মীর লিয়াকত : অতি সম্প্রতি আততায়ীর গুলিতে নিহত হলেন জাপানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শিনজো আবে! তাঁর মৃত্যুতে বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় শোক পালিত হয়। আবে ছিলেন জাপানের ৯৬ তম প্রধানমন্ত্রী। জন্ম ২১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৪ টোকিও, জাপান। মৃত্যু ৮ জুলাই ২০২২ । তার রাজনৈতিক দল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (জাপান) দাম্পত্য সঙ্গী আকিয়ে মাতসুজাকি।
শিনজো আবে একজন জাপানি রাজনীতিবিদ ছিলেন, যিনি ২০০৬-২০০৭ সালে এবং ২০১২ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পর্যন্ত জাপানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। সম্প্রতি ২০২২ সালে নির্বাচনী প্রচারণা চালানোর সময় তিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হন। তিনি জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে দীর্ঘ মেয়াদী প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।
২০১৩ সালে আবে জাপানের সংসদে এক ঘোষণাতে বলেন যে জাপানের অর্থনীতিকে পুনরুজ্জিবীত করা ও ইয়েনের মানের অবনতি ঠেকানো জাপানের জন্য “সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরী বিষয়। তার দেয়া অর্থনৈতিক কৌশল ইংরেজিতে অ্যাবেনমিকস (অনবহড়সরপং) নামে পরিচিতি পেয়েছে। এটি তিনটি “তীর” নিয়ে তৈরি একটি নীতি। প্রথম তীর হল ২% মুদ্রাস্ফীতি অর্জন, দ্বিতীয়টি হল সংক্ষিপ্ত মেয়াদের জন্য অর্থনীতিকে চাঙা করার জন্য এবং পরবর্তীতে বাজেটে উদ্বৃত্ত অর্জনের জন্য একটি পরিবর্তনীয় আর্থিক নীতি এবং তৃতীয়টি হল দীর্ঘমেয়াদী প্রবৃদ্ধির জন্য বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও কাঠামোগত সংস্কার। ২০২০ সালের ২৮শে আগস্ট শারীরিক অসুস্থতার কারণে তিনি পদত্যাগ ঘোষণা করেন ।
হাউস অফ কাউন্সিলর নির্বাচনের দুই দিন আগে নারাতে প্রচারাভিযানের বক্তৃতা দেওয়ার সময় ৮ জুলাই ২০২২-এ জাপান মান সময় সকাল ১১:৩০ টায় আবেকে হত্যা করা হয়েছিল। তাঁর হৃদ ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বলে জানা যায় এবং গুলি করবার পর অবিলম্বে এর কোনো উল্লেখযোগ্য লক্ষণ দেখা যায় নি। অভিযুক্ত শুটার ৪১ বছর বয়েসী ইয়ামাগামি তেতসুয়াকে মেট্রোপলিটন পুলিশ হত্যা চেষ্টার অভিযোগে গ্রেপ্তার করে। একই দিন দুপুরে নারা মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে আবে তাঁর ক্ষতবিক্ষত দেহ নিয়ে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আবে হলেন ষষ্ঠ সাবেক জাপানি প্রধানমন্ত্রী যিনি হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন। ১৯৯৩ জাপানের প্রতিনিধি পরিষদে নির্বাচিত । ১৯৯৯ স্বাস্থ্য ও কল্যাণ কমিটির পরিচালক এবং লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) সোশ্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক হয়েছেন। ২০০০-২০০৩ শিনজো আবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) ডেপুটি চিফ ক্যাবিনেট সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০৫-২০০৬ এলডিপির মুখ্য সচিব ২০০৬ প্রথমবারের মতো জাপানের প্রধানমন্ত্রী হন শিনজো আবে ২০০৭ ১২ সেপ্টেম্বর পদত্যাগের ঘোষণা দেন । শিনজো আবে লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টির (এলডিপি) নেতৃত্বের জন্য রান অফ নেতৃত্ব নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। একই বছরের ২৬ ডিসেম্বর আবে জাপানের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। ২০১৭ শিনজো আবে ২২ অক্টোবর একটি স্ন্যাপ নির্বাচনে একটি দুর্দান্ত বিজয় দেখেছিলেন। ২০২০ শিনজো আবে ২৮শে আগস্ট জাপানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
জাপান পূর্ব এশিয়ার একটি দ্বীপ রাষ্ট্র। এই দেশটি প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে জাপান সাগর, পূর্ব চীন সাগর, চীন, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও রাশিয়ার পূর্ব দিকে উত্তরে ওখোৎস্ক সাগর থেকে দক্ষিণ পূর্ব চীন সাগর ও তাইওয়ান পর্যন্ত প্রসারিত। যে কাঞ্জি অনুসারে জাপানের নামটি এসেছে, সেটির অর্থ “সূর্য উৎস”। জাপানকে প্রায়শই “উদীয়মান সূর্যের দেশ” বলে অভিহিত করা হয়।
জাপান একটি যৌগিক আগ্নেয়গিরীয় দ্বীপমালা। এই দ্বীপমালাটি ৬,৮৫২টি দ্বীপ নিযয় গঠিত। জাপানের বৃহত্তম চারটি দ্বীপ হল হোনশু, হোক্কাইদো, ক্যুশু ও শিকোকু। এই চারটি দ্বীপ জাপানের মোট ভূখণ্ডের ৯৭% এলাকা নিয়ে গঠিত। জাপানের জনসংখ্যা ১২৬ মিলিয়ন। জনসংখ্যার হিসেবে এটি বিশ্বের ১০ম বৃহত্তম রাষ্ট্র।
এই জাপানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কোনও মন্দির নেই, মসজিদ নেই, রাত জেগে ওয়াজ নেই, কীর্তন কিংবা ধর্মীয় স্কলার নেই, মাজার নেই, বাবা, গুরু,পীর নেই, আমরা শ্রেষ্ঠ জাতি বলেও কোনও বাগাড়ম্বর নেই। এগুলো ছাড়াই জাপান একটা সুশৃঙ্খল জাতি।
গত ত্রিশ বছরের মধ্যে কোনও দুর্নীতি নেই, কোনও ঘুষ নেই, কোনও ধর্ষণ নেই, স্কুলে কোনও ছাত্রকে বেত্রাঘাতের রেকর্ড নেই। কোনও কাজের জন্য কোনও ফাইল আটকে পড়ার নজির নেই। কারো সুপারিশ ছাড়া কোনও ছাত্র স্কুলে ভর্তি হতে পারছে না, কারো প্রমোশন হচ্ছে না- এমন দৃষ্টান্তও নেই। দলীয় ভাবে জাপানের কোনও বিশ্ববিদ্যালয়ে কোনও শিক্ষকের নিয়োগের নজিরও নেই। রাস্তায় পড়ে থাকা বুভুক্ষু মানুষও নেই। আছে শুধু কর্মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা।
ভূমিকম্পের সময় সব খাবার ক্যাম্পে রেখে দেয়া হয়েছিলো। নিজের প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কেউ একটা রুটিও নিয়ে যায়নি। ত্রাণ কেন্দ্রে একজন প্রহরীকেও পাহারাদার রাখতে হয়নি। লাইন দাঁড়িয়ে সবাই যার যার মতো প্রয়োজনীয় খাবার নিয়ে গেছে। লাইন দাঁড়ানো শেষ ছেলেটির হাতে খাবার প্যাকেট দেয়ায় -সে সেই প্যাকেট আবার লাইনের সামনে রেখে এসেছে। যদি তার সামনে দাঁড়ানো কারো খাবার কম পড়ে যায়। মানবিক মূল্যবোধ তাদের এমনি!
জাপানে কোনও কালো বাজারি দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে মানুষকে জিম্মি করে না। কেউ খাবারে ভেজাল মেশায় না। রাস্তাঘাট গুলো এতো ঝকঝকে পরিষ্কার। নিজের চেহারা রাস্তায় দেখা যায়। শুধু বয়স্ক কিংবা যুবকরা না একজন শিশুও জাপানের রাস্তায় যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে রাখে না। কোনও প্রোগ্রাম এক মিনিট দেরিতে শুরু হয় না।
এক মিনিট ট্রেন লেট করেছিলো বলে – পত্রিকার পাতায় ক্ষমা চাওয়া হয়েছিলো। টেকনোলজি আর ডেভেলপমেন্টে জাপান পৃথিবী থেকে দশ বছর এগিয়ে আছে। পুরো পৃথিবীর খাবার ফুরিয়ে গেলেও জাপানে আগামী ত্রিশ বছরের জন্য খাবার মজুদ আছে। বোমায় কয়লা হয়ে যাওয়া জাপান পুরো দুনিয়ার গাড়ীর বাজারে নেতৃত্ব দিচ্ছে। অথচ, জাপানে ভার্চুয়ালি কোনও ন্যাচারাল রিসোর্স বলতে কিছুই নেই। জাপানের মানুষের মাঝে আছে শুধু বিনয় আর বিনয়। আর ক্ষমা প্রার্থনা। অবসরে যাওয়া জাপানি প্রধানমন্ত্রী বারবার বলছেন- কি করতে পেরেছি তার জন্য দয়া করে গুণ কীর্তন করবেন না। বরং যা করতে পারিনি সেটার জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। দু হাত একসাথে করে- জনগণের সামনে মাথা নীচু করে (যেটা জাপানি কালচার) বারবার ক্ষমা চাচ্ছিলেন জাপানের বিদায়ী প্রধানমন্ত্রী সিনজো আবে, অতি সম্প্রতি যিনি আততায়ীর গুলিতে প্রান হারালেন।
ধর্মের দোষ দিচ্ছি না, মসজিদ কিংবা মন্দিরেরও না, মাজারেরও না। শুধু আত্ম-সমালোচনা করছি।
আমাদের মোড়ে মোড়ে এতো এতো মসজিদ, মন্দির, গলিতে গলিতে এতো মাজার হওয়ার পরও পরিবর্তন হচ্ছে না কেন? আমাদের তো নানা ধরনের পরিবর্তন প্রয়োজন ছিলো, উন্নতি প্রয়োজন ছিলো। উন্নতি যে আমাদের হয়নি একথা বলা যাবে না। কিন্তু কাঙ্খিত উন্নতি কি হয়েছে? দুর্নীতি থেকে আমরা কেন বেরিয়ে আসতে পারছি না? দূর্যেগের সময় জাপানে ত্রাণসামগ্রী এনে রেখে দিলে তারা নিজেদের প্রয়োজন অনুযায়ী নিয়ে যায়, আর আমরা ত্রাণ নিয়ে করি কি যে কামড়াকামড়ি! ট্রেন এক মিনিট লেট হলে তারা ক্ষমা চায়। আমাদের ঘন্টার পর ঘন্টা লেট হলে অভিযোগ করারও স্থান নেই, ক্ষমা চাওয়া তো দূরের কথা! তাই আমাদের আত্ম সমালোরোচনা বড় বেশি প্রয়োজন নয় কি?
মীর লিয়াকত
সব্যসাচী লেখক ও সংস্কৃতিজন
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।