সাংবিধানিক সমতার চেতনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগই কাম্য - BANGLANEWSUS.COM
  • ১লা অক্টোবর, ২০২৩ খ্রিস্টাব্দ

 

সাংবিধানিক সমতার চেতনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগই কাম্য

banglanewsus.com
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ৪, ২০২২
সাংবিধানিক সমতার চেতনা ও আইনের কঠোর প্রয়োগই কাম্য

বদিউর রহমান :: সম্প্রতি মিডিয়ায় সরকারি চাকুরেদের সিভিল সার্ভিস আইনে দেওয়া একটা বাড়তি বা বিশেষ সুবিধা উচ্চ আদালত অবৈধ ঘোষণা করেছে মর্মে খবর বেরিয়েছে। সুবিধাটি ছিল এমন যে, চার্জশিট আদালতে গৃহীত হওয়ার আগ পর্যন্ত কোনো ফৌজদারি মামলার আসামি হলেও সংশ্লিষ্ট চাকুরেকে সরকার কিংবা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্ব অনুমতি ব্যতিরেকে গ্রেফতার করা যাবে না। এটার বিরুদ্ধে রিট হয় এবং সংবিধানের কয়েকটি অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় বিচারপতি মো. মুজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ ২৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সিভিল সার্ভিস আইনের সংশ্লিষ্ট ধারাটি বাতিল ঘোষণা করেন। ব্যক্তিগতভাবে আমি এ রায়ে খুশি হয়েছি। এ জন্য আমার সিভিল সার্ভিসের সহকর্মী-বন্ধুরা আমাকে হয়তো ঘরের শত্রু বিভীষণও ভাবতে পারেন। কিন্তু তাতে আমি অসন্তষ্ট হব না এজন্য যে, এ জাতীয় বিশেষ সুবিধার বস্তুত কোনো প্রয়োজন সিভিল চাকুরেদের জন্য প্রয়োজন কখনো ছিল না, এখনো নেই। সরকারের প্রণীত অনেক অনেক আইন, বিধি-প্রবিধি, নীতিমালা-কোনোটিতেই সরকারি চাকুরেকে বেকায়দায় ফেলার বা দায়িত্ব পালনকালীন বিপদগ্রস্ত করার কোনো বিধান রাখা হয়নি। কোনো চাকুরে ইন গুড ফেইথ অ্যান্ড উইথআউট নেগলিজেন্স কার্য-সম্পাদন করে থাকলে তার সুরক্ষা তো দেওয়াই আছে। আমি তো দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছরের সরকারি চাকরিজীবনে দোষী হয়নি এমন কোনো চাকুরের চাকরি চলে যেতে বা মামলায় শাস্তি হতে দেখেছি বলে স্মরণ করতে পারছি না। হ্যাঁ, চাকুরেদের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের তথাকথিত ‘মনা’ চালু হওয়ার পর পদোন্নতি, পদায়নের ক্ষেত্রে অনেক অনেক যোগ্য চাকুরেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। এটার জন্যও বেশি দায়ী সরকারি চাকুরেরাই, তারাই রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিতে গিয়ে আওয়ামী-মনা, বিএনপি-মনা, জামায়াত-মনা ইত্যাদির সৃষ্টি করেছেন। জনতার মঞ্চই বলুন আর উত্তরা-ষড়যন্ত্রই বলুন কিংবা জন্মাষ্টমীর ছুটির দিনে কোনো রেস্টুরেন্টে (পান্ডা গার্ডেন) কোনো শুভেচ্ছার ছদ্মাবরণে গোপন রাজনৈতিক বৈঠকই বলুন-এগুলো তো আমাদের চাকুরেরাই করেছেন, নাকি অন্য কেউ? জনতার মঞ্চে হয়তো প্রকাশ্যে, উত্তরা-ষড়যন্ত্রে না হয় গোপনে, পরে ক্যামেরার সামনে মুখ ঢাকার প্রয়াস। চাকুরেদের মাঝে অযথা দলীয়-বিভাজন বরং সিভিল সার্ভিসটাকেই একটা গর্তে ফেলে দিয়েছে। এতে পেশাদারিত্ব সৃষ্টি বাধাগ্রস্ত হয়েছে, চাকুরেদের গুণগত মানের অধঃপতন ত্বরান্বিত হয়েছে, রাজনীতিকরাও অনেক ক্ষেত্রে হতাশায় পড়েছেন।
এ ধরনের বিশেষ সুবিধা এলো কীভাবে তা পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, ২০১৩ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনে ৩২ (ক) ধারা নামে একটা নতুন ধারা যুক্ত করা হয়, যার ফলে সরকারের পূর্ব অনুমোদন ছাড়া সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী, জজ ও ম্যাজিস্ট্রেটের বিরুদ্ধে দুদক কোনো মামলা করতে পারবে না। এমন বিশেষ সুবিধা দুদক আইনে কারা এনেছিল? নিশ্চয় এতে আমলাদের হাত ছিল। অপরাধ করলে দুদক মামলা করবে, তাতে অসুবিধা কোথায়? আমি চুরি করব, ঘুস খাব, অথচ আমার বিরুদ্ধে মামলা হতে সরকারের পূর্ব অনুমোদন লাগবে-এটা কেমন কথা? আমি চুরি করার আগে বা ঘুস খাওয়ার আগে কি সরকারের পূর্ব অনুমোদন নিয়েছিলাম? হয়তো কথা উঠবে, কেউ শত্রুতামূলক আমাকে ফাঁসিয়ে দেবে, হয়রানি করবে-অতএব আমার সুরক্ষা প্রয়োজন। সরকার আমার বিষয় খতিয়ে দেখবে এবং তারপর আমার বিরুদ্ধে মামলার গ্রহণযোগ্য উপকরণ আছে কিনা তা দেখে মামলার অনুমতির সিদ্ধান্ত নেবে। এমনতর যুক্তিও ধোপে টেকে না এ জন্য যে, দুদক কি মামলার আগে বিষয়গুলো খতিয়ে দেখে না? অবশ্যই দেখে, বরং না দেখলে সেটাই হবে অবাক-করা কাণ্ড। অভিযোগ আছে, দুদক এমনিতেই যোগসাজশে অনেক মামলা করেই না। যাক, এক রিটের পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ৩০ জানুয়ারি হাইকোর্টের এক রায়ে এই ৩২(ক) ধারা অবৈধ ঘোষিত হয়। ধারণা করা অসংগত হবে না যে, যারা এই ৩২(ক) ধারা যুক্ত করেছিলেন, তাদের উদ্যোগেই আবার সিভিল সার্ভিস আইন, ২০১৮তে প্রায় একই ধরনের বিশেষ সুবিধা সংবলিত ৪১ (১) ধারা সংযুক্ত হয়। দুদক আইনের ২০১৩-এর সংশোধনী আর সিভিল সার্ভিস আইন, ২০১৮-এর সংশ্লিষ্ট সুবিধায় একটু টেকনিক্যাল পার্থক্য রয়েছে এমন যে, দুদক আইন সংশোধনীর ৩২(ক) ধারা অনুযায়ী পূর্ব অনুমোদন ছাড়া কোনো মামলাই করা যেত না, আর সিভিল সার্ভিস আইন, ২০১৮-এর ৪১(১) ধারা অনুযায়ী মামলা হলেও পূর্ব অনুমোদন ছাড়া আদালতে চার্জশিট গ্রহণের আগে গ্রেফতার করা যাবে না। সিভিল সার্ভিস আইনের সুবিধাটি কেবল গ্রেফতার-সংশ্লিষ্ট, মামলা না-করা সংশ্লিষ্ট নয়। এ বিবেচনায় সিভিল সার্ভিস আইনের সুবিধাটি তুলনামূলকভাবে একটু হালকা মনে হতে পারে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, অন্য যদু-মধু-রাম-শ্যামকে গ্রেফতার করা গেলে সরকারি চাকুরেকে কেন করা যাবে না। সাংবিধানিক বৈষম্য যেহেতু আমাদের কারও কাম্য নয়, সেহেতু এমন সুবিধা বাতিল অভিনন্দনযোগ্য। অবশ্য অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন বলেছেন, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। আমরা তো মনে করি, আপিল না করাই শ্রেয়। সরকারের সর্বোচ্চ আইনজ্ঞ হলেই যে সরকারের প্রণীত আইনের কোনো ধারা বাতিল হলে আপিল করতে হবে তা বিবেচ্য হওয়া কাম্য নয়।
বিষয়টি দেখা উচিত এ বিবেচনায় যে, হাইকোর্টের রায়ের ফলে সরকারি চাকুরেরা ক্ষতির সম্মুখীন হবেন কিনা। আমরা তো এতে ক্ষতির কোনো আশঙ্কা দেখি না। বরং এমন সুবিধা না থাকলে চাকুরেরা আরও সতর্ক হবেন, আইন-কানুন পালনে আরও কঠোর হবেন, ন্যায়নিষ্ঠ হবেন এবং কোনো প্রভাব-বলয়ের চাপে অযথা নতিও স্বীকার করবেন না।
আমার নিজস্ব একটা অভিমত রয়েছে এমন যে, কোনো আইন-কানুনেই বৈষম্যমূলক কোনো বিধান থাকা কাম্য নয়। সংবিধান তো প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা দিয়েই রেখেছে, অতএব সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয় এমন কোনো আলাদা বিধান অন্য কোনো আইনে রাখাটাই হচ্ছে অসাংবিধানিক। সংবিধান যেহেতু প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ আইন এবং সংবিধান অনুযায়ীই যেহেতু এ সংবিধানের সঙ্গে অসামঞ্জস্য কোনো আইন যতটুকু অসামঞ্জস্যপূর্ণ ততটুকু বাতিলযোগ্য, সেহেতু সিভিল সার্ভিস আইনে ৪১(১) ধারা বাতিলের রায়ও সংবিধানসম্মতই হয়েছে। আমরা আইনের বাইরেও অনেক সময়ে সুযোগ-সুবিধার বেলায় কিছু অসামঞ্জস্য ব্যবস্থা দেখে থাকি। এমন অসামঞ্জস্যগুলো বড়ই দৃষ্টিকটু এবং আইনের চোখে প্রকৃতই গ্রহণযোগ্য বিবেচিত হতে পারে না। যেমন, সংসদ-সদস্যদের শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুযোগ প্রদান একটা বৈষম্যমূলক আচরণ। শুল্ক আইনে তাদের জন্য মূলত তেমন সুবিধা দেওয়া ছিল না। এরশাদের আমলে অর্থনৈতিক সুবিধা দিয়ে দল ভারি করার জন্য এবং একটা শ্রেণির সমর্থনের আশায় এ অবৈধ সুযোগের সৃষ্টি করা হয়েছিল। সুবিধা কে ছাড়তে চায়? অতএব পরের সরকারগুলো এ সুবিধা বহাল রাখে। সেনা নির্দেশিত তত্ত্বাবধায়কের আমলে এটা রহিত করা হলেও পরবর্তী রাজনৈতিক সরকার আবার নিজেদের দলীয় স্বার্থে রাষ্ট্রীয় অর্থের ক্ষতি সাধন করে এ সুবিধা পুনর্বহাল করে। কিন্তু কেন? এমপি সাহেবরা তো তাদের প্রিভিলেজ অনুযায়ী সুযোগ-সুবিধা পেয়েই থাকেন, শুল্কমুক্ত গাড়ি আমদানির সুবিধা আবার কেন? প্রয়োজনে সরকার সংসদ সচিবালয়ের বাজেটের মাধ্যমে বিনাসুদে তাদের গাড়ি কেনার ঋণ দিতে পারে, অথবা সংসদ সচিবালয় থেকে তাদের জন্য গাড়ির সুবিধা দিতে পারে। আমার অবাক লেগেছে যখন জেনেছি যে, শেষ পর্যন্ত মুহিত সাহেবও বিশেষ বিবেচনায় শুল্কমুক্ত গাড়ির সুবিধা নিয়েছেন, অথচ তিনি ছিলেন সরকারের অর্থমন্ত্রী। তার তো সরকারের বৈষম্যহীন শুল্কের প্রতিই বেশি আগ্রহ থাকা কাম্য ছিল। শুল্কমুক্ত আমদানিকৃত গাড়ির অবৈধ ব্যবহার এবং ক্রয়-বিক্রয় নিয়ে কোনো কোনো সময়ে অনেক সমালোচনাও হয়েছে, কাউকে কাউকে বেকায়দায়ও পড়তে হয়েছে শোনা যায়।
সরকারি চাকুরেদের রাজনৈতিক প্রভাব বলয়ের বাইরে রাখাই কাম্য। তেমনটা কঠোরভাবে পালন করা হলে এমন অভিযোগ হয়তো আসত না যে চাকুরেরা রাজনৈতিক নেতৃত্ব কিংবা জনপ্রতিনিধিদের অমান্য করেন। আমরা দেখলাম বড় চাকুরে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা হলেন, কিন্তু তার কোনো শাস্তি হলো না, আমরা দেখলাম বিদেশি মেহমানের সম্মাননা মেডেলে সোনা নেই, কিন্তু দায়ী কে বুঝতেই পারলাম না। আইন-কানুনে কাউকে ছাড় না দেওয়াই সুশাসনের জন্য অতীব জরুরি, আমরা এ বিশ্বাসে অটল থাকতে চাই।

বদিউর রহমান : সাবেক সচিব, এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।