ইতিহাসের আলোকে নবাব মুর্শিদকুলি খান
১৬ নভে ২০২১, ০৯:০৫ অপরাহ্ণ

মুর্শিদকুলী খান ১৭১৭ খ্রিষ্টাব্দে মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের পর সুবাহ বাংলার স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তিনি রাজধানী মাখসুদাবাদে স্থানান্তর করেন যা তাঁর নাম থেকে মুর্শিদাবাদে নামকরণ হয়। তিনি একজন ধর্মনিষ্ঠ, ন্যায়পরায়ণ ও প্রজাদরদী শাসক ছিলেন। তিনি ইসলামী শরীয়ত অনুসারে কঠোরভাবে দেশ শাসন করতেন। তিনি সপ্তাহে দুবার স্বয়ং বিচারকার্য পরিচালনা করতেন। তাঁর সময়ে দেশে ব্যবসা বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। বাংলা, তুর্কী, পারসী, মাজাপাহী, ইংরেজ, ফরাসী প্রভৃতি জাতির একটি গুরুত্বপূর্ণ বাণিজ্য কেন্দ্রে পরিণত হয়। তাঁর সময়ে বাংলার হুগলী একটি বিখ্যাত আন্তর্জাতিক বন্দরে পরিণত হয়। মুর্শিদকুলী খানের পর তাঁর জামাতা সুজাউদ্দিন খান বাংলার নবাব হন। তিনি ত্রিপুরা আক্রমণ করেন এবং ত্রিপুরা বাংলার একটি করদ রাজ্যে পরিণত হয়। তিনি বীরভূমের শাসক বদিউজ্জামানের বিদ্রোহ দমন করেন। তিনি কঠোরভাবে ইউরোপীয় বণিকদের দস্তক প্রথা ও শুল্ক ফ্যাঁকি বন্ধ করেন। তাঁর সময়ে ইংরেজ, ফরাসি ও পর্তুগিজ বণিকগণ কোনরূপ শুল্ক ফাঁকি দিতে পারতেন না। উপরন্তু নবাবকে ইউরোপীয় বণিকদের নজরানা দিয়ে সবসময় সন্তুষ্ট রাখতে হত। কাশিমবাজারের ইংরেজ কুঠির অধ্যক্ষ নবাবকে তুষ্ট করার জন্য তিন লক্ষ টাকা নজরানা দেন। মুর্শিদকুলি খান, যাঁর নামে রাজধানী মুর্শিদাবাদ। মুর্শিদকুলি খান দিল্লীর সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে বাংলাসহ ভারতের পূর্বাঞ্চল নিয়ন্ত্রণে আনেন। তিনি এ অঞ্চলে সবচেয়ে সুন্দর ও গোছানো শাসন ব্যবস্থা চালু করেছিলেন। পরবর্তীতে ব্রিটিশরা তা অনুকরণ, অনুসরণ করে।
মুর্শিদকুলি খান ছিলেন একজন ব্রাহ্মণ পরিবারের সন্তান। পারস্যবাসী হাজী শফি ইস্পাহানী তাঁকে ক্রয় করে নিজ পুত্রের মত লালন পালন করেন। তাঁর নাম দেন মুহাম্মদ হাদী। বাদশা আওরঙ্গজেব তার শাসন ব্যবস্থায় অভিভূত হয়ে তাকে মুর্শিদকুলি খান উপাধিতে ভূষিত করেন। তাঁর উপাধি অনুসারে মাখসুসাবাদের (মুর্শিদাবাদের পূর্ব নাম) মুর্শিদাবাদ রাখতেও অনুমতি দেন সম্রাট। হাজী শফি ইস্পাহানী ছিলেন শিয়া। তিনি মোঘলদের অধীনে চাকুরী করতেন। কিন্তু ১৬৯০ খ্রিস্টাব্দে হাজী শফি ইস্পাহনী মোঘলদের চাকুরী ছেড়ে দিয়ে পারস্যে চলে যান। মুহাম্মদ হাদীও ও তাঁর সাথে পারস্যে গিয়েছিলেন। সেখানে অবস্থান কালে পারস্য জাতির বুদ্ধিমত্তা,জীবন ব্যবস্থা ও নানাবিধ আচরণ এবং রুচির সাথে পরিচিত হন। এতে মুর্শিদকুলি খান শিয়া আকিদার বিশ্বাসের দিকে কিছুটা ধাবিত হয়েছিলেন। হাজী শফীর মৃত্যুর পরে, মুহাম্মদ হাদী তথা মুর্শিদকুলি খান ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে ভারতবর্ষে ফিরে আসেন। তিনি দাক্ষিণাত্যে গমন করে মোঘল দেওয়ান হাজী আবদুল্লাহ খুরাসানির অধীনে চাকুরী লাভ করেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে মুহাম্মদ হাদীর অসাধারণ কর্মদক্ষতার কথা ছড়িয়ে পড়ে। মুহাম্মদ হাদীর বড় সৌভাগ্য যে,তাঁর অসাধারণ যোগ্যতার কথা বাদশাহ আওরঙ্গজেবের নজরে আসে। ফলে সম্রাট তাঁকে নিজের অধীনে রাজস্ব বিভাগে চাকুরী প্রদান করেন। মুহাম্মদ হাদী প্রথমে দেওয়ান এবং পরে ইয়েল কোন্দলের ফৌজদার নিযুক্ত হন। এই পদে থাকাকালীন তাঁর যোগ্যতার কারণে তাঁর প্রতি সম্রাটের নেক নজর আরও বেড়ে যায়। ঐতিহাসিক গণের মতে মুহাম্মদ হাদী যে একজন বিজ্ঞ, সৎ ও আনুগত্যশীল কর্মচারী তা সম্রাটের দক্ষিণাত্যের যুদ্ধ বিগ্রহের সময় স্পষ্ট হয়ে উঠে। এদিকে ভারতবর্ষের পূর্বাংশে বাংলার দিওয়ানীতে নিযুক্তির জন্য একজন দক্ষ কর্মচারীর প্রয়োজন দেখা দিলে স্বভাবতই মুহাম্মদ হাদী এ পদে মনোনয়ন লাভ করেন। ১৭০১ খ্রিস্টাব্দে এ পদটি ছিল খুবই স্পর্শকাতর। যেহেতু এ পদাধিকারের দায়িত্ব হল ভূমির রাজস্ব আদায়।
আয় ব্যয়ের হিসাব রক্ষণ, প্রসাসনিক কর্মচারীদের বেতন প্রদান, জায়গীর তথা হস্তান্তিরত ভূমি সংশ্লিষ্ট আর্থিক বিষয়াদি পরিচালনা, ধর্মীয় উদ্দেশ্যে প্রদত্ত সম্পত্তি বা অর্থের তত্ত্বাবধান, বিভিন্ন বিভাগে অর্থ বণ্টন, অধীনস্থ কর্মচারীদের কার্যকলাপের প্রতিবেদন পেশ। এছাড়া কৃষির উন্নতিকল্পে উৎসাহ প্রদান, রাষ্ট্রীয় তহবিলের প্রতি কড়া নজর রাখা, যথাযথ অনুমতি ছাড়া তহবিল থেকে কোন বণ্টন না দেওয়া এবং কৃষকদের নিকট হতে অবৈধ অর্থ আদায় বন্ধ করা। অর্থাৎ প্রদেশের সরকারী রাজস্ব সংক্রান্ত সকল বিষয়ের উপরে প্রাদেশিক দিওয়ানের কর্তব্য বিস্তৃত ছিল। বাংলার দিওয়ান নিযুক্ত হওয়ার পর মুহাম্মদ হাদী তৎকালীন বাংলার রাজধানী জাহাঙ্গীর নগরে বর্তমানে ঢাকায় পৌঁছান। এই সময় প্রাদেশিক সুবেদার ছিলেন শাহজাদা মুহাম্মদ আজিম উদ্দীন । মুহাম্মদ হাদী শাহজাদার সাথে স্বাক্ষাৎ করে দিওয়ানি সংক্রান্ত বিষয়ে ওয়াকিবহাল হন। রাজস্ব বিভাগীয় সকল কর্মচারীদেরকে প্রত্যক্ষভাবে নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখা এবং শাহজাদার হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা ছিল মুহাম্মদ হাদীর গৃহীত প্রথম পদক্ষেপ। তিনি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির জন্য দুই রকম নীতি গ্রহণ করেন। প্রথমত বাংলায় রাজস্বের প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে অবগত হতে প্রতিটি পরগনায় কর্মচারী প্রেরণ করে যাবতীয় তথ্যাদি সংগ্রহ করেন। দ্বিতীয়ত সরকারী বিষয়গুলোতে ব্যয় সংকোচন-এর প্রতি নজর দেন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের অনুমতি নিয়ে রাজকীয় কর্মচারীদের বদলীকরে নানাভাবে বাংলার রাজস্ব ব্যবস্থাপনাকে ঢেলে সাজাতে শুরু করেন। তিনি একচেটিয়া কারবার বন্ধ করে দেন। মুহাম্মদ হাদীর সংস্কারের ফলে প্রদেশের রাজস্বখাতে আয় ধারণাতীত ভাবে বেড়ে যায়। এতে প্রথম বছর মুহাম্মদ হাদী এক কোটি টাকা দিল্লীর রাজস্ব তহবিলে পাঠাতে সক্ষম হয়েছিলেন। এই বিপুল অর্থ প্রেরণে সম্রাট আওরঙ্গজেব খুশি হন, কিন্তু বাংলার অনেকেই তাঁর শত্রুতে পরিণত হয়। তন্মধ্যে তাঁর প্রধান শত্রুতে পরিণত হন বাংলার সুবেদার স্বয়ং শাহজাদা মুহাম্মদ আজিম উদ্দীন। শাহজাদা আজিম উদ্দীন বাংলার সুবেদারের পদ গ্রহণ করে প্রদেশের শাসনকার্যের ব্যাপারে তাঁর অবাধ কর্তৃত্ব বিস্তার করেছিলেন। কিন্তু মুহাম্মদ হাদীর কারণে শাহজাদার কর্তৃত্ব হ্রাস পেতে থাকে। ফলে, মুহাম্মদ হাদীর সাথে শাহজাদার বিরোধ শুরু হয় এবং তা আস্তে আস্তে মারাত্মক আকার ধারণ করে। ঐতিহাসিকগণের মতে শাহজাদা কর্তৃক প্ররোচিত মুহাম্মদ হাদীর প্রাণনাশের প্রচেষ্টার কথাও রয়েছে। উল্লেখ্য, রাজস্বের উপর হতে শাহজাদার কর্তৃত্ব চলে যাওয়ায়, দেওয়ান মুহাম্মদ হাদীর প্রতি রাজকীয় অনুগ্রহ বৃদ্ধির সাথে তার শত্রুর সংখ্যাও বৃদ্ধি পেতে থাকে। সম্রাটের ভয়ে শাহজাদা হাদীর প্রাণনাশ না করে তাঁকে দমন করার জন্য ষড়যন্ত্রের আশ্রয় নেন। এতে অশ্বারোহী বাহিনীর অধ্যক্ষ আবদুল ওয়াহিদকে সৈন্যদের বকেয়া বেতন আদায় করার জন্য দিওয়ানের কাছে পাঠিয়ে তাঁকে ঘেরাও করার উষ্কানী দেন। উদ্দেশ্য, প্রাদেশিক রাজধানীতে বিশৃংখলার পরিবেশ তথা দাঙ্গার সুযোগে দেওয়ানকে হত্যা করা। আবদুল ওয়াহিদ এবং তাঁর বাহিনী দেওয়ান মুহাম্মদ হাদীকে ঘেরাও করে এবং বেতনের দাবীতে নানা রকম অরাজকতা শুরু করে। ঐতিহাসিকগণের মতে ঢাকার রাজপথে সংঘঠিত ঘটনাটি ছিল একটি নাটকীয় দৃশ্য। এই দৃশ্যই বাংলার মুসলমানদের রাজধানী হিসাবে ঢাকাকে শেষবারের মত পরিত্যাগ করতে বাধ্য করে। ষড়যন্ত্রে ব্যর্থ হলে শাহজাদা ঘাবড়িয়ে গেলেন। এ ঘটনার পর দিওয়ান মুহাম্মদ হাদি সম্রাটের নিকট লিখিত প্রতিবেদন পাঠান। নিজের নিরাপত্তার জন্য সুবেদার শাহজাদা আজিম উদ্দিনের নিকট থেকে দূরে থাকা সমীচীন মনে করেন। সম্রাট বাংলার জমিদার ও কানুনগোদের সাথে বিশদ আলোচনা সাপেক্ষে ঢাকা হতে দিওয়ানের কার্যালয় মাখসুসাবাদে (মুর্শিদাবাদে) স্থানান্তর করার অনুমতি দেন। এ স্থানটি প্রকৃতপক্ষে সমস্ত বাংলার যোগাযোগ রক্ষায় উপযোগী ছিল। উপরন্তু মুহাম্মদ হাদীকে মুর্শিদাবাদেও ফৌজদারের দায়িত্ব দেওয়ার পর তিনি ঢাকা অপেক্ষা এখানে নিজেকে অধিকতর শক্তিশালী ও নিরাপদ মনে করেন। অপরদিকে, মুহাম্মদ হাদীর প্রতি অবিচারের আশ্রয় নেওয়ায় বাদশাহ আওরঙ্গজেব শাহজাদা আজিম উদ্দীনের প্রতি হুশিয়ারী দিয়ে কড়া ভাষায় চিঠি দেন এবং শাহজাদাকে বাংলা থেকে বিহারে চলে যাওয়ার নির্দেশ দেন। ফলে শাহজাদা তাঁর পুত্র ফারখ সিয়ারকে ঢাকায় রেখে নিজ পরিবারসহ বিহারের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন এবং পাটনাকে বসবাসের উপযোগী করে সেখানে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি এখানে একটি শক্তিশালী দুর্গও নির্মাণ করেন। দিওয়ান মুহাম্মদ হাদী মুর্শিদাবাদে তার বাংলার কার্যভার গ্রহণ করে পরবর্তী দু’বছরের রাজস্ব তালিকা তৈরি করত দাক্ষিণাত্যে সম্রাটের দরবারে গিয়ে হাজির হন। সেখানে বড় অংকের রাজস্ব আদায়ের হিসাব পেশ করেন এবং বাংলার নানাবিধ দুর্লভ সামগ্রী সম্রাটকে উপহার দেন।
কেন্দ্রের রাজস্ব বিভাগে বিশাল অংকের রাজস্ব বৃদ্ধির হিসাব দেখে অভিভূত হন। সম্রাট আওরঙ্গজেব দিওয়ান মুহাম্মদ হাদীকে আগে দেওয়া কারতালাব খানের পর এবার তাঁকে “মুর্শিদকুলি খান” উপাধিতে ভূষিত করেন। শুধু তাই নয়, তাঁকে দেয়া উপাধি অনুসারে মাকসুসাবাদের নাম মুর্শিদাবাদ রাখতে অনুমতি দেন। সম্মান ও নতুন উপাধি পাওয়া মুর্শিদকুলি খান নতুন উদ্যম ও কর্ম প্রেরণা নিয়ে বাংলায় ফিরে আসেন। মুর্শিদাবাদে টাকশাল (মুদ্রা প্রস্তুত হয় এরূপ কারখানা) স্থাপন করেন। এভাবে মুর্শিদকুলি খান অত্যন্ত আস্থাভাজন রাজ কর্মচারী হিসাবে সম্রাট আওরঙ্গজেবের রাজত্বের অবশিষ্টকাল অতিবাহিত করেন। এদিকে বাংলায় সুবেদারের অনুপস্থিতিতে মুর্শিদকুলি খান প্রদেশের সর্বোচ্চ রাজকীয় কর্মচারীতে পরিণত হন। শাহজাদার পুত্র ফারাখ সিয়ারের ঢাকায় উপস্থিতি ত^ার মর্যাদাকে বিঘ্নিত করে। মুর্শিদকুলি খান ক্রমাগত রাজানুগ্রহ লাভ করতে থাকেন। তিনি বাংলা ও উড়িষ্যার দিওয়ান এবং মুর্শিদাবাদের ফৌজদার নিযুক্ত হন। বাংলার বৃহত্তর স্বার্থে সম্রাট এই ফৌজদারের আয়তন ও মর্যাদা বাড়িয়ে দেন এবং ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে উড়িষ্যার সহকারী সুবেদার নিযুক্ত করেন। কিছু সময়ের মধ্যে তিনি বিহারের দিওয়ান হিসাবেও নিযুক্তি পান। ১৭০৪ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান উড়িষ্যার সুবেদার এবং বাংলা ও বিহারের দিওয়ানের দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। সম্রাট আওরঙ্গজেবের উপর মুর্শিদকুলি খান এর এত বেশী প্রভাব ছিল যে তিনি রাজস্ব বিভাগের যে কোন লোককে চাকুরীতে নিয়োগ দিতে পারতেন। মুর্শিদকুলি খান এর যোগ্যতা ও জনপ্রিয়তার জন্য তাঁর বিরুদ্ধে কারও কোন অভিযোগ বাদশাহ আওরঙ্গজেব সহজে আমলে আনতেন না। ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ৩ মার্চ বাদশাহ আওরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে তাহার শিবিরে ইন্তেকাল করেন। তাহার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকারের যুদ্ধ শুরু হয়। এতে তাহার জীবিত ৩ পুত্র, তাদের সন্তানগণ ও অনুচরবর্গ অংশগ্রহণ করেন।
উত্তরাধিকার যুদ্ধে জ্যেষ্ঠপুত্র শাহজাদা মুহাম্মদ মোয়াজ্জেম জয়ী হন। তিনি শাহ আলম বাহদুর উপাধি গ্রহণ করে সিংহাসনে বসেন। তখন হতে মুর্শিদকুলি খান কিছুটা প্রতিকূল অবস্থায় পড়লেও বাদশাহ আওরঙ্গজেবের সন্তানদের পক্ষে মুর্শিদকুলি খানকে সরিয়ে দেয়া সম্ভব হয়নি। সে এক ভিন্ন কথা। পরবর্তীতে তথা ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুর্শিদকুলি খান বাংলার পূর্ণ সুবেদার হিসাবে দায়িত্বে নিযুক্ত হন এবং দীর্ঘকাল এ দায়িত্বে থাকেন। এই সময় তিনি রাজস্ব ব্যবস্থাকে সুশৃংখল পদ্ধতিতে প্রবর্তন করেন। এটা বাংলার ইতিহাসে তাঁকে চিরস্মরণীয় করে রেখেছে। ব্রিটিশদের গৃহীত ভূমি-রাজস্ব পদ্ধতি মূলত মুর্শিদকুলি খান এর অবদান যেহেতু এ সংস্কারের আগে অর্থাৎ মোঘলদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকে এখানে সামরিক ও বেসামরিক কর্মচারীদের বেতনের পরিবর্তে জায়গীর হিসাবে ভূমি বণ্টন দেয়া হত। এমনকি জায়গীর হিসাবে রাজকীয় ভূ সম্পত্তিও প্রদান করা হত। প্রকৃতপক্ষে মোঘলদের আয়ের গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল বাংলা। এতে মুর্শিদকুলি খান বাংলায় রাজস্ব সংস্কারে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি ভূমি জরিপের উপর ভিত্তি করে নতুন রাজস্ব পদ্ধতি চালু করেন। জমিতে চাষাবাদের উপর গুরুত্ব দেন। বাংলার কৃষকেরা যাতে জমিতে ফসল ফলায় সে লক্ষ্যে উদ্বুদ্ধ করেন। জমিদারদের অনিয়ম, অবহেলা, অলসতা,অযোগ্যতা ও বিলাসী জীবনযাত্রাকে তিনি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। ফলে, বাংলায় সুন্দর ও সুশৃংখল শাসন ব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন সাধিত হয়। বাংলায় সুশৃংখল পরিবেশ ফিরে আসায় সমস্ত কর্মচারীদের বেতন প্রদানের পরেও কোটির উপরে টাকা রাজস্ব উদ্বৃত্ত হতে থাকে। মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব বন্দোবস্তি ব্যবস্থায় সমগ্র বাংলাকে ১৩টি চাকলায় বিভক্ত করেন ও প্রতি চাকলায় (কয়েকটি পরগনার একত্রীকরণ বা জেলা) একজন করে আমিন নিয়োগ করেন। মুর্শিদকুলি খান রাজস্ব পদ্ধতির সংস্কারের পাশাপাশি রাজস্ব আদায় ও শাসন প্রক্রিয়ায় শক্ত অবস্থানে যান। চতুর্দিকে তাঁর সজাগ দৃষ্টি জমিদার, প্রজা তথা সকল স্তরে কম্পন শুরু হয়। রাজস্ব নীতির ফলে প্রজারা দ্বৈত শাসন হতে রক্ষা পায়। রাজস্ব আদায় এবং প্রশাসনিক দায়িত্ব এককভাবে তাঁর নিয়ন্ত্রণে আসায় প্রজাগণের মাঝে সুন্দর নিয়ম শৃংখলা প্রবর্তিত হয়। বন্ধ হয়ে যায় শাসকদের নির্যাতন। ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার নিশ্চিত হয়। প্রজা সাধারণের খাজনা প্রদানের ক্ষমতা বেড়ে যায়। এতে মুর্শিদকুলি খান ৩০০ অশ্বারোহী ও ৫০০ পদাতিক সৈন্যের পাহারায় স্বর্ণ মুদ্রাসহ এক কোটি ত্রিশ লাখ টাকা দিল্লীতে পাঠাতে সক্ষম হন। তার আমলে টাকায় চার মন চাউল বিক্রি হত। মুর্শিদকুলি খান এতই ন্যায়পরায়ণ ছিলেন যে, ন্যায়বিচারের স্বার্থে তিনি নিজ পুত্রকে পর্যন্ত হত্যা করেছিলেন। শক্তিশালীদের নিষ্ঠুরতার কবল থেকে দুর্বলদের রক্ষা করতেন। এতে জুলুমবাজ জমিদাররা সংশোধন হয়ে ভীতসন্ত্রস্ত থাকত। বাংলায় চুরি-ডাকাতিসহ অপরাধ প্রবণতা এক প্রকার বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে তিনি সর্বদা সজাগ ছিলেন। শস্যের একচেটিয়া ব্যবসা তিনি নিষিদ্ধ করেন। তাঁর আমলে কয়েকটি হিন্দু জমিদারী প্রতিষ্ঠা লাভ করে। তৎমধ্যে নাটোর, কুটিয়া (রাজশাহী) অন্যতম। তাঁর আমলে বাংলায় রপ্তানী বাণিজ্য দ্রুত বৃদ্ধি পায়। রপ্তানীকারকদের মধ্যে ইউরোপীয়, ইংরেজ, ওলন্দাজ ও ফরাসী কোম্পানী ছিল। মুর্শিদকুলি খান ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কৌশল, বেপরোয়া বেনিয়ানীতি শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করেন। এতে সুবিধা করতে না পেরে ১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর সম্রাটের চিকিৎসার অজুহাতে ত্যাঁর নিকট হতে ব্যাপক বাণিজ্য লাভের অনুমতিপত্র আদায় করে নেয়। ব্রিটিশদের এই ছলচাতুরীতে মুর্শিদকুলি খান খুবই মর্মাহত হন। শুধু তাই নয় দিল্লীর এ ফরমান মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনবে তা তিনি বুঝতে পারেন। তারপরেও তিনি দিল্লীর সম্রাটের প্রতি অনুগত ছিলেন। ইংরেজদের ব্যবসা প্রসারের ফলে কলকাতার গুরুত্ব দিন দিন বাড়তে থাকে। সুযোগ-সুবিধার আশায় অসংখ্য লোক পরিবারবর্গ নিয়ে কলকাতায় চলে আসতে থাকেন। ফলে কলকাতা একটি জনবহুল শহরে পরিণত হয়।
১৭০৫ খ্রিস্টাব্দে কলকাতার জনসংখ্যা যেখানে ছিল মাত্র দেড় হাজার সেখানে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দে এ সংখ্যা দাঁড়ায় এক লাখে। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী দিল্লীর দুর্বল সম্রাটকে প্রায়ই অতি মূল্যবান উপহার সামগ্রী ও নগদ অর্থ প্রদানের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে বাণিজ্যিক সুবিধাদি লাভ করার ফরমান আদায় করতে সক্ষম হয়। এতে বাংলাসহ ভারতবর্ষের পূর্বাঞ্চলে ব্যবসা বাণিজ্যের নামে ইউরোপীয়রা তাদের আসন পোক্ত করতে থাকে। কিন্তু এই ফরমানের পরিনাম ভবিষ্যতে শুভ নয় তা বুঝেও দিল্লীর আনুগত্য থেকে বিচ্যুত হননি। দীর্ঘ সময় বাংলা ও উড়িষ্যায় অত্যন্ত নিখুঁতভাবে শাসন করেন। কঠোর পরিশ্রমের ফলে মুর্শিদকুলি খানের স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়ে। ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে ৩০ জুন ইন্তেকাল করেন। মুর্শিদাবাদে প্রধান মসজিদের সিঁড়ির নিচে তার কবর। তাঁর কোন পুত্র সন্তান ছিল না। কন্যার গর্ভজাত মির্জা আসাদুল্লাহর অবস্থান নির্ধারণের জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন ও জীবদ্দশায় ১৭২০ খ্রিস্টাব্দে তাঁকে সরফরাজ খান উপাধি প্রদান করেন। কিন্তু তার জামাতা রাজকীয় অনুমোদন লাভ করায় এ প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়। বস্তুতঃ মুর্শিদকুলি খান ছিলেন শিয়া মতাবলম্বী। তবে তিনি উগ্রপন্থী ছিলেন না। সুন্নিদের মূল্যায়নসহ সহঅবস্থানে ছিলেন। তিনি ছিলেন সাহসী, উদারপ্রাণ, সদাচারী ও ন্যায়বান একজন শাসক। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনাসহ কুফা, নাজাফ, কারবালা, বাগদাদসহ পান্ডুয়ায় অনেক বিখ্যাত মসজিদ, মাদ্রাসা ও মাজারে নগদ অর্থ ও উপহার সামগ্রী প্রেরণ করতেন।
তিনি নির্মল চরিত্রের অধিকারী ছিলেন। অল্প ঘুমাতেন, নির্দিষ্ট সময়ে নামাজ পড়তেন এবং বিধিসম্মত একজন স্ত্রীর প্রতি অনুরক্ত ছিলেন। পবিত্র কুরআন লিখতেন। শাসনকার্যের পাশাপাশি নফল রোজা রাখাসহ এবাদত বন্দেগিতে মশগুল থাকতেন। তাঁর আমলে পাটনা, মুর্শিদাবাদ ও ঢাকা ছিল জ্ঞানচর্চার কেন্দ্র। রাষ্ট্রীয় ভাষা ফারসির পাশাপাশি আরবির প্রসারেও খুবই সজাগ ছিলেন। তাঁর আমলে বাংলায় হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি লক্ষণীয়। বাংলায় দীর্ঘদিনের জন্য শান্তি স্থাপন তাঁর বিশেষ অবদান আছে। জীবনের শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত দিল্লী মোঘল বাদশাহগণের অনুগত ছিলেন নবাব মুর্শিদ কুলি খান। নবাব মুর্শিদ কুলি খান এর মৃত্যু দিবসে তাঁর প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।