নিউজ ডেস্কঃ বরগুনার বেতাগী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিন ও হিসাব সহকারী দীপক কুমার গুহের বিরুদ্ধে ভুয়া ভাউচার তৈরি করে কলেজের বিভিন্ন উন্নয়ন খাতের বরাদ্দ, বিভিন্ন সামগ্রী ক্রয়ের অর্থ লোপাটসহ ফরম পূরণ, ভর্তি, সার্টিফিকেট ও প্রশংসাপত্র বিতরণ বাবদ অতিরিক্ত অর্থ আদায় করে কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে।
তবে ২০২১ সালের ১১ আগস্ট বেতাগী সরকারি কলেজ থেকে বদলি হয়ে পটুয়াখালী সরকারি কলেজে যোগদান করেন অধ্যক্ষ নুরুল আমিন। অধ্যক্ষের বদলি হওয়ার পরপরই উঠে আসে এসব অর্থ আত্মসাতের চিত্র। প্রতিবেদকের হাতে আসে পরপর চার অর্থবছরের বরাদ্দ উত্তোলনের প্রমাণ। শুধু নামেই আছে এসব বরাদ্দ বাস্তবে দেখা মেলেনি কোনো কিছুর।
জানা যায়, ২০১৬ সালের ১১ জুলাই বেতাগী সরকারি কলেজে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন নুরুল আমিন। বছর যেতে না যেতেই ২০১৭ সালের ৯ জুলাই নানা অনিয়মের অভিযোগ এনে বেতাগী উপজেলা পরিষদের সামনে সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদ ব্যানারে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। তবে তাতে কোনো কাজ হয়নি। থামেনি অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের নানা অনিয়ম ও দুর্নীতি।
একের পর এক নানাভাবে সমালোচিত হন ওই অধ্যক্ষ। এমনকি কলেজ ভবনের শ্রেণিকক্ষ দখল নিয়ে তৈরি করেন বাসস্থান। এসব অনিয়ম নিয়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয় ধারাবাহিক সংবাদ।
কলেজ সূত্রে জানা যায়, অর্থ আত্মসাতের বিষয়টি জানাজানি হলে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সখ্যতার জের ধরে অর্থের বিনিময়ে পটুয়াখালী সরকারি কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে বদলি হন নুরুল আমিন।
বেতাগী উপজেলা হিসাবরক্ষণ অফিস থেকে প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, গত ২০১৭-২০১৮ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের জুন মাস পর্যন্ত চার অর্থবছরে বেতাগী সরকারি কলেজে গবেষণা সরঞ্জামাদি কেনা বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার, রাসায়নিক দ্রব্যাদি কেনা বাবদ ৭ লাখ ৫০ হাজার, বইপত্র ও সাময়িকী কেনা বাবদ ২ লাখ ৪০ হাজার, টেলিফোন বিল বাবদ ৩৫ হাজার, ইন্টারনেট, ফ্যাক্স ও টেলেক্স বাবদ এক লাখ ২০ হাজার, কম্পিউটার কেনা বাবদ এক লাখ ৫৩ হাজার, কম্পিউটার মেরামত বাবদ ১ লাখ, ক্রীড়াসামগ্রী কেনা বাবদ দুই লাখ ১৫ হাজার, ডাক বাবদ ১৯ হাজার, ভ্রমণব্যয় বাবদ ৩ লাখ, শিক্ষা ও শিখন উপকরণ কেনা বাবদ ২ লাখ ৩০ হাজার, অনুষ্ঠান ও উৎসাবদি বাবদ ৯০ হাজার, ব্যবহার্য সামগ্রী কেনা বাবদ ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়।
এছাড়া ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ ১ লাখ ২৫ হাজার ও পৌরকর বাবদ ১৮ লাখ ৯৫ হাজার টাকা সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে ভূমি উন্নয়ন ও পৌরকরের টাকা পরিশোধ করলেও সরেজমিনে বাকি খাতের জিনিসপত্রের কোনো হদিস মেলেনি। এছাড়াও বিদ্যুৎ বিল বাবদ টাকা উত্তোলন করা হলেও এখনো ২২ হাজার টাকা পল্লী বিদ্যুতের বকেয়া আছে।
একই সঙ্গে কলেজের আসবাসপত্র বাবদ আলাদা বরাদ্দ থাকলেও কোনো রেজুলেশন ছাড়াই কলেজের গাছ কেটে তৈরি করা হয় আসবাসপত্র এবং অধ্যক্ষ ও হিসাব সহকারী দীপকের বাড়ির খাট, আলমিরা, সোকেস।
সরেজমিন দেখা যায়, সেখানে সম্প্রতি একটি কক্ষে স্টোর রুম করা হয়েছে। ২০১৭-১৮ থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরের সরকারি বরাদ্দের একটি স্টক রেজিস্টার খোলা হয়েছে। কিন্তু স্টক রেজিস্টারের কোনো জিনিসপত্র কলেজের স্টোর রুমে পাওয়া যায়নি।
সদ্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবদুল ওয়ালিদকে সঙ্গে নিয়ে স্টক রুমে গিয়ে দেখা যায়, কয়েকটি বই-খাতা এবং দুটি ক্যারামবোট ছাড়া কিছুই নেই। পাশাপাশি কেনাকাটায় বরাদ্দকৃত জিনিসপত্র স্টোর রুমে পাওয়া যায়নি।
কলেজের একটি সূত্র নাম না প্রকাশের শর্তে জানায়, ওই স্টক রুমটি নতুন। অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে বরাদ্দ আত্মসাতের অভিযোগ ওঠার পর স্টোর রুম ও নতুন খাতা কিনে স্টক রেজিস্টার করা হয়েছে। অফিস সহকারী দীপকের সহায়তায় কেনাকাটা কমিটি করে বাসায় বাসায় গিয়ে স্টক রেজিস্টারের জন্য জিনিসপত্র কেনা হয়েছে মর্মে সিল স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে দুই জন শিক্ষকের সিল ছাড়া স্বাক্ষর নেই। এই কাজটিসহ অন্যান্য সব কাজে ভাউচার ও কাগজপত্র তৈরি করে ভাগাভাগি করে অর্থ আত্মসাৎ করতেন সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল আমিন ও তার ঘনিষ্ঠজন কলেজের হিসাব সহকারী দীপক কুমার গুহ।
মালামাল কেনার বিল-ভাউচার দেখতে চাইলে দীপক কুমার গুহ বলেন, বিল ভাউচার সব ঠিক আছে, ওসব এজিতে জমা আছে, কলেজের হিসাব শাখার কপি দেখতে চাইলে তিনি বলেন দেখাতে বাধ্য না।
চার অর্থবছরে বইপত্র ও সাময়িকী কেনা বাবদ দুই লাখ ৪০ হাজার টাকা বরাদ্দ দেওয়া হলেও গ্রন্থাগারে কোনো বই পাওয়া যায়নি। কলেজের সহকারী গ্রন্থগারিক রওশন আরা মালতী বলেন, গত চার অর্থবছরে কোনো বইপত্র কেনা হয়নি। বইপত্র ক্রয় বাবদ কোথাও আমার স্বাক্ষর নেই। বিজ্ঞান বিভাগের গবেষণা সরঞ্জামাদি ক্রয় বাবদ ১০ লাখ ৫০ হাজার এবং রাসায়নিক দ্রব্যাদি ক্রয় বাবদ চার অর্থবছরে সাত লাখ ৫০ হাজার সরকারি বরাদ্দ দেওয়া হলেও বিজ্ঞানাগারে ব্যবহারের, পরীক্ষার জন্য কোনো রাসায়নিক দ্রব্য কেনা হয়নি।
বিজ্ঞানাগারের দায়িত্বে থাকা বেতাগী সরকারি কলেজের পদার্থ বিজ্ঞানের শিক্ষক (সদ্য অবসরপ্রাপ্ত) রোহিতোষ চন্দ্র দে বলেন, গত চার বছরে বিজ্ঞানাগারের জন্য কোনো মালামাল কেনা হয়নি। বিজ্ঞানাগারের পুরোনো যন্ত্রপাতি দিয়ে ব্যবহারিক পরীক্ষা চালানো হয়েছে। আমি বিজ্ঞানাগারের মালামাল কেনার কোনো বিলে আমার স্বাক্ষর নেই। ক্রীড়া সরঞ্জামাদি কেনা বাবদ চার বছরে কলেজে বরাদ্দ দেওয়া হয় ২ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। কিন্তু বাস্তবে একটি ফুটবল ছাড়া কলেজে কোনো ক্রীড়াসামগ্রী পাওয়া যায়নি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলেজের এক অফিস সহকারী বলেন, চার বছরে কোনো কম্পিউটার কেনা কিংবা মেরামত করা হয়নি। নিজের প্রয়োজনে ইন্টারনেটের একটি মোডেম কিনে নিজ খরচে ব্যবহার করি। মেইলে তথ্য আদান-প্রদানের কারণে, ডাক, ফ্যাক্স কিছুই ব্যবহার করা হয়নি। এছাড়া করোনার কারণে বন্ধ থাকায় কলেজে অনুষ্ঠান ও উৎসব এবং কোনো ভ্রমণ ব্যয় হয়নি। এসব খাতের বরাদ্দের অর্থ পুরোটাই আত্মসাৎ করেছেন সাবেক অধ্যক্ষ নুরুল আমিন। সরকারি বরাদ্দের বাইরেও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে চার বছরের মোটা অংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ রয়েছে নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে। যোগদানের পর থেকেই তার বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সেশন ফি, ভর্তি ও প্রবেশপত্র অভ্যন্তরীণ এবং ব্যবহারিক পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায়ের অভিযোগ ওঠে।
কলেজ থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, ২০১৭-২০১৮ সেশন থেকে ২০২০-২০২১ সেশনে দুই হাজার ৮২১ শিক্ষার্থী শুধুমাত্র উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়ন করেছেন। কলেজের বর্তমান ও সাবেক একাধিক শিক্ষার্থী জানান, তাদের প্রত্যেকের কাছ থেকে নবায়ন ফি বাবদ ২০০ টাকা করে নেওয়া হয়েছে। এতে দুই বছরে নেওয়া হয়েছে ১১ লাখ ২৮ হাজার টাকা। অফিস সহকারীর কাছ থেকে গোপন সূত্রে জানা যায়, চার বছরে এই বাবদ বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে ১০ হাজার টাকা।
বাকি টাকা কোথায়? এ প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পারেননি কলেজে সদ্য যোগদান করা অধ্যক্ষ আবদুল ওয়ালিদসহ কোনো শিক্ষক। এছাড়া ভর্তি বাবদ বোর্ডের নির্দেশনা অনুসারে এক হাজার টাকা নেওয়ার কথা থাকলেও ৪৩টি খাত দেখিয়ে দুই হাজার ৩০০ থেকে ২ হাজার ৫০০ টাকা করে আদায় করা হয়েছে।
এর বাইরে ভর্তি ফরম বাবদ আদায় করা হয় আরও ১৫০ টাকা। সেই হিসাবে চার বছরে ৬৯ লাখ ১১ হাজার ৪৫০ টাকা আদায় করা হয়েছে, আর এ থেকে বোর্ডে জমা দেওয়া হয়েছে ২৮ লাখ ২১ হাজার টাকা। বাকি ৪৬ লাখের বেশি টাকা আদায় করা হয়েছে কলেজের বিভিন্ন উন্নয়ন ফান্ডের খাত দেখিয়ে। কিন্তু ওসব খাতের অনুকূলে উন্নয়ন ব্যয়ের কোনো তথ্য দেখাতে পারেনি কলেজ কর্তৃপক্ষ।
বেতাগী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মাকসুদুর রহমান ফোরকান বলেন, বেতাগী সরকারি কলেজে এই চার বছরে একটা দ্রব্যও ক্রয় করা হয়নি। সব টাকাই হিসাব সহকারী ও অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের পকেটে। তারা কলেজটাকে ভাগাভাগি করে নিয়েছে।
কলেজের বর্তমান অধ্যক্ষ (ভারপ্রাপ্ত) আবদুল ওয়ালিদ বলেন, আমি সদ্য যোগ দিয়েছি। গত চার বছরের বরাদ্দ ও ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তবে যদি কেউ সরকারি বরাদ্দের অর্থ আত্মসাৎ করে তা নিরীক্ষায় বের হয়ে আসবে। আমি চেষ্টা করছি, কলেজ সঠিক নিয়মে পরিচালনার জন্য।
অভিযোগের বিষয়ে বেতাগী সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মো. নুরুল আমিন বলেন, ক্রয় কমিটির মাধ্যমে আমি বরাদ্দের অর্থ খরচ করেছি। সবকিছুর বিল-ভাউচার ঠিক আছে। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে জোর করে টাকা আদায় করা হয়নি। তবে এত বড় প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে একটু এদিক-সেদিক করতে হয়। আর আপনি (প্রতিবেদক) দীপকের (হিসাব সহকারী) সঙ্গে দেখা করেন- এসব নিয়ে লেখালেখির কী আছে; সমন্বয় করাটাই তো ভালো।
এ বিষয়ে বরিশাল শিক্ষা বোর্ডের কলেজ শাখার পরিদর্শক ড. লিয়াকত হোসেন বলেন, অধ্যক্ষ নুরুল আমিনের বিরুদ্ধে যদি অর্থ আত্মসাতের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ থাকে তবে বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।