নিউজ ডেস্কঃ
বাংলাদেশি প্রকৌশলী বাশিমা ইসলাম জানুয়ারিতে যোগ দিবেন ওরসেস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে। সৌরশক্তি আর রেডিও তরঙ্গের সাহায্যে ব্যাটারিবিহীন অবস্থায় চালানো যাবে—পরবর্তী প্রজন্মের এমন ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ ডিভাইস তৈরিতে গবেষণা করার জন্য চলতি বছরে বিশ্বের জনপ্রিয় প্রভাবশালী সাময়িকী ফোর্বস ম্যাগাজিনে বিজ্ঞান ক্যাটাগরিতে ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’-এ জায়গা করে নিয়েছেন। অপরদিকে তার স্বামী মো. তামযীদ ইসলাম কাজ করছেন অ্যামাজন ডটকম-এ। সম্প্রতি ইত্তেফাককে এক অনলাইন আড্ডায় তারা জানিয়েছেন তাদের বেড়ে ওঠা আর কাজ-কর্মের গল্প। বিশ্বমঞ্চে নিজেদের মেলে ধরা এই দম্পতির গল্প তুলে ধরেছেন তাসনিমুল হাসান উদয় ও ফরিদ উদ্দিন রনি
বুয়েটের ভর্তি পরীক্ষায় দুজনের মেধাক্রম ছিল পাশাপাশি। ভর্তিও হয়েছিলেন একই বিভাগে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে বন্ধুত্ব। একসাথে পথ চলতে চলতে সেই বন্ধুত্বের গল্পটাই একদিন খুঁজে পায় নতুন পরিচয়, জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেন একে অপরকে। এর পরের গল্পটা শুধুই সফলতার। বিশ্ববিদ্যালয়ের গন্ডি পেরিয়ে এই মেধাবী দম্পতি বিশ্বমঞ্চে বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করছেন তাদের গবেষণাকর্ম দিয়ে।
পরবর্তী প্রজন্মের ব্যবহারযোগ্য ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ গবেষণা কাজের স্বীকৃতি হিসেবে চলতি বছরে যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’তে জায়গা করে নিয়েছেন বাশিমা। অপরদিকে তার স্বামী তামযীদ কাজ করছেন অ্যামাজনের ইকো ডিভাইসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক উন্নয়নে।
বাশিমা-তামযীদ দম্পতির সফলতার গল্প শুনে হয়ত মনে হবে শুধু বই আর টেবিলে বন্দি ছিল তাদের ছাত্রজীবন; বিষয়টি মোটেও সত্য নয়। বরং স্কুল এবং কলেজে থাকাকালীন সময় থেকেই পড়ালেখার পাশাপাশি সায়েন্স ক্লাব, বিতর্ক, সাংস্কৃতিক চর্চাসহ বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় দৌড়ঝাঁপ ছিল তাঁদের। কলেজে থাকাকালীন বাশিমা ছিলেন ভিকারুননিসা সায়েন্স ক্লাবের জেনারেল সেক্রেটারিও। স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে কর্মজীবনে এসেও সেই অভিজ্ঞতা তাকে অনেক বেশি সাহায্য করছে। তার আত্মবিশ্বাসী বেড়ে উঠার পেছনে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অবদান মূখ্য ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করেন তিনি।
বিজ্ঞানের প্রতি ভালো লাগা থেকেই ধীরে ধীরে তিনি প্রকৌশল নিয়ে পড়াশোনায় আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এইচএসসির গন্ডি পেরিয়ে ভর্তি হন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। অপরদিকে তামযীদেরও ছোটবেলা কেটেছে ঢাকায়। গভর্নমেন্ট ল্যাবরেটরি হাই স্কুল থেকে এসএসসি এবং ঢাকা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করার পর তিনিও বুয়েটের একই বিভাগে ভর্তি হন। স্কুল-কলেজে তিনিও ছিলেন নানান সহশিক্ষামূলক কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত। ছেলেবেলায় অনেকটা না বুঝেই স্বপ্ন দেখতেন নাসার বিজ্ঞানী হবেন। তবে গবেষণার প্রতি তার ভালোবাসাটা তৈরী হয় ধীরে ধীরে। বুয়েটে আসার পর তিনি সেই আগ্রহের জয়গাকে আরো সমৃদ্ধ করেন শিক্ষক এবং অগ্রজদের দিকনির্দেশনায়।
বাশিমা-তামযীদ দম্পতি
বুয়েটের শেষ বর্ষে পড়তে পড়তেই বাশিমা এবং তামযীদ যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডির জন্য আবেদন করেন। যথারীতি স্নাতক সম্পন্ন করে দু’জনে ইউনিভার্সিটি অব নর্থ ক্যারোলাইনা থেকে পিএইচডি ডিগ্রি নিয়েছেন। এরমাঝে তারা দুজনেই গবেষণা ক্ষেত্রে কিছু ছোটখাটো অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। সহপাঠী হওয়ার সুবাদে দু’জন একসাথে বেশ কিছু প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেন। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের পতাকা হাতে রাশিয়ায়তেও গিয়েছেন মাইক্রোসফট ইমাজিন কাপে অংশ নিতে।
বাশিমা তার গবেষণার মাধ্যমে ‘ইন্টারনেট অব থিংস’ বা আইওটি ডিভাইসগুলোতে ব্যাটারির ব্যবহার কমিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়ানোর জন্য কাজ করছেন। মূলত ব্যাটারির ব্যবহার কমিয়ে বিকল্প প্রাকৃতিক শক্তির উৎসগুলো ব্যবহার বৃদ্ধি করাই তার এই গবেষণার মূল উদ্দেশ্য। তাছাড়াও কম শক্তি ব্যবহার করে ডিভাইসগুলোর কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন তিনি। এই নিয়ে বাশিমা বলেন, ‘আমার মাথায় সব সময় চিন্তাভাবনা আসতো, কীভাবে ব্যাটারির বিকল্প ব্যবহার করতে পারি, যা আরো টেকসই প্রযুক্তি তৈরি করবে। সোলার হতে পারে আবার বিকল্প হিসেবে রেডিও ফ্রিকোয়েন্সিও হতে পারে। আমাদের আশপাশে যে ইন্টারনেট অব থিংস আছে তা হয়ত ৩৫ সাল পর্যন্ত পৌঁছাবে। কিন্তু তার বাইরে কী হতে পারে, তা নিয়ে ভেবে এ প্রযুক্তি উন্নয়ন নিয়ে কাজ শুরু করা।’
তিনি বলেন, ‘যন্ত্রপাতি চালাতে যেসব ব্যাটারি লাগবে তা যে শুধু পরিবেশ বান্ধব নয় তা নয়, এগুলোর খরচও অনেক। এই চিন্তাভাবনা থেকে আমরা ব্যাটারিবিহীন সোলার সিস্টেম বা রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি দিয়ে যন্ত্রপাতি চালানোর প্রযুক্তি উন্নয়নে কাজ করছি।’ আড্ডার ফাঁকে বাশিমা আরো বলেন, ধরুন আমরা উদাহরণ হিসেবে এক জোড়া জুতো নিতে পারি, এ জুতো পরে হাঁটার সময়, আমাদের উদ্ভাবন প্রযুক্তি বলে দিবে কতটুকু হাঁটা হয়েছে, দৈনিক কতটুকু হাঁটা শরীরের জন্য উপকার কিংবা কত স্প্রেড এ হাঁটতে হবে এতে লাগবে না কোন ব্যাটারি; এ প্রযুক্তির সাহায্যেই হবে সব। এ প্রযুক্তি ভবিষ্যতে মানুষের জীবনযাত্রাকে আরো সহজ করে দিবে। সৌরশক্তি এবং রেডিও ফ্রিকোয়েন্সি ব্যবহার করে চার্জিত হবে। এসব ডিভাইস পথচারীদের নিরাপত্তা দিতে সহায়তা করবে। শব্দতরঙ্গ ব্যবহার করে যানবাহন থেকে পথচারীদের নিরাপদ রাখবে এবং সিকিউরিটি নিশ্চিত করবে।’
এই গবেষণার স্বীকৃতি হিসেবে বাশিমা যুক্তরাষ্ট্রের সাময়িকী ফোর্বসের ‘থার্টি আন্ডার থার্টি’-তে জায়গা করে নিয়েছেন। ফোর্বস প্রতিবছর ২০টি ক্যাটাগরিতে ৩০ জন করে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রকাশ করে। যাদের প্রত্যেকের বয়স ৩০ বছরের নিচে। দৈনন্দিন জীবনে ব্যবহার্য সামগ্রীর সাথে আইওটি প্রযুক্তি যুক্ত করা এবং আরো সহজ ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য কাজ করতে চান তিনি। এছাড়াও চিকিৎসা এবং কৃষিখাতে ইন্টারনেট অব থিংকসের ব্যবহারকে আরো বিস্তৃত করতে চান বাশিমা।
অন্যদিকে পিএইচডি চলাকালীন সময়ই তামযীদ তিনটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করেন। শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ করেছেন মাইক্রোসফট এবং অ্যামাজনের মতো প্রতিষ্ঠানের সাথে। গবেষক হিসেবে নতুন নতুন সমস্যা সমাধানের কাজকে বেশ উপভোগ করেন তিনি। বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণাকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং শিক্ষার্থীদের আগ্রহ তৈরীর ক্ষেত্রে নীতিনির্ধারণী পর্যায় থেকে সঠিক দিকনির্দেশনা দেয়া গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তামযীদ।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের তরুণ গবেষকদের জন্য তামযীদ বলেন, ‘প্রথমেই নিজের পছন্দের বিষয় খুঁজে বের করতে হবে। এর পরপরই সে নির্দিষ্ট ক্ষেত্রে কি ধরণের গবেষণা হচ্ছে সারা পৃথিবীজুড়ে—তা সম্পর্কে জানা প্রয়োজন। নতুনদের বলব, একদম শুরুতেই কঠিন বিষয় নিয়ে কাজ না করে সহজ সমস্যা সমাধানের জন্য কাজ করা উচিত। পাশাপাশি নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং সাবেক শিক্ষার্থী যারা গবেষণার সাথে যুক্ত তাদের পরামর্শও অনেক বেশি সাহায্য করে।’
বাশিমা বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় অ্যাট আরবানা শ্যাম্পেইন এর অধ্যাপক ন্যান্সি ম্যাক এলওয়েন এবং অধ্যাপক রমিত রয় চৌধুরীর সাথে পোস্ট ডক্টরাল গবেষণা সহযোগী হিসেবে কাজ করছেন। ২০২২ সাল থেকে ওরসেস্টার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটে (ডব্লিউপিআই) এ ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে সহকারী অধ্যাপক হিসেবে যোগদানের কথা রয়েছে তার। অপরদিকে তামযীদ ইসলাম অ্যামাজনের ইকো ডিভাইসের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জন্য ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক উন্নয়নে কাজ করছেন। এ দম্পতি বিদেশের বুকে নিজেদের মেলে ধরেছেন, যেন একখণ্ড বাংলাদেশ রুপে। সে এক খণ্ড বাংলাদেশের গল্প সবার কাছেই পৌঁছে যাওয়াই কাম্য!