সম্পাদকীয়: ভাড়াভিত্তিক তরল জ্বালানিনির্ভর কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপিত হতে থাকে। উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার সঙ্গে তাদের দিতে হয় নির্দিষ্ট ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)। এই ভাড়া দিয়ে যাওয়ার চুক্তি হয়, এমনকি কেন্দ্র বিদ্যুৎ উৎপাদন না করলেও। এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও হাজার হাজার হাজার কোটি টাকা কুইক রেন্টাল কোম্পানির মালিকদের (ক্ষমতাসীনদের অলিগার্ক) হাতে তুলে দেওয়ার গল্প আমরা জানি। দুই বছরের কথা বলে আইনটি করা হলেও এর মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনের সক্ষমতা তার সর্বোচ্চ চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ হয়ে গেলেও এই আইনের মেয়াদ বাড়তে বাড়তে ১৬ বছরে এসে ঠেকেছে।ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম সাম্প্রতিক কালে খুবই আলোচিত বিষয়।
প্রতিটি দুর্যোগ—হোক সেটা প্রাকৃতিক (ভূমিকম্প, টাইফুন) কিংবা মানবসৃষ্ট (নাইন–ইলেভেন, ইরাক যুদ্ধ), সেটা কিছু মানুষের জন্য এক বিরাট অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তৈরি করে। ফিলিপাইনে টাইফুন হায়ানের বিপর্যয় ঘটেছিল বলে সেখানে উপকূলীয় এলাকা থেকে সাধারণ মানুষদের উচ্ছেদ করা সম্ভব হয়েছিল। পরে সেটা বিরাট ধনীদের বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এ ছাড়া নানা রকম ব্যবসা করতে পেরেছিল সরকারের ঘনিষ্ঠ ধনীরা।বিদ্যুতের চরম বিপর্যয়ে এ দেশের মানুষ পড়ে গিয়েছিল বলেই রীতিমতো ইনডেমনিটি দিয়ে সরকারের সঙ্গে সংযুক্ত কিছু মানুষকে অকল্পনীয় লাভের প্রকল্প দেওয়া হয়েছিল। পরে পরিস্থিতি অনেকটা স্বাভাবিক হয়ে এলে যখন মানুষ বিদ্যুৎ খাতের এই লুটপাট নিয়ে প্রশ্ন করেছিল, তখন তাদের শোনানো হয়েছিল, বিদ্যুৎ বন্ধ করে দিয়ে আমাদের বোঝানো দরকার, আমরা আগে কী পরিস্থিতিতে ছিলাম। বৈশ্বিক বাজারে জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি আর দেশের রিজার্ভের ওপর চাপ তৈরি হওয়ার প্রেক্ষাপটে সরকার এখন বিদ্যুৎ উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে। ফলে দেশে তীব্র গরমের মধ্যে এখন আবার দীর্ঘ লোডশেডিং হচ্ছে। আমরা এখন প্রশ্ন তুলছি, কেন দীর্ঘকাল অলিগার্কদের হাতে এভাবে অকল্পনীয় পরিমাণ অর্থ ভর্তুকির নামে তুলে দেওয়া হয়েছে? কেন রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে আরও অনেক আগেই বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা হয়নি? জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য কেন দেশের স্থলভাগে এবং সমুদ্রসীমায় গ্যাস অনুসন্ধান করে উত্তোলন নিশ্চিত করা হয়নি?
আমরা নিশ্চিত থাকতে পারি, বিদ্যুৎহীনতার পরিস্থিতিটা দীর্ঘ সময় চলতে থাকলে সেটা আমাদের ওপর যে নানামুখী প্রভাব ফেলবে, তাতে ‘ডিজাস্টার ক্যাপিটালিজম’ তত্ত্ব অনুযায়ী, আমরা যারা প্রশ্ন তুলছি, তাদের কণ্ঠস্বর ক্রমাগত ম্রিয়মাণ হতে থাকবে এবং সরকার বিদ্যুতের দাম অনেকটা বাড়ানোর মাধ্যমে সংকট সামাল দেওয়ার প্রস্তাব দিলে আমরা সেটা মেনে নেব। নিশ্চয়ই মানুষ বিদ্যুৎহীন থাকার চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়েও বিদ্যুৎ কেনার পক্ষেই থাকবে।
বাংলাদেশ এখন বিপর্যয়কেন্দ্রিক পুঁজিবাদের এক অসাধারণ উদাহরণ। এখানে আগে থেকে থাকা দীর্ঘ (বিদ্যুৎ–ঘাটতি) কিংবা হঠাৎ আসা স্বল্পমেয়াদি (করোনার সময় টিকা) দুর্যোগের সুযোগ যেমন নেয় ক্ষমতাসীনেরা, তেমনি দুর্যোগ তৈরি করে (ঢাকার যানজট) তাতে মানুষকে ফেলে তাদের নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আরেকটি কথা, বাংলাদেশের ক্ষেত্রে ‘পুঁজিবাদ’ শব্দটি প্রতিস্থাপন করে ‘বিপর্যয়কেন্দ্রিক লুটপাট’ বললেও খুব বেশি আপত্তি শোনা যাবে না নিশ্চয়ই।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।