বানিয়াচঙ্গ রাজ বাড়ি নিয়ে অনেক কাহিনি আবর্তিত হয়েছে আমার, ‘ঐতিহাসিক বানিয়াচঙ্গের ইতিহাস কিংবদন্তি’ গ্রন্থে । এক সময় এই বাড়ির রাজারা এতই শক্তিশালী ছিলেন যে, জীবিত কোন কাক পর্যন্ত এই বাড়ির উপর দিয়ে যেতে পারেনি। তারা যেমন শাসন করেছেন তেমনি সোহাগও করছেন, দান করেছেন প্রচুর ভূ-সম্পত্তি।
বাড়িতে ছিল শত শত চাকর চাকরানী। বাড়িতে থাকতো হাতি-ঘোড়া সহ নানা পশু পাখি। তখন ২৮টি খন্ড রাজ্য বা পরগণা ছিল তাদের দখলে। বারো ভূইয়ার অনেকেই মোঘলদের কাছে বশ্যতা স্বীকার করলেও বানিয়াচঙ্গের দেওয়ান আনোয়ার খাঁ, তার ভাই হোসেন খাঁ বশ্যতা স্বীকার করেননি উপরন্তু মোঘলদের অনেক সেনাপতিকে বানিয়াচং এনে বন্দী করে রেখেছিলেন।
ঐতিহাসিকদের মতে, গোবিন্দ সিংহ (অর্থাৎ দেওয়ান আনোয়ার খাঁর দাদা) বনামে হবিব খাঁ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে ২৮ টি সম্প্রদায় নিয়ে (আনু) ১৫৫৬ সালে রাজধানী বানিয়াচঙ্গে আগমন করেছিলেন। তখন থেকেই রাজাদের নামে ও সম্প্রদায়ের নামে বিভিন্ন পাড়া, মহল্লার নামকরণ করা হয়েছিল।
রাজা তখন প্রজাদের ভালোবেসে জমি ও পদবী বন্টন করে দিতেন বলে অনেক তথ্য উপাত্তে পাওয়া যায়। রাজার প্রভাবশালী ব্যক্তিরা তখন যে এলাকায় বাস করতেন তাদের নামে, অনেক পাড়া মহল্লার নামকরণও করা হয়। কালের বিবর্তনে সবকিছুই আজ চক্রাকারে আবর্তিত হচ্ছে।
যাক মূল কথায় আসি।
অনেকদিন আগে বাংলা একাডেমি কর্তৃক প্রকাশিত হবিগঞ্জের লোক গবেষক দেওয়ান গোলাম মর্তুজা সাহেবের সম্পাদিত ‘সিলেটের প্রচলিত পই- প্রবাদ ডাক- ডিঠান’ গ্রন্থ পড়ার সুযোগ হয়েছিল। এ গ্রন্থে একটি কিংবদন্তি উল্লেখ করা হয়েছে।
লেখকের ভাষ্য থেকে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো, বানিয়াচঙ্গের মতান্তরে সরাইলের এক দেওয়ান একবার কিছু লোক লস্কর নিয়ে নৌকা সাজিয়ে ভ্রমণে গিয়েছিলেন, (ঘটনাটি সরাইল নয় বানিয়াচঙ্গের রাজারই হওয়া স্বাভাবিক, কারণ, লেখকের বাড়ি যেহেতু হবিগজ্ঞ জেলা এবং গ্রন্থটির তথ্য উপাত্ত সংগৃহিত, সিলেট তথা হবিগজ্ঞ থেকে, কৃষকের ভাষা ও হবিগঞ্জ অঞ্চলের, তাই আমরা এই কাহিনীকে বানিয়াচঙ্গের রাজার কাহিনী বললে অযুক্তিক হওয়ার কথা নয়।
নদীর কিনারে যেতে যেতে বেশ দূরে, নৌকার সামনে চেয়ারে বসে দেওয়ান সাহেব অনেক সৌন্দর্য উপভোগ করছিলেন। এক সময় দেখতে পেলেন এক বিরাট হাওড়। দূরে এক লোক (কৃষক) হালচাষ করছে। সুন্দর নৌকা নজরে পড়তেই কৃষক গরু রেখে দৌড়ে নৌকার দিকে এগিয়ে আসছে, এমন সময় রাজা নায়েবকে বললেন,‘নৌকা নোঙ্গর কর।
লোকটা দৌড়ে এগিয়ে আসছে , দেখি কি বলে, কোনো নালিশ বা দাবি দাওয়া কি-না’।
দৌঁড়ে আসতে গিয়ে কৃষক দুবার হোঁচটও খেয়েছে। দেওয়ান সাহেব বিস্মিত হলেন, কাছে এসে কৃষক বেচেরা বোকার মতো একপলকে তাকিয়ে রইলো। দেওয়ান সাহেব বললেন, ‘আরে হা করে কি দেখসিছ’? এবারে সম্বিৎ ফিরে পাওয়ার মতো কাচু মাচু করে বললো, আ-প-নে রে।
হুজুর, জনম (জন্ম) সারথক (সার্থক) চোখ ভইরা (জুরিয়ে) গেছে। আমি জীবনেও রাজা (দেওয়ান) দেখিনি, নায়েব বললো, হ্যাঁ। কৃষক আকাশের দিকে চেয়ে হাসছে, রাজা অবাক হলেন। কৃষক বললো, মাইনষেরে কইতাম পারমু, দেয়ান সাব-চোখ মুখ আমরার মতন ই -নাক চৌখ মুখ আছে।
দেওয়ান সাহেব হাসলেন। বললেন, ‘তুই দেওয়ান সাব দেখছিছনা’? দু’হাত কচলিয়ে বিনীতভাবে কৃষক বললো, ‘না হুজুর, কই পাইমু, দেয়ান সাব দেখতাম। থাকি এই মুল্লুখো’ দেওয়ান সাহেব আবার বললেন, ‘তোর বাড়ি কই’,
কৃষক হেসে গর্ব করে বললো, ‘দেওয়ান সাবের পুটকি মার’।
শুনে দেওয়ান সাহেব রাগে লাল হয়ে গেলেন, গর্জে উঠে বললেন,‘আরে কমিন, কম বখত এ এ সব বলে কি’?
কৃষক বললো, ‘হুজুর মিছা না, হাছাওই কইছি’।
ভীষণ রেগে গিয়ে দেওয়ান সাহেব হুকুম করলেন,‘বেয়াদবকো পাকাড়কে লে আও’ সাথে সাথে পাইক পেয়াদারা টেনে হিছড়ে নিয়ে আসতে লাগলো, কৃষক বেচারা, দোয়াই দিলে মাতম জুড়ে দিল, ‘বললো, আমিত দেয়ান সাবরে হালা বাঞ্চত কুচতা কইছিনা, তাইন যেমন জিকাইছইন হমন জোয়াব দিছি’। নৌকায় তুলে কিছু উত্তম মধ্যম লাগাবে, এমন সময় সবাইকে সামলিয়ে দেওয়ান সাহেব তহশীলদারকে ডাকলেন, জি হুজুর, দেখতো, এই হাওরের নাম কি।
ওরা খাজনা দেয় কিনা ? দেখছি হুজুর, কিছুক্ষণ পর তহশিলদার বললো, এই হাওরের নাম, ফুটকি-মার। শুনে দেওয়ান সাহেব অবাক, জানতে চাইলেন, আয়-ব্যয় উসুল তহশীল কেমন, হুজুর এটা বিরাট হাওড়, তবে ফসল হয়না, ফুটকি ঘাসের জন্য এখানে কেহ চাষাবাদ করেনা। তবে ওই ঘাস উজার করে পতিতকে উতিত করার শর্তে প্রজাদের লাখেরাজ দেওয়া হয়। ফসলযোগ্য হলে পরে খাজনা ধার্য করা হয়ে থাকে। এছাড়া দূর দূরান্ত হওয়ায় আমাদের লোকও সেখানে যেতে পারেনা। ফলে এর সদর জমা রাজস্ব খাজনা আমাদের কেই ভর্তুকি দিতে হয়।
দেওয়ান সাহেব কিছু সময় চিন্তা করলেন, এদিকে কৃষক লোকটা কিছু বুঝতে না পেরে দেওয়ান সাহেবের পায়ে পড়ে কেঁদেকুটে অস্থির। পা ধরে বার বার প্রাণ ভিক্ষে চাইছে। তাকে যতই বুঝানো হচ্ছে সে ততই ভয় পাচ্ছে। তার মনে তাকে ধরইর নিয়ে কি জানি করে ফেলা হয়। দেওয়ান সাহেবের মায়া লেগে যায়,
এক পর্যায়ে রাতে খাস কামরায় এলেন, তহশীলদারকে বললেন, ‘এমন অপমাইন্যা জায়গা আমার জমিদারিতে রাইখ্যা লাভ নেই। এই বেটাকে সঙ্গে নিয়ে চলেন, সদরে গিয়ে এই হাওরের সব জায়গা এই বেটার নামে লেখা পড়া করে দিয়ে দিবেন’।
শেষ পর্যন্ত এই কৃষক বেচারার নামে এই বিরাট হাওর এলাকাটি দানপত্র করে দেওয়া হল।
তারপর, তার উত্তর পুরুষেরা হয়ে গেল এই এলাকার জমিদার।
লেখকঃ আবু সালেহ আহমদ
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।