বিশেষ প্রতিনিধিঃ
করোনার প্রভাবে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। যার প্রভাব পড়েছে রেমিট্যান্স নির্ভর পরিবারগুলোর ওপর। নিম্ন আয়ের এ পরিবারগুলো অন্য-বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিত্সাসহ প্রাত্যহিক খরচ মেটাত এই রেমিট্যান্সের টাকায়। এ পরিবারগুলোকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা না হলে দারিদ্র্যের ফাঁদে পড়ার আশঙ্কা করেছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)।
বৃহস্পতিবার ‘এশিয়ান ইকনোমিক ইন্টিগ্রেশন রিপোর্ট (এইআইআর) ২০২২’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে এই আশঙ্কা করা হয়। ২০২০ সালে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশে করোনার প্রকোপ শুরু হয়। সেই সময়ে রেমিট্যান্স গ্রহীতা পরিবারগুলোর ওপর ধারাবাহিক জরিপ পরিচালনা করে এডিবি। বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কা কাটাতে সরকারিভাবে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কর্মসংস্হানের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন উদ্যোগ যেমন নগদ সহায়তা, মজুরি সহায়তা, কর্মসংস্হানবান্ধব কর্মসূচিও রয়েছে। কিন্তু সামাজিক সুরক্ষার এসব উদ্যোগ প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলোতে পৌঁছানোর উপযোগী নয়। অথচ ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকদের পরিবারগুলোতে আর্থিক সহায়তা খুবই প্রয়োজন।
বাংলাদেশের রেমিট্যান্স প্রবাহের বিশ্লেষণ করে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালের মার্চে রেমিট্যান্স প্রবাহ সাড়ে ১২ শতাংশ কমে যায়। এপ্রিলে কমে প্রায় ২৪ শতাংশ। মে মাসে কমে প্রায় ১৪ শতাংশ। তবে ঐ বছর জুন মাস থেকে রেমিট্যান্স ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে। রেমিট্যান্স প্রেরণে ২ শতাংশ প্রণোদনা ঘোষণা করা হয়। ২০২০ সাল শেষে সার্বিকভাবে ১৮ দশমিক ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয় রেমিট্যান্সে। রেমিট্যান্সের এই ধাক্কা পরিবারগুলোতে কী প্রভাব ফেলেছে সেটি বিশ্লেষণে তিন দফায় করা জরিপের তথ্য উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। ২ হাজার ২১১ পরিবারে টেলিফোনে করা জরিপের তথ্য বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মার্চ থেকে মে মাস পর্যন্ত পরিবারগুলো গড়ে রেমিট্যান্স পেয়েছে মাত্র ৬ হাজার ৩৮০ টাকা করে। অথচ করোনার আগে প্রতি মাসে পরিবারগুলো গড়ে ১৮ হাজার ২৫৫ টাকা করে রেমিট্যান্স গ্রহণ করত। অর্থাৎ ঐ সময়ে গড়ে ৬৫ শতাংশ কম টাকা পেয়েছে পরিবারগুলো। জুলাই থেকে আগস্ট সময়কালে রেমিট্যান্স গ্রহণের পরিমাণ বাড়তে থাকে।
মে মাস থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়ে ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকা করে পেতে থাকে পরিবারগুলো। তবে মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত অন্তত ২৫ শতাংশ প্রবাসী শ্রমিক দেশে ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছে। নানা চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও ২০২০ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আহরণ বাড়তে থাকে। কিন্তু প্রবাসে কাজ হারানো শ্রমিকদের পরিবারগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। প্রবাসী এই কর্মীদের প্রেরিত রেমিট্যান্সের মাধ্যমে পরিবারগুলো অন্ন-বস্ত্র, স্বাস্হ্য, শিক্ষাসহ নিত্য খরচে ব্যয় করে থাকে। কারণ তাদের অনেকেরই বিকল্প কোনো আয়ের উত্স নেই।
আইওএম এর এক জরিপের তথ্য উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০২০ সালে প্রবাসী শ্রমিক যারা দেশে ফিরে এসেছে তাদের মধ্যে ৭০ শতাংশ কাজ খুঁজে পেতে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছে। করোনার আগে ২০১৯ সালে বাংলাদেশ থেকে ৭০ লাখ মানুষ প্রবাসে গমন করেছিল। কিন্তু ২০২০ সালে এই সংখ্যা দুই-তৃতীয়াংশ নেমে আসে। ২০২০ সালে মাত্র ২১ লাখ ৭৬ হাজার মানুষ বিদেশে গমন করে। এসময়ে সৌদির বাজারে প্রায় ৬০ শতাংশ, সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৬৭ শতাংশ এবং কাতারে প্রায় ৯৩ শতাংশ গমন কমেছে। তবে ২০২১ সালের প্রথম পাঁচ মাসের হিসাবে এসব দেশে উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।
এডিবির প্রতিবেদনে এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোতে রেমিট্যান্স, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং বাণিজ্যের বিশ্লেষণ করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, এশিয়া ও প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্যের আকার গত তিন দশকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে। ২০২১ সালের প্রথম তিন প্রান্তিকে (জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর সময়ে) এই অঞ্চলে বাণিজ্যের আকার বেড়েছে ২৯ দশমিক ৬ শতাংশ। এই সময়ে সার্বিক ভাবে বিশ্বে বাণিজ্য বেড়েছে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ। করোনার ধাক্কায় ২০২০ সালে বাণিজ্য প্রবৃদ্ধি না হয়ে উল্টো সংকোচন হয়েছিল ৩ শতাংশে বেশি। তবে সার্বিক ভাবে এই অঞ্চলের অর্থনীতি ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে।
প্রতিবেদনে এডিবির প্রধান অর্থনীতিবিদ আলবার্ট পার্ক বলেছেন, এশিয়া এবং প্যাসিফিক অঞ্চলে বাণিজ্য বৃদ্ধির তথ্যে দেখা যাচ্ছে যে, করোনার ধাক্কা কাটিয়ে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। তবে করোনার প্রভাবে অর্থনীতির ক্ষতিও দৃশ্যমান হয়েছে। বহুদেশে দারিদ্র্য হার কমানোর গতি কমে গেছে। টেকসই এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক উন্নয়নে আঞ্চলিক সহযোগিতা দৃঢ় করার আহ্বান জানান তিনি।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।