উৎপল কান্তি বড়ুয়া
দরজা নক করছেন বাবা। বাজারের থলে হাতে। দাঁড়িয়ে আছেন বাইরে। মা দরজা খুলে দেন। বাবা বাসায় ঢোকেন। ঢোকার সময় দরজায় ফাক পেয়ে বাবার সাথে সাথে রিনিও ঢুকে পড়ে বাসায়।
সাথে সাথে মা প্রায় চিৎকার করেই বলে ওঠেন, হায় হায়! রিনি কোত্থেকে এলো! রিনি কী করে ঘরে আসলো? সোহান তো রিনিকে বন্দরের বৌদ্ধ মন্দিরে দিয়ে এসেছে। সোহান, তুমি না রিনিকে বৌদ্ধ মন্দিরে ছেড়ে এসেছো! তা হলে রিনি কী করে বাসায় ফিরে আসলো, হায় হায়!
মায়ের কথা শুনে বাজারের থলে হাতেই বাবা বাসায় ঢুকে অনেকটা হতভম্ব হয়ে দাড়িয়ে থাকেন। সাথে বাবাও রিনিকে দেখে এতটাই আশ্চর্য হয়েছেন যে, বাজারের থলে হাত থেকে নামিয়ে রাখতে হবে, সেটাই যেনো ভুলে গেলেন। মায়ের মুখে রিনির কথা শুনে ঠাম্মা বেরিয়ে এলেন তার ঘর থেকে। সোহান আর নীলম তাদের পড়ার ঘরে পড়ছিলো। তারা দুই ভাইবোনও একসাথে বেরিয়ে এলো।
মিয়াও মিয়াও করে রিনি এই ফাকে এক লাফে নীলমের কোলে চড়ে ওঠে। নীলমও রিনিকে ফিরে পেয়ে যেন আসমানের চাঁদ ফিরে পাওয়ার মতো খুশি হয়।
সোহান একদিন আগে ঠিক গতকাল বিকেলে ক্লিনিকে কাপড়ের থলে ভরে নিয়ে বৌদ্ধ মন্দিরে ছেড়ে এসেছে। নীলম তখন স্কুলে। সোহানের সকালবেলার স্কুল। দুপুরে একটায় ছুটি। দুপুরে একটা থেকে নীলমের স্কুল। বিকেল চারটায় ছুটি তার। রিনিকে ছাড়া যেনো নীলমের এক মুহূর্তও চলে না। পড়তে খেতে চলতে খেলতে হাঁটতে বসতে ঘুমুতে সারাটাক্ষণই যেনো রিনি আর রিনি। নীলম স্কুলে থাকাকালীন সময়ে মা আর ঠাম্মা সোহানকে দিয়ে বন্দরের বৌদ্ধমন্দিরে পাঠিয়ে দেয় রিনিকে। কারণ নীলম বাসায় থাকাকালীন সময়ে রিনিকে ঘর থেকে বের করা যাবে না কোনোমতেই।
বিভূল আংকেল প্রায় ছয়মাস আগে তার বাসা থেকে রিনিকে এনে দিয়েছিলেন। রিনি তখন একদম ছোট্ট বাচ্চাটি ছিল। সেই প্রথম থেকেই নীলম রিনিকে দেখাশোনা খাওয়ানো ঘুমানো। একসাথে খেলা করা থেকে সব দায়িত্বই যেনো তার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ছয় মাস পরে এসে পরিবারে রিনি হয়ে ওঠে বিশেষ অসুবিধার কারণ। হয়ে উঠবে না! নীলম, রিনিকে ছাড়া কিছুই বোঝে না! পড়ালেখা খেলাধুলা, এমন কি খেতেও ভুলে যায়। রিনিকে নিয়েই শুধু খেলায় মেতে থাকে নীলম। এই তো সেদিনও পাঁচতলা বাসার ছয়তলা ছাদে নীলম রিনিকে নিয়ে খেলায় মশগুল। খেলতে খেলতে কখন যে স্কুলের সময় পেরিয়ে গেছে খেয়ালই ছিল না। বাসায় অতিথি এসেছে। তাদের নিয়ে মা-ঠাম্মার ব্যস্ত থাকার কারণে নীলমের স্কুলের কথা তারাও ভুলে ছিলেন। সকাল সন্ধ্যায় পড়তে বসে রিনিকে নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে নীলম। এতে করে পড়া লেখায়ও বেশ ক্ষতি হচ্ছে তার। পাশাপাশি একঘরে এক টেবিলে সোহানেরও পড়ালেখার অসুবিধা হচ্ছে তাতে।
ঠাম্মার সেই প্রথম থেকেই রিনির প্রতি চরম অনীহা। ঠাম্মা বলেন, বিড়ালের লোম এবং বিড়ালের ধরা ছোঁয়া থেকে নাকি বাচ্চাদের কঠিন রোগের সৃষ্টি হয়। তাছাড়া রিনি প্রথম প্রথম ভালোই ছিলো। ইদানীং রান্না ঘরে দুধের পাত্রে মুখ ডুবিয়ে দেয়া, ভাজা কই মাছের কড়াইয়ের ঢাকনা উল্টিয়ে ফেলা এসব কাণ্ড করে বেশ বিরক্তির কারণ হয়ে ওঠে রিনি। একত্রে এসকল কারণে মা ঠাম্মা বাবা বসে পরামর্শ করেন। সোহানকে দিয়ে বাসা থেকে চার কিলোমিটার দূরত্বের বন্দরের বৌদ্ধ মন্দিরে রিনিকে রেখে আসার সিদ্ধান্ত হয়। নীলম রিনিকে ছাড়া থাকতে পারে না। রিনিকে মন্দিরে রেখে আসার কথা জানতে পারলে সে মানবেই না। কান্নাকাটি করে পুরো ঘর মাথায় তুলবে। তাই তার অজান্তেই এই সিদ্ধান্ত।
নীলম স্কুলে থাকাকালীন সময়ে কাপড়ের থলের ভেতর করে রিক্সায় চেপে সোহানকে দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় বন্দরের বৌদ্ধ মন্দিরে। স্কুল থেকে ফিরে নীলম রিনিকে দেখতে না পেয়ে তার সে কি কান্না! অনেক কষ্টে বুঝিয়ে সুঝিয়ে শেষে কিছুটা শান্ত করা হয় নীলমকে।
কিন্তু কি করে রিনি বাসায় চলে এলো চব্বিশ ঘণ্টারও বেশি সময় পরে এখন? মায়ের সাথে। সাথে ঠাম্মা বাবা এবং সোহানও আশ্চর্য হয়ে যায়! এতক্ষণ চুপ করে থাকা বাবা বললেন, বিড়ালের সেন্স পাওয়ার আসলে বেশ প্রখর। কিম্বা এরও বেশি এমন কিছু পাওয়ার বেড়ালের আছে, যা আমাদের অনেকেরই অজানা। তা না হলে, থলের ভেতরে করে রেখে আসা সম্পূর্ণ অচেনা অজানা একটা জায়গা থেকে বেড়ালটা কি করে ঠিক ঠিক বাসায় ফিরে আসে?
মা বললেন, শোনো শোনো কিছু তো এখন আর করার নেই। রিনি ফিরেই যখন এসেছে তখন কি আর করা! ঠেলে তাড়ালেও তো আর হবে না, থাকুক বাসায়। বাবা মাথা নেড়ে মায়ের কথায় সায় দেন। ঠাম্মা বলেন, তবে হ্যা, শর্ত সাপেক্ষে কিন্তু রিনি বাসায় থাকবে। নীলমকে উদ্দেশ্য করে ঠাম্মা বলেন, তোমার পড়ালেখা, খাওয়া দাওয়া, স্কুলে যাওয়া সব কিন্তু ঠিক ঠিক করা চাই। রিনিকে নিয়ে দিনরাত খেলাধুলা করা বা কেবলই পড়ে থাকা একদম চলবে না। ঠিক আছে তো! রিনিকে কোলে নিয়ে মাথায় আদুরে হাত বুলাতে বুলাতে নীলম মিষ্টি করে হেসে বলে, তাই হবে ঠাম্মি। আমার দুষ্ট রিনি আর কোনোদিন কোথাও যাবে না, বলতে বলতে তার ঘরে ঢুকে যায় নীলম।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।