জাতিগত উপাদান প্রকাশ পায়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আমরা আমাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি থেকে দূরে সরে যাচ্ছি। আধুনিকতার ছোঁয়া আমাদের সমাজ ও পরিবেশকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। নগরায়ন, প্রযুক্তি নির্ভরতায় হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের হাজার বছরের গড়ে ওঠা লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। নগরায়নের ফলে গ্রামীণ মানুষ নগরকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। ফলে খুব সহজেই তারা নগর সংস্কৃতি দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছে। ইংরেজ শাসনের মধ্য দিয়ে বাংলার মানুষ আধুনিকতার ছোঁয়া পেতে শুরু করলেও মানুষ লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি চর্চা করত। কিন্তু বিশ্বায়নের ফলে যে আধুনিক সমাজ তৈরি হচ্ছে তার সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
সময় যত গড়িয়েছে, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির উপাদানগুলোও হারাচ্ছে। সেখানে জায়গা করে নিচ্ছে আধুনিক সব সাজসজ্জা ও জীবনযাত্রা। আমরা অতীতের সঙ্গে বর্তমানকে তুলনা করলেই বুঝতে পারি এর ব্যাপকতা। এককালে বাংলা ছিল লোকজ সাহিত্যে পরিপূর্ণ। বাংলায় ধাঁধা, মন্ত্র, প্রবাদ-প্রবচন, লোকগাথা, লোকসংগীত, লোককাহিনির প্রচলন ছিল। আর এসব তৈরি হতো গ্রামীণ মানুষের সুখ-দুঃখ, ধ্যান-ধারণা, বিশ্বাসের ওপর। প্রযুক্তির ব্যবহার লোকজ সাহিত্যের ওপর প্রভাব বিস্তার করছে। গ্রামীণ অঞ্চলে লোকসংগীতের প্রচলন ছিল। যা অঞ্চলভেদে ভিন্নতা দেখা গেলেও এগুলোতে মিশে আছে বাংলার প্রকৃতি, মানবপ্রেম, সরলতা, সুখ-দুঃখের কথা। জারি, সারি, ভাটিয়ালি, ভাওয়াইয়া, মুর্শিদী, মারফতি, বাউল, গম্ভীরা, কীর্তন, ধামালি প্রভৃতি গান। এখন এসব গানের জায়গায় স্থান করে নিচ্ছে আধুনিক রক, হিন্দি, ইংরেজি গান।
লোকজ খেলাধূলা বৈচিত্র্যময়। লাঠিখেলা, বউচি, টোপাভাতি, কানামাছি, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, নৌকাবাইচ, পুতুলখেলা, মার্বেল খেলা প্রভৃতি। এসব জায়গায় স্থান পেয়েছে ক্রিকেট, ফুটবল, ভলিবল, ব্যাডমিন্টন। উন্নত প্রযুক্তির ফলে শিশু-কিশোররা নানা রকম মোবাইল গেমে (পাবজি, ফ্রি-ফায়ার) আসক্ত হয়ে পড়ছে। আধুনিকতায় সাজ পোশাকে এসেছে আমূল পরিবর্তন। গ্রামীণ মেয়েদের প্রধান পোশাক ছিল শাড়ি আর পুরুষরা লুঙ্গি, ধুতি পরত। আর এই শাড়ি, লুঙ্গিকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছিল তাঁতশিল্প। বর্তমানে ছেলেমেয়েরা ওয়েস্টার্ন পোশাকে বেশি স্বাচ্ছন্দবোধ করে। শাড়ি-লুঙ্গির বদলে স্থান করে নিয়েছে টপস, জিন্স, গেঞ্জির মতো পোশাক।
গ্রামবাংলায় আবহমান কাল থেকেই নানা রকম আনন্দ অনুষ্ঠান ও উৎসব পালিত হয়। আর এই উৎসব বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তুলে ধরে। বাংলার গ্রামীণ জনগোষ্ঠী নানা আয়োজনের মাধ্যমে বরণ করে বাংলা মাসের প্রথম দিন। পহেলা বৈশাখ মানেই মেলা। মেলার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। আর এই মেলাগুলোতে ছিল লোকজ সংস্কৃতির বিশাল সমাহার। মেলায় থাকত আকর্ষণীয় সব জিনিস আর খাবার। থাকত নানা খেলার আয়োজন। মাটির তৈজসপত্র, মুড়ি-মুড়কি, মণ্ডা-মিঠাই, টেপাপুতুল ছিল মেলার প্রধান আকর্ষণ। কুমারদের হাতে বানানো শখের হাঁড়ি মেলার সৌন্দর্যকে বাড়িয়ে তোলে। বর্তমানেও মেলার আয়োজন করা হয় এবং হাজির করা হয় লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি। কিন্তু আগের গ্রামীণ মেলার মতো জৌলুস নেই। কিছুটা দুধের স্বাদ ঘোলে মেটানোর মতো। লোকসংস্কৃতির অনেক উপাদানই বিলুপ্তপ্রায়। শখের হাঁড়ি, দারুশিল্প, নকশিকাঁথা, শীতলপাটির মতো আরো অনেক জিনিসের জায়গায় আধুনিক সব দ্রব্য।
লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি আমাদের পরিচয়, আমাদের অহংকার। এই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি যেন হারিয়ে না যায়। লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি ছাড়া বাঙালি শিকড়হীন পরগাছার মতো। নতুন প্রজন্মকে আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতে হবে। তাদের মাধ্যমেই যেন আমরা আমাদের লোকজ ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি নতুন মাত্রা যোগ করে বিশ্বদরবারে আমাদের স্থায়ী অস্তিত্ব জানান দিতে পারি।