ফরহাদ মাজহার :: “প্রাণের আনন্দ, সহজ পথে”।। Sohoj Way to Ananda ।। এটা আমাদের নয়াকৃষি আন্দোলনের শ্লোগান।
আমাদের কাজ ও সংগঠন নিয়ে অনেকে প্রশ্ন করেন, উত্তর দেওয়া হয় না। সহজ পথে প্রাণের আনন্দ কিভাবে ফুটিয়ে তোলা যায় এই রকম একটা ভাব মাথায় নিয়ে আমরা কাজ করি। কথাটা বলা যতো সহজ বুঝিয়ে বলা কঠিন। বুঝতে হলে আমাদের সঙ্গে কিছুকাল নয়াকৃষি চর্চা না করলে তত্ত্ব হিশাবে বোঝানো কঠিন। নয়াকৃষি স্রেফ তত্ত্ব নয়, চর্চা। যে চর্চার নগদ কাজ হচ্ছে নতুন ভাবে চিন্তা করতে শেখা। গালে হাত দিয়ে ঘরে বসে সেটা হয় না। সেটা ঘটে কাজের মধ্য দিয়ে। কাজ করা মানে চিন্তা করাও বটে, কারন তা চর্চাকে যে কোন সময়আমূল বদলে দিতে পারে। । চিন্তা ও কাজ। কাজ ও চিন্তা। অভিন্ন।
কৃষিতে আমরা ফসলের বৈচিত্র্য আবাদ করি। তাই নয়াকৃষি প্রাণবৈচিত্র ভিত্তিক কৃষি। প্রাণের বৈচিত্র উদযাপনে মধ্যে প্রাণের স্ফূর্তি বলতে বাস্তবে আমরা কি বুঝি সেটা বোঝাই। প্রাণ নিয়েই আমাদের কারবার।
এবার উবিনীগের (উন্নয়ন বিকল্পের নীতিনির্ধারণী গেবেষণা) পরিকল্পনা সভার গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হচ্ছে ‘নয়াকৃষি’-কে আমাদের সামগ্রিক চিন্তা ও পরিকল্পনার কেন্দ্রে স্থান দেওয়া। শুধু কৃষি না – জীবনযাপন, জীবিকা, বিজ্ঞান, কৃৎকৌশল, সমাজ, রাষ্ট্র ইত্যাদি সকল ক্ষেত্রে প্রাণের সুরক্ষা ও বিকাশের প্রশ্নকে আমরা বাংলাদেশের উন্নতির কেন্দ্রে নিয়ে আসতে পারি। আমরা যেন সহজ পথে প্রাণের আনন্দ বা প্রাণের স্ফুর্তি ঘটাতে পারি। আনন্দ বা প্রাণের স্ফূর্তি যেন আমাদের সাধনার কেন্দ্রে মজবুত স্থান করে নিতে পারে। কিভাবে তা সম্ভব তা নিয়েই আমরা কথাবার্তা বলেছি। এইটুকু বুঝতে পারলে সাংগঠনিক বা প্রাতিষ্ঠানিক ভাবে আমরা কি করি এবং কিভাবে করি তার একটা ধারণা আমার বন্ধুরা পেতে পারেন।
প্রচলিত ‘উন্নয়ন’ ধারণার আমরা সমালোচনা করি, সেটা আসলে আখতার হামিদ খানের আমল থেকে আছে। আদতে সেই ‘উন্নয়ন’ পুঁজিতান্ত্রিক মুনাফাবাজ সম্পর্ক জবরদস্তি ওপর থেকে আরোপ করবার নীতি। সেটা জীবাশ্মভিত্তিক সভ্যতা এবং পুঁজিতান্ত্রিক পাশ্চাত্য সভ্যতা ওপর থেকে চাপিয়ে দেবার মডেল। বাংলার চির পরিচিত ‘উন্নতি’ কথাটা এরপর থেকে ইংরেজি ‘ডেভেলপমেন্ট’ -এর অনুবাদ হয়ে আমাদের মুখস্থ হয়ে গেল। পুঁজিতান্ত্রিক ‘উন্নয়ন’-কে আদর্শ জ্ঞান করে যে কায়কারবার সেটাই ‘ডেভেলপমেন্ট’। এরই বাংলা ‘উন্নয়ন’।
কিন্তু আমরা চাই উন্নতি। নত বা নতি অবস্থা থেকে শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়ানো। তাই আমরা ‘উন্নয়নের বিকল্প’ নিয়ে ভাবি। অর্থাৎ পুঁজিতগন্ত্রের বিকল্প বাংলাদেশ কি হতে পারে তা নিয়ে চিন্তা, ভাবনা এবং সুনির্দিষ্ট কাজ করে দেখানোকেই আমরা ভ্রত হিশাবে নিয়েছি।।
নয়াকৃষির শ্লোগান শুধু কৃষির জন্য আমরা দিতে শুরু করি নি। এবার আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আমাদের সকল কাজের অভিমুখ যেন সহজ পথে প্রাণের কথাটার তাৎপর্য ধারণ করতে পারে সেই দিকে আরও অধিক মনোযোগী হওয়া। তাই দুটো ধারণা বা বর্গ নিয়ে আমরা প্রচুর আলোচনা করেছি। তারা হোল, ‘সহজ’ ও ‘আনন্দ’।
প্রশ্ন হচ্ছে এই ‘সহজ’ পথটা কি? আমরা কেন বাগাড়ম্বরি ‘প্রবৃদ্ধি’ বা ‘উন্নয়ন’ না চেয়ে ‘আনন্দ’ চাই? কী অর্থ আনন্দের? কিভাবে এই ধারণাগুলো আমরা বাস্তবে আমাদের সকল প্রকার কাজে খাটাবো? এই নিয়েই অনেক আলোচনা হোল। ভাবের ও কাজের কথা। এ নিয়ে দুই একটি কথা বললে হয়তো অনেকের ভাল লাগতে পারে।
সহজ শব্দটি তৈরি সূত্র এরকম, সহ+জ = যা একসঙ্গে উৎপন্ন, যার জন্ম আলাদা আলাদা না – এই অর্থে। মানুষের চোখ আগে তারপর পা এবং তারপর হৃদপণ্ড এই ভাবে আমাদের বানানো হয় নি। এই ভাবে আমরা জন্মগ্রহণও করি না। ঠিক তেমনি আগে ইন্দ্রিয়, বুদ্ধি, কল্পনা বা এক কথায় মন আর মন থেকে আলাদা ভাবে দেহ তৈরি হয় নি। সবই একসঙ্গে উৎপন্ন হয়েছে। দেহ এবং মন আলাদা না, কিম্বা দেহ ও চিন্তাও পরস্পর থেকে পৃথক না। চিন্তা আকাশে ভেসে বেড়ায় না। মানুষকে এভাবে আলাদা করা আমরা রপ্ত করেছি পাশ্চাত্য আধুনিকতা থেকে। রেনে দেকার্তের সময়। এর ভালমন্দ সুফল-কুফল আমরা এখন বুঝি।
এই বিখণ্ডিভবনে থেকে বের হয়ে আসা দরকার। আমাদের সমস্ত কাজই পাশ্চাত্যকে এমন জায়গা থেকে মোকাবিলা করা উচিত যেন আমরা আমাদের ভাষা, ভাব ও ঐতিহ্যের শক্তি ধরতে পারি, বুঝি। অন্যদিকে পাশ্চাত্যের অর্জন পাশ্চাত্যের চিন্তা পরিমণ্ডলের মধ্যে থেকে নয়, বরং আমাদের নিজেদের ভাষা ও ভাবের মধ্যে আত্মস্থ করবার শক্তি আমরা নিজেরাই যেন অর্জন করতে পারি। মানবেতিহাসে চিন্তা বা ভাবের ক্ষেত্রে যে বিপ্লব ঘটেছে ‘প্রাচ্য’ নামক দেয়াল তুলে তাকে দূরে রাখার মতো বেয়াকুব হতে আমরা রাজি না। কিন্তু পাশ্চাত্য তার ঔপনিবেশিক এবং সাম্রাজ্যবাদী মিশন সফল করবার জন্য যা কিছু বাদ দিয়েছে, বাদ দিতে চায় কিম্বা আগামি দিনেও বাদ দেবার জন্য যুদ্ধবিগ্রহ করতে বাধ্য — আমরা তার বিরুদ্ধে লড়বার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে চাই।
অতিশয় বাংলা ‘সহজ’ কথাটিকে এই আলোকেই বুঝতে হবে। আমরা আমাদের ভাষায় বাস করি। অতএব বাংলা ভাষায় বাস করতে শিখতে হবে আমাদের। আধুনিকতার মন্দ দিকের মোচন ঘটাতে হলে ‘সহজ’ কথাটা সহজ ভাবে বুঝতে হবে। কিভাবে?
আমাদের দেহের সকল ইন্দ্রিয়গত তৎপরতা অর্থাৎ মন ও বুদ্ধির সকল বৃত্তি সহযোগে আমরা জগতের সঙ্গে ব্যবহারিক সম্বন্ধ রচনা করি। সেই সম্বন্ধ সম্পর্কে আমামদের সজাগ থাকতে হবে। সে সম্বন্ধকে আমলে নিয়ে নতুন ভাবে ভাবতে পারা এবং সজীব ও সক্রিয় চিন্তার চর্চাই ‘সহজ পথ’। কোন কিছু আমরা সহজে বুঝি যদি আমরা আমাদের বুদ্ধি ও মনের সকল ক্ষমতা বা বৃত্তিকে একসঙ্গে ব্যবহার করি। তার অর্থ দেহকে মন বা চিন্তা থেকে, কিম্বা চিন্তাকে শরীর থেকে আলাদা করে ভাববার অভ্যাস ত্যাগ করা। বুদ্ধির দরকার আছে, কিন্তু শুধু বুদ্ধিকে সর্দার মানলে হবে না। আমরা বাঙাল এবং দেহবাদী। দেহ বাদ দিয়ে বুদ্ধিকে সর্দার মানলে বিপর্যয় ঘটে – অতি প্রাচীন কাল থেকেই সেটা আমাদের শেখা ও জানা। দেহ মানে মানুষের শরীর না। পুরা প্রকৃতি জগতই আমাদের শরীর বা শরীরের সম্প্রসারণ। কারণ আমরা প্রকৃতির অন্তর্গত। বলা যায়, মানুষই ব্রহ্মাণ্ড। যা ভাণ্ডে তা ব্রহ্মাণ্ডে, কিম্বা যা ব্রহ্মাণ্ডে তাই ভাণ্ডে। বাংলা বেতর বাহিরের অভেদে আস্থা রাখে। এর সুফল আছে। সেটা আবিষ্কার করাই সহজ পথের কাজ।
আনন্দ = আ+নন্দ = বিস্তৃত খুশি। প্রাণের যে স্বাভাবিক স্ফূর্তি তার বিকাশের জন্য নয়াকৃষি কাজ করে। আনন্দ কেন? আমরা আগাম কোন লক্ষ্য নির্দিষ্ট করে কাজ করি না। আমাদের মধ্যে যে ‘প্রাণ’ বর্তমান তাকে আপন স্ফূর্তি বা বিকাশের জন্য যে কাজ দরকার সেই কাজই আমরা করি| তাই আনন্দ।
আগাম লক্ষ্য মানে কি? যেমন, মুনাফার জন্য, কিম্বা উৎপাদন বাড়াবার জন্য, কিম্বা কোন কিছু অসময়ে, মৌসুমের বাইরে, প্রকৃতির স্বভাবের বিপরীতে গিয়ে বানানো, ভোগ করার কুবুদ্ধি – ইত্যাদি আমরা করি না। অন্যের ওপর জুলুম করে কোন কিছু অর্জনও আনন্দদায়ক হতে পারে না। সেটা আমাদের লক্ষ্য না। অমানুষিক পরিশ্রম হলেও যে কাজে সকল প্রাণের স্ফূর্তি ও আনন্দ হয়, আমরা তাই করি।
এবার আমরা আমাদের আরশিনগর বিদ্যাঘরে সবাই মিলে বসেছি বুঝতে যে এই শ্লোগান নিয়ে আমরা কতোটা পথ পাড়ি দিতে পারলাম। নিজেদের নিজেরা জিজ্ঞাসা করে বুঝতে চেয়েছি আমরা আজ অবধি কি করেছি, কোনদিকে যাচ্ছি, কোথায় যাব? ইত্যাদি। একে সাধারণত ‘পরিকল্পনা সভা’ বলা হয়। আচ্ছা, তাই হোক। ‘সহজ’, ‘আনন্দ’ ইত্যাদি ধারণা নিয়েই আমরা আমাদের কাজের মূল্যায়ন করবার চেষ্টা করেছি। ভবিষ্যতের পরিকল্পনা করেছি।
কিন্তু কিসের পরিকল্পনা? এ ব্যপারে আমাদের মোটেও অস্ব-চ্ছতা ছিল না। এটা হচ্ছে আমাদের নিজেদের ‘উন্নতি’-র পরিকল্পনা। – অর্থাৎ নত অবস্থা থেকে শিরদাঁড়া খাড়া করে দাঁড়াবার হিম্মত অর্জন। মেরুদণ্ড আমাদের কতোটা মজবুত হয়েছে সেটা আমরা বুঝতে চেয়েছি। সেটা মাপা যায় নানান স্তরে। কিভাবে? আমাদের বোধবুদ্ধি বিচার ক্ষমতা বেড়েছে কিনা? আমরা কঠিন কথা সহজ ভাবে বলতে পারি কিনা? সাধারণ মানুষের ভাষা বুঝতে পারি কিনা? আমরা বুঝি কিনা যে আমরা এখন আর কোন, দেশ, ভূখণ্ড, জাতি বা ধর্মের অধীনে বাস করি না। আমরা বাস করি বিশ্বব্যাপী পুঁজির বৃত্ত ও বিচলনের মধ্যে। আমাদের প্রত্যকের মধ্য দিয়ে পুঁজি তার নিজের অস্তিত্ব উসুল করে নিচ্ছে। যেমন, ভোক্তা হিশাবে আমরা বাজার থেকে কিনে যা কিছুই খাই বা পরি সেটা পুঁজির বিচলন বাসবায়িত করা। মানুষের শ্রম শোষণ করে যে বাড়তি মূল্য পুঁজি উৎপাদন করে তা ভোক্তা ‘উসুল’ বা বাস্তবায়ন করে। আমরা পুঁজির বিচলন বাস্তবায়নের জন্য মাধ্যম বা উপায়ে পর্যবসিত হয়েছি। আমরাই পুঁজির হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থাকের টিকিয়ে রাখছি।
এটা পরিষ্কার, ‘পুঁজি’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা। ‘পুঁজি’ বুঝতে না পারলে আমরা কি ধরণের সম্পর্কে আগামিতে চাই, সেটা বুঝতে পারব না।
জ্ঞানগত পর্যায়ের বিচার আর রাজনৈতিক বিচার এক না। রাজনৈতিক বিচার শুরু হয় যখন আমাদের মধ্যে শত্রুমিত্র ভেদজ্ঞান তৈরি হয়। জনগণকে আমরা কি বোঝাতে পেরেছি যে পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের কালপর্বে মূল লড়াইটা হচ্ছে জনগণ বনাম বহুজাতিক কোম্পানি?
শত্রুমিত্র ভেদ্গগান জীবনের সকল ক্ষেত্রের জন্য এটা সত্য। কিন্তু কিছু ক্ষেত্র আছে যা আমাদের স্রেফ জীব হিশাবে বেঁচে থাকা না থাকার সঙ্গে যুক্ত। সেই সকল ক্ষেত্রের কাজকে আমরা অগ্রাধিকার দিয়ে থাকি। যেমন, বীজ ও খাদ্য সার্ব্বহৌমত্ব সুরক্ষার ব্যবস্থা। আমরা কতোটা অগ্রসর হতে পেরেছি সেটা বোঝা যাবে মনসান্টো, সিনজেন্টা, বায়ারসহ দেশীবিদেশী বিষের সওদাগর ও প্রাণঘাতী কোম্পানিগুলোকে আমরা কতোটা বাংলাদেশের জনগণকে চিনিয়ে দিতে পেরেছি। হয়তো মাঠের কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এই ধরণের কোম্পানিকে চিনিয়ে দেওয়া সহজ। কিন্তু পুঁজি আমাদের জীবনের সর্বক্ষেত্রে বিস্তৃত ও পরিব্যাপ্ত। কাজটা আসলে কঠিন। সেই ক্ষেত্রে আমাদের কাজ অনেক ব্যাপক। সেটা বহুকে নিয়ে করবার কাজ। বিভিন্ন সংগঠন ও উদ্যোগের সঙ্গে সম্পর্ক রচনা ছাড়া সফলতার সম্ভাবনা নাই। আমরা তাই সকলের সঙ্গে কাজ করতে অধিক উৎসাহী।
বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থায় – পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন, টেকনলজি এবং ডিজিটাল নজরদারির যুগে কি ধরণের ‘বাংলাদেশ’ গঠন সম্ভব? সেই গোড়ার প্রশ্ন তোলা এখনকার গুরুত্বপূর্ণ কাজ। আমরা কোন বিচ্ছিন্ন দ্বীপে বাস করি না। নিজেদের বর্তমান কাজকে আগামির সম্ভাব্য বাংলাদেশের আলোকে সাজিয়ে নেওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। সেই ক্ষেত্রে হাওয়াই বা বিমূর্ত চিন্তা দিয়ে কিছুই অর্জন করা যায় না। আমাদের কাজ কংক্রিট হতে হবে। তার ইতিবাচক ফল পেতে হবে। ভাতঘুমের খোয়াব দেখে কাজ হবে না। বাংলাদেশের উন্নতির পরিকল্পনা করতে গিয়ে এইসব নিয়ে তুমুল কথাবার্তা বলেছি আমরা।
তবে এবারের সভার আলাদা গুরুত্ব ছিল। এবার আমরা নানান দিক থেকে “প্রাণের আনন্দে, সহজ পথে” – শ্লোগানটি আমাদের অভিজ্ঞতা অর্জনের আলোকে বুঝতে চেয়েছি। যেন কোন রোমান্টিক উৎকল্পনার মধ্যে কথাগুলো হারিয়ে না যায়। আমরা যখন ছোট একটি সংগঠন হিশাবে আশির শেষের দিকে পাঠচক্র হিশাবে নিজেদের গুছিয়ে তুলছিলাম, তখন যে ভাবনাগুলো আমাদের মাথায় ছিল এই শ্লোগানের মধ্যে তারই অনুরণন আছে।
কেন আমরা ‘প্রাণ’ নিয়ে এত ভাবছিলাম? কারণ তখনকার রাজনীতি ও চিন্তার জগত থেকে ‘প্রাণ’ কথাটা হারিয়ে গিয়েছিল। আমরা ভাবতে শুরু করি কি করে প্রাণ কথাটাকে আমরা আমাদের কংক্রিট চর্চার মধ্যে নিয়ে আসতে পারি? এই ধারণা আমাদের কাছে অবশ্য পরিষ্কার ছিল যে প্রাণ স্রেফ বস্তুর বিপরীত কোন ধারণা নয়, কারণ বস্তু ছাড়া প্রাণ অসম্ভব। প্রাণ তাহলে একটি সম্বন্ধবাচক ধারণা যার দ্বারা বস্তু ও অবস্তু বিস্ময়কর জীবন্ত সম্বন্ধ আমাদের সামনে জ্বলজ্যান্ত হাজির হয়। অথচ এই সম্বন্ধ সদাই ধরাছোঁয়ার ও বুদ্ধির বাইরে থেকে যায়।
আমরা তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা প্রাণ নিয়েই কাজ করব। ‘প্রাণ’ নামক সন্ধিবিন্দু আমাদের খুবই আকর্ষণীয় মনে হয়েছে যেখানে জগতকে আর বস্তু ও চেতনা — এই দুই ভাগে ভাগ করা যাচ্ছে না। উবিনীগ, নয়াকৃষি আন্দোলনসহ আমাদের সকল কাজ তাই শুরু থেকেই প্রাণকেন্দিক। এমন এক জায়গা থেকে আমরা কাজ করতে শুরু করি যেখানে বস্তু আর ভাব আর পরস্পর থেকে আলাদা না। আমাদের কাজের ইতিহাস মূলত প্রাণ সংক্রান্ত ধারণাকে ক্রমে ক্রমে আরও স্পষ্ট করে তোলারই ইতিহাস।
একবার বস্তুবাদ, একবার ভাববাদ, আবার অতি পণ্ডিত হয়ে থাকলে হিস্টরিকাল মেটেরিয়ালিজম, ডায়ালেক্টিকার মেটেরিয়ালিজম ইত্যাদি নানান নামে আমরা আমাদের চিন্তা ও তৎপরতার অভাবগুলো একটা সময় বাংলাদেশে কাটিয়ে তুলতে চেষ্টা করতাম। প্রাণের ধারণা আমাদের সেই অভাব কাটিয়ে তুলতে সহায়তা করেছিল বিপুল ভাবে। ফলে প্রাণ, প্রকৃতি, পরিবেশ, জলবায়ু বিপর্যয়, জীবন জীবিকার সংকটকে একটা বড় পেক্ষাপটে আমরা ভাবতে পেরেছে, ব্যবহারিক কাজের প্রয়োজনে প্রয়োগও করেছি। এই সচেতনতা থেকেই আমরা প্রাণবৈচিত্র্যভিত্তিক উৎপাদন সম্পর্ক ও ব্যবস্থার ধারণা গড়ে তুলি এবং কৃষিতে তা প্রয়োগ করতে শুরু করি।
তবে বাংলাদেশে ভাবের অভাব অনেক গভীর ও বিপজ্জনক। আমরা বিশেষ ভাবে চ্যালেঞ্জে পড়েছিলাম ধর্ম বা আদর্শের সঙ্গে বৈষয়িক জীবন ও জীবিকার সম্বন্ধ — বিশেষত দ্বন্দ্বের দিকটা মোকাবিলার ক্ষেত্রে। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ধর্মবাদী বা মার্কসবাদী কেউই আমাদের কোন কাজে আসে নি। আরও বোঝার জন্য আমরা ধর্মকে যেমন আন্তরিক ভাবে বোঝার চেষ্টা করি, একই ভাবে খোদ কার্ল মার্কসকে বোঝার জন্য সরাসরি তাঁর শরর্ণার্থী হই। একালে ‘পুঁজি’ কিভাবে আমাদের দৈনন্দিন সকল কিছুরই নিয়ন্তা হয়ে উঠেছে তা বুঝতে হলে মার্কসের কোন বিকল্প নাই। মার্কসের কাছে ফিরে যেতে আমরা বাধ্য হয়েছিলাম। এই সময়ই ‘মোকাবেলা’ বইটি লেখা। আমরা বুঝে গিয়েছিলাম মানুষের নিজের সম্পর্কে অনুমান এবং জগতের সঙ্গে তার সম্বন্ধ বোঝার গোড়ায় বড় ধরণের ভুল আছে। সেটা প্রক্রিয়া বা পদ্ধতিগত প্রশ্নও বটে। মার্কসের শিক্ষা সেই ক্ষেত্রে অতুলনীয়।
আমরা সবসময়ই চেষ্টা করেছি একটা সামগ্রিক চিন্তা বা দর্শনের আলোকে গুছিয়ে কাজ করতে। বিক্ষিপ্ত ভাবে কজের বরকত কম, কিম্বা ফায়দা নাই। সজীব ও সক্রিয় চিন্তা সদাই জারি রাখা জরুরি। তাই নিজেদের চিন্তা বা দর্শনের বাইরে আমাদের কাজকে আমরা কখনই ‘প্রকল্প’ মনে করি না। সাধারণত যে ধরণের চিন্তায় সকলে অভ্যস্ত থাকে উবিনীগে সেই সবের কঠোর পর্যালোচনা ও মোকাবিলায় বিশেষ ভাবে আগ্রহী। উবিনীগ সবসময়ই নতুন ভাবে চিন্তা করতে পছন্দ করে যেন বিদ্যমান ব্যবস্থার ফাঁদে পড়ে আমাদের সহজ বৃত্তি, কল্পনা ও আকাংখা নষ্ট না হয়। তাই যা কিছুই আমরা করি ভেবেচিন্তে গুছিয়ে করার চেষ্টা করি। যে কোন কাজ কিভাবে সংগঠনের আদর্শ, নীতি ও কৌশলের সঙ্গে যুক্ত তাকে কঠোর বিবেচনার অধীন রাখি।
এর কিছু নগদ ফল আছে। নগদ ফল আমরা তিনটি স্তরে পেতে পারি। প্রথম হোল, মাঠের কাজ যেন লক্ষ্যহীন না হয়, তার জন্য প্রতিটি কাজের তাত্ত্বিক ভিত্তি সম্পর্কে সচেতনতা। তত্ত্ব আর বাস্তবে না মিললে আমরা হয় তত্ত্ব অথবা কাজ – কিম্বা দুটাই সংশোধন করি। অর্থাৎ মাঠে কাজের অভিজ্ঞতা আমাদের অনুমানকে পর্যালোচনার সুযোগ দেয়, আমরা নতুন অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমাদের চিন্তার পর্যালোচনা করতে পারি। ফলে সংগঠন চিন্তা ও কাজ উভয় দিক থেকে আদৌ অগ্রসর হোল কিনা আমরা উপলব্ধি করতে পারি, মাপতে পারি।
দ্বিতীয় নগদ ফল হচ্ছে স্থানীয় ও বিশ্ববাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো চিহ্নিত করতে পারা।
আমরা প্রকল্পনির্ভর সংগঠন না। বিশেষ সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে আমরা শেখার ও জানবার কাজ করি। আগাম কোন ছক কাটা চিরায়ত শ্বাশ্বত সত্য মাথায় বদ্ধমূল রেখে আমরা কাজ করি না। কোন কাজ বিশ্ববাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে ‘স্ট্রেটেজিক’ – অর্থাৎ আগামির নির্ধারক — সেটা আমাদের চিন্তা ও পরিকল্পনার কেন্দ্রে থাকে। যেমন আমরা প্রায় তিরিশ বছর আগে যখন প্রাণ-বৈচিত্র ভিত্তিক উৎপাদন ব্যবস্থা বা নয়াকৃষি আন্দোলন শুরু করেছি আজ তা বিশ্বব্যাপী সামনে পরিচিত হচ্ছে। আমরা জীবাশ্মভিত্তিক জীবন ব্যবস্থা এবং বিষ কোম্পানির কঠোর বিরোধিতা করেছি। আজ সকলেই পরিবেশ দূষণ ও জলবায়ু বিপর্যয়ের কথা বলছেন, ইত্যাদি। তাছাড়া মানুষের সাথে বাস্তব জগতের সম্বন্ধ আমরা নানান দিক থেকে পর্যালোচনা করতে শিখেছি। এটা নগদ তৃতীয় ফল।
আমাদের কাজের গোড়ার জায়গা হচ্ছে প্রাণ। প্রাণের উৎপাদন, প্রাণের ব্যবস্থাপনা এবং প্রাণ ও প্রকৃতির সম্পর্ক এমন ভাবে গড়ে তোলা যেন নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার রূপ এবং নকশা আমরা সহজে করতে পারি। তাই আমরা সবসময়ই ‘বীজ’ নিয়ে কাজকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে থাকি।
প্রাণের জয় হোক। প্রাণের আনন্দে সহজ পথের প্রতি সব্বাইকে ডাক দিচ্ছি। আমাদের সমাজ আরও বিশাল হয়ে উঠুক।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।