মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর আবিষ্কার - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সকাল ৬:৫৬, ১৪ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর আবিষ্কার

newsup
প্রকাশিত ডিসেম্বর ২১, ২০২১
মুসলিম বিজ্ঞানীদের বিস্ময়কর আবিষ্কার

আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞানে মুসলিম মনীষীদের অবদান অনন্য ও অপরিসীম। রসায়ন, পদার্থ, জীববিজ্ঞান, কৃষি, চিকিৎসা, দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান, ইতিহাস সকল ক্ষেত্রেই ছিল মুসলিম মনীষীদের অগ্রণী পদচারণা। মুসলিম মনীষীদের সেই গবেষণা ও আবিষ্কারের আধুনিকীকরণ ঘটেছে, তার সুফল ভোগ করছে আজকের বিশ্ববাসী। মুসলিম মনীষীদের বিস্মরকর গবেষণা ও আবিষ্কার সম্পর্কে নিম্নে যৎকিঞ্চিৎ আলোকপাত করা হল ঃ

বীজগণিত ও মানুষের চোখ ঃ বিজ্ঞান দাঁড়িয়ে আছে গণিতের ওপর। গণিত দাঁড়িয়ে আছে বীজগণিতের (অ্যালজেবরা) ওপর। সর্বপ্রথম রৈখিক বীজগণিতের ধারণার অবতারণা করেন একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। নাম আবু আব্দুল্লাহ মুহাম্মদ ইবনে মুসা আল-খারিজমী। তাঁর রচিত ‘কিতাব আল-জাবর ওয়াল মুকাবালা’ থেকে বীজগণিতের ধারণা পাওয়া যায়। আল-খারিজমি রচিত বীজগণিতের ওপর ভিত্তি করেই আধুনিক গণিতের যাত্রা ও পথচলা শুরু হয়। আধুনিক বিজ্ঞানের অন্যতম এই শাখাটির যাত্রা শুরু হয় একজন মুসলমানের হাতে। বিষয়টি ভাবতে চমকপ্রদ অবশ্যই। এদিকে তৎকালীন আরব বিশ্ব শুধু গণিতেই বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেনি; বরং বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রেও সমানভাবে পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়। তারা বিবর্ধক কাঁচ বা চশমার ক্ষেত্রেও বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনেন। বসরা নগরীর বিখ্যাত মুসলিম পন্ডিত আল-হাজেন সর্বপ্রথম বর্ণনা করেন চোখের গঠন প্রণালি এবং চোখ কিভাবে কাজ করে। তিনিই প্রথম পরীক্ষা করে প্রমাণ করেন, চোখের দৃষ্টি রশ্মির সঙ্গে পারিপার্শ্বিক অনুভূতি নেই। এছাড়া তিনিই প্রথম চশমার ধারণা দিয়ে বলেন, বাঁকানো কাচের পৃষ্ঠতল চোখের দৃষ্টি সহায়ক হিসেবে বিবর্ধনের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।

দিক নির্ণয়ক যন্ত্র ও মানচিত্র ঃ জ্ঞান-বিজ্ঞানের অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো মুসলিম মনীষীরা দিকনির্ণয়ক যন্ত্র উদ্ভাবন এবং নদ-নদী ও সাগর-মহাসাগরের মানচিত্র তৈরিতে অবদান রাখেন। মানচিত্র জগতে মুসলমানদের অবদানের কথা উল্লেখ করতে গেলে সর্বপ্রথম স্মরণ করতে হয় আল ইদ্রিসের নাম। সপ্তম শতকে স্পেনে জন্মগ্রহণকারী এই মনীষী সমসাময়িক পৃথিবী সম্পর্কে ব্যাপক জ্ঞান অর্জন করেছিলেন। তাঁর রচিত ‘আর রজারি’ ভূচিত্রাবলী এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, সমগ্র ইউরোপ, এশিয়া ও আফ্রিকা তাঁর মানচিত্রকে ওয়ালম্যাপ হিসেবে ব্যবহার করত। মানচিত্র অংকনের পাশাপাশি দিকনির্ণয়ক যন্ত্র উদ্ধাবনেও মুসলমানরা অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিলেন। ‘ম্যাগনেটিক নিডল ও সর্বপ্রথম উদ্ভাবন করেন আরবরা। তারা সমুদ্রে নৌ-চলাচলের ক্ষেত্রে এর ব্যবহার করতেন। মুসলমানদের বিনা অনুমতিতে অন্য কোনো জাতির যুদ্ধজাহাজ তখন ভূমধ্যসাগরে প্রবেশ করতে পারত না।

প্রথম প্যারাশুট ঃ প্যারাশুট বহু গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যবহৃত একটি যন্ত্র। বলা হয়ে থাকে প্যারাশুটের আবিষ্কারক লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি। তিনিই প্রথম প্যারাশুটের একটি জটিল নকশা প্রণয়ন করেন। তার নকশার প্যারাশুটটি বহনকারীর ভর নিখুঁতভাবে বহন করতে সক্ষম ছিল। কিন্তু যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীতে সর্বপ্রথম কোন ব্যক্তি শূন্যে উড়েছিলেন এবং কে সবার আগে প্যারাশুট আবিষ্কারের ধারণা দেন, তাহলে অবশ্যই মুসলিম বিজ্ঞানীদের নাম সবার আগে চলে আসবে। তাঁর নাম আব্বাস ইবনু ফিরনাস। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির প্রায় ৮০০ বছর আগে ৮৭৫ সালে মুসলিম এই বিজ্ঞানী আকাশে ওড়েন। বিমান আবিষ্কারের প্রথম চিন্তক তাকেই ভাবা হয়। ফিরনাস ১০ মিনিট উড়েছিলেন। পাখির পালক জড়ো করে তা দিয়ে পাখা বানিয়ে স্পেনের কর্ডোভার উঁচু পাহাড় ‘জাবাল আল আরুস’ থেকে উড়াল দিয়েছিলেন। উড্ডয়নকালে তার বয়স ছিল ৭০ বছর। নামার সময় দেখলেন তিনি গতি নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন না। তার মনে হলো পাখির লেজের কথা। কিন্তু তিনি লেজ বানাননি। সজোরে আছড়ে পড়লেন মাটিতে। আহত হলেন। এরপরও ১২ বছর বেঁচে ছিলেন, কিন্তু ফের উড়াল দেয়ার সামর্থ্য ছিল না।

শল্য চিকিৎসার যন্ত্রাংশ ঃ জীবন বাঁচাতে অস্ত্রোপচারের যন্ত্রপাতির মতো অপরিহার্য যন্ত্র উদ্ভাবন হয়েছে দশম শতকেই। চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিতে এই গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন করেছেন মুসলিম শল্য চিকিৎসক। সোনালি যুগে শল্যচিকিৎসাবিদ আবুল কাসেম আল জাহরাভির (৯৩৬-১০১৩) পৃথিবীকে উপহার দেন তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ‘আত-তাসরিফ’। শল্য চিকিৎসায় আল জাহরাভি কেমন পারদর্শী ও অভিজ্ঞ ছিলেন উক্ত গ্রন্থটিই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ। তাঁর রচিত ৩০ খন্ডের বিশ্বকোষ আত-তাসরিফ এর একটি খন্ড লিখেছেন ‘অস্ত্রোপচার’ নামে। তাঁকে মধ্যযুগের মুসলিম বিশ্বের মহৎ শল্যবিদ ও আধুনিক শল্যচিকিৎসার জনক বলে গণ্য করা হয়। তাঁর অবদান আধুনিক চিকিৎসায়ও প্রভাব ফেলেছে। আবুল কাসেম আল-জাহরাভি কর্ডোভার বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থবিজ্ঞান, রসায়ন শাস্ত্র, জ্যোতির্বিদ্যা ও চিকিৎসা শাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা লাভ করেন। শিক্ষা শেষে জাহরায় চিকিৎসা সেবা শুরু করেন।

ক্যামেরা ঃ ক্যামেরা বা আলোকচিত্র গ্রহণ ও ধারণের যন্ত্র আবিষ্কারেও রয়েছে মুসলমানদের বিস্ময়কর অবদান। আধুনিক আবিষ্কারগুলোর মধ্যে ক্যামেরা বহুল ব্যবহৃত এবং জনপ্রিয়। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে একটি ক্যামেরার গুরুত্ব কতখানি তা সবাই কমবেশি বুঝি। এই অপরিহার্য যন্ত্র ক্যামেরার উদ্ভাবকও একজন মুসলিম বিজ্ঞানী। নাম ইবনুল হাইসাম। ১০২১ সালে এই মুসলিম মনীষী প্রথম ক্যামেরা উদ্ভাবনের ধারণা দেন। ইরাকের বিজ্ঞানীর রচিত আল মানাজির গ্রন্থে এ ধারণা লিপিবদ্ধ পাওয়া যায়। তবে পূর্ণাঙ্গ ক্যামেরা আবিষ্কার হতে আরও বহু বছর কেটে যায়। এরপর কয়েক ধাপে ক্যামেরায় নতুনত্ব যুক্ত করেন বিজ্ঞানীরা অবশেষে ১৯৭৫ সালে কোডাকের স্টিভেন স্যাসোন প্রথম ডিজিটাল ক্যামেরা মানবসভ্যতায় নিয়ে আসেন। মুসলিম বিজ্ঞানী ইবনুল হাইসাম ৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে ইরাকের বসরা নগরীতে জন্মগ্রহণ করেন। পদার্থবিজ্ঞানের ওপর প্রভাবের ক্ষেত্রে ইবনে হাইসাস রচিত ‘কিতাব আল-মানাজির’ অর্থাৎ বুক অব অপটিকসকে নিউটনের প্রিন্সিপিয়া ম্যাথমেটিকার সমকক্ষ ধরা হয়। তিনি আলোকরশ্মির সরল পথে গমনের বিষয়টি পরীক্ষা করেন এবং প্রমাণ করেন। বিখ্যাত রজার বেকন ও জোহান কেপলারের মতো বিজ্ঞানীরা হাইসামের বুক অব অপটিকস দ্বারা প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।

কফি, টুথব্রাশ ও সাবান ঃ পৃথিবীর বুকে প্রথম কফির চাষ করেছে নবম শতকের দিকে ইয়ামনবাসী। অনেকে বলেন, কফি পান করে সুফি সাধকরা রাত জেগে থাকতেন। এরপর একদল শিক্ষার্থীর মাধ্যমে মিশরের রাজধানী কায়রোতে এসে সেই কফি পৌঁছে। এরপর থেকে সেখানেও কফি চাষ শুরু হয়। পরবর্তীকালে সেই কফির চাষ ছড়িয়ে পড়ে মুসলিম দেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। ইসলামের ইতিহাসে আবার দাঁতের মাজন হিসেবে প্রথম মেসওয়াকের ব্যবহার শুরু হয়। আর সেই থেকে প্রথম টুথব্রাশের ধারণা তৈরি হয়েছিল। ইসলামের কারণেই দাঁত পরিস্কারের প্রয়োজনীয়তা লাভ করে। সর্বসম্মতভাবে সবাই স্বীকার করেন যে, প্রাচীন মিশরীয়রাই সর্বপ্রথম দাঁত পরিষ্কারের জন্য গাছের ডাল ব্যবহার করতেন। সাবান জাতীয় বস্তু ব্যবহারের প্রথম প্রমাণ মেলে খ্রিস্টপূর্ব দুই হাজার আটশত বছর আগে প্রাচীন ব্যাবিলনে। কিন্তু সুগন্ধি সাবানের উদ্ভব হয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত মধ্যপ্রাচ্য কেন্দ্র করে। প্রাচীন মেসোপটেমীয় সভ্যতায় সাবান তৈরি ও ব্যবহারের ব্যাপক প্রচলন ছিল। সেই ধারাবাহিকতায় প্রাচীন সিরিয়ার আলেপ্পো শহরের অধিবাসীদের ছিল উৎকৃষ্টমানের সাবান তৈরির দক্ষতা। সিরিয়াসহ বহু মুসলিম দেশে সাবান উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ শিল্প হিসেবে গড়ে ওঠে। রঙিন সুগন্ধি সাবান, ডাক্তারি সাবান তৈরি ও রপ্তানি হতো সিরিয়ার বিভিন্ন শহর থেকে। নাবলুস, দামেস্কো, আলেপ্পো ও সারমিন ছিল সাবান তৈরিতে বিখ্যাত।

সর্বপ্রথম হাসপাতাল ঃ চিকিৎসার কথা উঠলে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে চলে আসে চিকিৎসক ও হাসপাতালের নাম। হাসপাতাল নেই এমন মানবসভ্যতা আজকের বিশ্বে চিন্তাই করা যায় না। আর মানবসেবার এই উৎকৃষ্ট স্থানটির প্রচলন শুরু হয়েছিল সর্বপ্রথম মুসলিমদের হাত ধরেই। মানুষের চিকিৎসা ও সুস্থতার স্বার্থে এই হাসপাতালের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছিলেন আহমদ ইবনে তুলুন। তিনি ছিলেন তুলুনিদ সাম্রাজ্যের একজন শাসক। পৃথিবীর ইতিহাসে নবম শতকে মিশরে সর্বপ্রথম হাসপাতাল ব্যবস্থার সূচনা হয়। আহমদ ইবনে তুলুন ৮৭২ সালে মিশরের রাজধানী কায়রোতে ‘আহমদ ইবনে তুলুন হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। নবম শতকে তিউনিসিয়ায় একটি হাসপাতাল প্রতিষ্ঠিত হয়। মধ্যযুগের এ সময়ে মুসলমানদের তৈরি সবচেয়ে ভালো বিস্তৃত বিন্যাস ও পরিবেশ বান্ধব হাসপাতাল শাসক ওদুদ আল ওয়ালিদ ৯৮২ সালে বাগদাদে নির্মাণ করেন। পরবর্তীতে হাসপাতাল ব্যবস্থার ধারণা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অর্থাৎ বিশ্বে চিকিৎসার জন্য এই যে হাসপাতাল ব্যবস্থা সর্বপ্রথম নিয়ে আসেন মুসলিমরা। ধীরে ধীরে গোটা বিশ্বে হাসপাতাল ব্যবস্থা চালু হয়।

প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় কারুইয়িন ঃ বিদ্যাপীঠের সর্বোচ্চ স্তর বিশ্ববিদ্যালয়। যেখান থেকে দেয়া হয় যোগ্য শিক্ষার্থীদের সনদ। কিন্তু কতজন জানেন, বিশ্বের সর্বপ্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাতা একজন মুসলিম নারী। ফাতিমা আল-ফিহরি বিশ্বের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ণধার। ৮৫৯ সালে উচ্চশিক্ষার অগ্রপথিক হিসেবে তিনি মরক্কোর ফেজ নগরীতে প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। ঐতিহাসিকদের মতে, এটি বিশ্বের প্রথম ও প্রাচীনতম সনদ বিতরণকারী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান বা বিশ্ববিদ্যালয়। রাণী ফাতিমা স্বয়ং নির্মাণ কাজের তদারকি করেছিলেন এবং নির্মাণ প্রক্রিয়ায় দিকনির্দেশনা দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ফাতিমার বোন মরিয়ম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশে একটি মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। তিউনিশিয়ার কাইরুয়ান থেকে ফাতিমার পরিবার মরক্কোর ফেজ নগরীতে চলে আসেন। নবম শতকের প্রথমভাগে অনেক পরিবারই পশ্চিমের এই ব্যস্ত নগরীর অভিবাসী হতে চাইতেন। ফেজ ছিল মুসলিম পশ্চিম তথা আল-মাগরেবের অন্যতম সম্ভাবনাময় নগরী, যা মানুষের মনে সৌভাগ্যের ধারণা ও পরম সুখের প্রতিশ্রুতি দিত। প্রভাবশালী এই ইসলামী নগরীতে ঐতিহ্যবাহী ও বিশ্বজনীন উভয় ধরনের ধর্ম ও সংস্কৃতির সমাবেশ হয়েছিল ( বাংলাদেশ প্রতিদিন ঃ ২০ আগস্ট ২০২১)।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।