ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসামে ভয়াবহ বন্যার জন্য স্থানীয় মুসলিম সম্প্রদায়কে দায়ী করার দাবি অনলাইনে প্রচার শুরু হয়েছিল। কিন্তু এসব অভিযোগের কি কোনো সত্যতা ছিল? অভিযুক্তদের একজন বিবিসিকে তার গল্প বলেছেন।
৩ জুলাই ভোররাতে পুলিশ তার দরজায় কড়া নাড়লে নাজির হোসেন লস্কর হতবাক হয়ে যান। কয়েক বছর ধরে, তিনি আসামে নির্মাণ শ্রমিক হিসেবে কাজ করেছেন, রাজ্যে বন্যা সুরক্ষা বাঁধ নির্মাণ তৈরিতে সহায়তা করেছেন। কিন্তু, ওই দিন সকালে, পুলিশ সদস্যরা লস্করকে ‘সরকারি সম্পত্তির ক্ষতি করার’ অভিযোগে গ্রেপ্তার করে।
লস্কর বলেন, ‘আমি বেড়িবাঁধ নির্মাণের জন্য সরকারের জন্য ১৬ বছর কাজ করেছি। কেন আমি এর ক্ষতি করব?’
লস্কর জামিনে মুক্তি পাওয়ার আগে প্রায় ২০ দিন কারাগারে কাটাতে হয়েছে। অভিযোগে তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে তাকে ঘিরে ওই সময়েই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঝড় ওঠে। সামাজিক যোগাযোগামাধ্যম কোনো ধরনের প্রমাণ ছাড়াই দাবি করা হয়, রাজ্যে এই বন্যা মানবসৃষ্ট এবং একদল মুসলিম পুরুষ ইচ্ছাকৃতভাবে প্রতিবেশী হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ শহর শিলচরে বন্যা প্রতিরক্ষার ক্ষতি করে প্লাবিত করেছিল।
লস্করের সঙ্গে আরও তিন মুসলিম পুরুষকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাদের বিরুদ্ধে ‘বন্যা জিহাদ’ চালানোর অভিযোগের বন্যা বয়ে যায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এই পোস্টগুলো হাজার হাজার বার শেয়ার করা হয়েছে। যারা শেয়ার করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রভাবশালীরাও ছিলেন। কিছু স্থানীয় সংবাদমাধ্যম বিষয়টি আরও উস্কে দেয়। একটি নিউজ চ্যানেল তাকে ‘বন্যা জিহাদে’ অভিযুক্তও করে।
ওই সময়টিতে কারাগারে থাকা লস্কর পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, ‘আমি ভয় পেয়েছিলাম এবং সেই রাতে ঘুমাতে পারিনি। অন্য বন্দীরা এটা নিয়ে কথা বলছিল। আমি ভেবেছিলাম আমার ওপর হামলা হতে পারে।’
আসামে গত মে ও জুন মাসে পরপর দুবার বন্যা পরিস্থিতি দেখা দেয়। ওই বন্যায় অন্ততপক্ষে ১৯২ জনের মৃত্যু হয়। যদিও রাজ্যটি প্রতি বর্ষা মৌসুমে বন্যা হয়, তবে চলতি বছর বৃষ্টি তাড়াতাড়ি এসেছিল এবং স্বাভাবিকের চেয়ে এর মাত্রা ভারী ছিল।
১৯৫০ এর দশক থেকে আসামে বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বাঁধ নির্মাণ শুরু হয়। রাজ্যে চার হাজার কিলোমিটারেরও বেশি বাঁধ রয়েছে এবং এর মধ্যে অনেকগুলি ভঙ্গুর এবং ঝুঁকিপূর্ণ বলে মনে করা হয়। ২৩ মে, উত্তর-পূর্ব ভারত এবং বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত বরাক নদীর উপর একটি বাঁধ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বেথুকান্দি নামের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল দিয়ে বন্যার পানি প্রবেশ শুরু হয়েছিল এবং এটি শিলচরে ভয়াবহ বন্যার কারণগুলোর মধ্যে এটি একটি।
মুম্বাইয়ের জামসেটজি টাটা স্কুল অব ডিজাস্টার স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক নির্মাল্য চৌধুরী বলেন, ‘বেড়িবাঁধ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের কারণে অনেক জায়গা ভেঙ্গে গেছে। এর কিছু কিছু মানবসৃষ্টও হতে পারে। এমন কিছু ঘটনাও হতে পারে যেখানে লোকেরা ইচ্ছাকৃতভাবে বাঁধ ভেঙ্গেছে, যাতে পানি চলে যায় এবং তাদের এলাকা প্লাবিত না হয়।’
শিলাচরের পুলিশ সুপার রমনদিপ কাউর বলেন, ‘আগের বছরগুলোতে প্রশাসন পানি নিষ্কাশনের জন্য নিজেরাই বাঁধ কেটে ফেলত। চলতি বছর এটি করা হয়নি এবং কিছু লোক নিজেরাই কাজটি করেছে।
অধ্যাপক নির্মাল্য চৌধুরী বলেন, ‘(বন্যা জিহাদ) এই ধরনের দাবি করা হল একটি সহজ অজুহাত বের করা। এটি ব্যবস্থাপনাগত সমস্যা এবং আমি মনে করি এর জন্য অনেক বেশি পরিপক্ক প্রতিক্রিয়া প্রয়োজন।’
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।