শতাব্দীর সর্বনাশী বন্যা - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সকাল ৯:০১, ১৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

শতাব্দীর সর্বনাশী বন্যা

newsup
প্রকাশিত সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২
শতাব্দীর সর্বনাশী বন্যা

ম. আমিনুল হক চুন্নু : বন্যা হলো পানির মাত্রাতিরিক্তি প্রবাহ যা কোনো নদী বা জলাশয়ের প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম তীর অতিক্রমন করে প্রবাহিত হয়। নদী, হ্রদ, হাওর, বাওড় বা সমুদ্রের মতো প্রাকৃতিক জলাশয়ের আধার থেকে মাত্রাতিরিক্ত পানি প্রবাহিত হওয়ার কারণে বন্যা হয়।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। মৌসুমী জলবায়ু বাংলাদেশের ওপর সক্রিয়। মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বর্ষাকালে এ দেশে প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। ভারত থেকে প্রবাহিত ৫৪টি নদী বাংলাদেশে প্রবেশ করে বঙ্গোপসাগরে পতিত হয়েছে। হিমালয় অববাহিকায় ভারতের যেসব রাজ্য রয়েছে এ রাজ্য গুলোতে বর্ষা মৌসুমে ভারী বর্ষণ হলে বাংলাদেশের মধ্যদিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোতে পানির প্রবাহ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। উভয় দেশের উপর দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোর উপর ভারত একতরফা বেশ কয়েকটি বড় বাঁধ নির্মাণের কারণে বেশির ভাগ নদীর বাংলাদেশ অংশে পলি জমে এর নাব্যতা হ্রাস পেয়ে নদীগুলো পানি ধারণ ক্ষমতা মারাত্মকভাবে সংকোচিত হয়েছে। উজানে বাঁধ নির্মান পরবর্তী শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন অনুযায়ী পানির ন্যায্য হিস্যা থেকে বঞ্চিত হয়, অপর দিকে বর্ষা মৌসুমে বাঁধের উপর দিকে পানির চাপের ব্যাপক বৃদ্ধি ঘটলে ভারত বাঁধের সবগুলো গেট খুলে দেয়।

এতে মাত্রাতিরিক্ত পানির প্রবাহের কারণে নদীর দু’কূল উপচে ফসলের ক্ষেত, আম, জনপদ, রাস্তা-ঘাট প্লাবিত হয়। অনেক সময় দেখা যায় সামুদ্রিক ঝাড় থেকে সৃষ্টি জোয়ার, দেশের উপকূলবর্তী জেলাগুলো অমাবস্যার সময় জোয়ারের পানির বৃদ্ধি ঘটলে বন্যা দেখা দেয়। গেল মাসে শতাব্দীর সর্বনাশী বন্যায় সিলেট এবং সুনামগঞ্জ জেলার লাখ লাখ মানুষ আজ গৃহহীন। শুধু সিলেট সুনামগঞ্জ নয়, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, বগুড়া, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, নেত্রকোনা, লালমনিরহাট ও সিরাজগঞ্জ সহ উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলোতেও বন্যায় লাখ লাখ মানুষ পানিবন্দি। বহু বাড়িঘর এমনকি প্রধান সড়কও পানিতে তলিয়ে গেছে। নদ-নদীর বিরামহীন ভাঙনে মানুষের জীবন বিপন্ন, সহায় সম্বল হারিয়ে তারা আজ দিশেহারা। গতকালও যাদের অর্থবিত্ত ছিল, সংসারে সুখ ছিল, তারা আজ কন্যার সর্বশান্ত। বন্যার পানি শুধু বাড়িঘরই নেয়নি, নিয়েছে গরু, ছাগলসহ বিভিন্ন গবাদিপশুও ।

যারা সামনে কোরবানির জন্য গরু-ছাগল পালন করেছিল তারাও দিশেহারা, একদিকে তাদের গরু রাখার জায়গা নেই অপর দিকে এসব পশুর খাবারও নেই। মানুষ এখন নিজের খাবার খুঁজবে নাকি গবাদিপশুর খাবার জোগাবে? এটি এখন বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। খাবার পানি নেই, পানির উৎসগুলো বানের পানিতে তলিয়ে গেছে। উনুন নেই, নেই উনুন জ্বালানোর ব্যবস্থা। উনুন পানির নিচে, খড়ি ভেলা, সরঞ্জাম থাকলেও খাবার রান্না করার মতো কোনো ব্যবস্থা নেই। ধনী-গরিব, রিকশাওয়ালা শ্রমিক সব এখন এক কাতারে দাঁড়িয়ে। প্রাকৃতিক বিপর্যয় যে মুহুর্তের মধ্যে জনগনকে জানিয়ে অসহায় করে ফেলতে পারে তা চর্মচক্ষু দিয়ে না দেখলে বোঝার উপায় নেই।

প্রতি বছরই বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলে বন্যা হয়, তবে স্বাধীনতা পরবর্তী ব্যাপক বিধ্বংসী বন্যার কারণে পুরো দেশের বেশির ভাগ এলাকা ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে, এমন বন্যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৯৭৪, ১৯৮৮, ১৯৯৮ ও ২০০৮ সালের সংগঠিত বন্যা। প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে ১৯৮৫, ১৯৯১, ২০০৭ ও ২০০৯ সালে বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চল প্লাবিত হয়ে ভয়াবহ ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

১৭৭২ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর অধীনে একজন প্রশাসককে সিলেটের শাসন কার্য পরিচালনার জ দায়িত্ব দেয়া হয়। ব্রিটিশ রবার্ট লিন্ডসে আসতে পারলেও সিলেটের উন্নয়নে তার কোনো ভূমিকা ছিল না সিলেটের সম্পদ কুক্ষিগত করা ছাড়া। তার আত্মজীবনীর বর্ণনা মতে ১৭৮১ সালে সিলেটে এক প্রলংকারী বন্যা হয়েছিল, বন্যার পানি ৩০ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করেছিল, যে কারণে জমির ফসল নষ্ট হয়, একই সাথে অবকাঠামোগত ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল। খাদ্যের অভাবে সেই সময় সিলেটের এক তৃতীয়াংশ মানুষ মারা গিয়েছিল অনাহারে। লিন্ডসে স্বীকার করেছেন তার বইতে সেই দুর্ভিক্ষ ঠেকাতে ব্রিটিশ প্রশাসন তেমন কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি।

তাছাড়া ১৮৬৯ এবং ১৮৯৭ সালে সিলেটে দুটি প্রলংকারী ভূমিকম্প সংঘটিত হয়। এই সময় জালালাবাদ (সিলেট) এর বহু প্রাচীন পুরার্কীতি এবং মানুষের ঘরবাড়ি, মাটির সাথে মিশে গিয়েছিল। প্রায় ৪০ হাজার ঘরবাড়ি সে সময় ধ্বংস হয়েছিল বলে কথিত আছে। ১৮৯৭ সালের ১২ জুন সংঘটিত এই ভূম্পিকম্পকে বলা হয়ে থাকে সাম্প্রতিক ইতিহাসের সর্বোচ্চ ভূমিকম্পের ঘটনা। যার বিস্তৃতি ছিল উৎসস্থল থেকে ২০০০ কিলোমিটার ব্যাসার্ধ জুড়ে। ভূমিকম্পের কারণে ব্রহ্মপুত্র নদের গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে পড়েছিল এবং প্রায় ৪০ হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা সেদিন ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল। সিলেটসহ সারা আসাম বেল্ট মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল এবং বলা হয়ে থাকে ঐ সময় কয়েক সহস্রাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল। তাছাড়া লোকে-মুখে এখনও শোনা যায় ক্ষণাক্ষতি সামাল দিতে গিয়ে সিলেট কেন্দ্রীয় কারাগারের কেবলমাত্র দাগি আসামী ছাড়া সকল কারাবন্দিকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল।

তবে প্রতি বছরই বন্যায় বাংলাদেশের কোনো না কোনো অঞ্চলের ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বন্যার প্রকোপ থেকে ফসল ও জনপদের সম্পদ রক্ষায় সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করলেও তা কার্যকরভাবে ফসল ও সম্পদের ক্ষতি হ্রাসে বারবার বার্থ হয়েছে এবং বেশীরভাগ নদীর দু’কূলে ও সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ না করার কারণে বন্যার ক্ষতি থেকে ফসল ও জনমানুষের ক্ষয়-ক্ষতির লাঘব ঘটছে না। রাজশাহী ও কুমিল্লা শহরের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা ও গোমতী নদীতে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করে যেভাবে শহর দুটিকে বন্যার প্রকোপ থেকে রক্ষার সর্বাত্মক প্রয়াস দেখা হয়েছে অনুরূপ প্রদক্ষেপ অপরাপর জোলার পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর ক্ষেত্রে নেয়া হলে ব্যাপকতর বন্যার কবল থেকে জেলাগুলোর জনপদ ও তদসংলগ্ন ফসলের ক্ষেত রক্ষা পেত।

এ বছরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে বিগত ১২২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত হয়। ১২-১৭ জুন ২০২২ এর মধ্যে প্রায় আড়াই হাজার মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। ভারী বর্ষনের পানি উজানের পাহাড়ী ঢল হিসেবে সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ নেত্রকোনা জেলার নদী ও হাওরাঞ্চলের পানির ধারণ ক্ষমতার মাত্রাতিরিক্ত হওয়ায় তা আশপাশের জনবসতি ও ফসলি জমির ব্যাপক ক্ষতিসাধন করে বিভিন্ন এলাকায় জনমানুষের আকস্মিক দুর্ভোগের কারণ হিসেবে দেখা যায়। সিলেট বিভাগের উপর দিয়ে প্রবাহিত সুরমা ও কুশিয়ারা নদী হয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বৃষ্টির পানি বাংলাদেশে প্রবেশ করে। উভয় নদীর তলদেশ পানি জমে ভরাট হওয়ায় পানির প্রবাহ ও ধারণক্ষমতা বহুলাংশে হ্রাস পেয়েছ। এ কারণে নদী দু’টির উজানে অধিক মাত্রায় বর্ষণ হলে দু’কুল ও হাওরাঞ্চলে অতিমাত্রায় পানি জনপদে ও ফসলের ক্ষেতে প্রবেশ করে। নদী দুটিতে নিয়মিত খননকার্য পরিচালিত হলেও দু’কূলে টেকসই বাঁধ নির্মাণ করা হলে আকস্মিক বন্যার প্রাদুর্ভাব থেকে নদীর কূলবর্তী শহরগুলোর মানুষজন রক্ষা পেত। সিলেট বিভাগের চারটি জেলা যথা- সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার ও ময়মনসিংহ বিভাগের দু’টি জেলা যথা- নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, এ ছয়টি জেলায় যে ব্যাপক হাওরাঞ্চল রয়েছে, এগুলো বর্ষা মৌসুমে প্রাকৃতিক জলাধার হিসেবে আবহমানকাল থেকে পানির জোগান দিয়ে চলেছে। হাওরগুলোর কোনো কোনো অংশের পানির উচ্চতা বর্ষা মৌসুমে ৩০-৪০ ফুট অবদি হয়ে থাকে। সে সময় হাওরগুলোতে পানির প্রবল স্রোত থাকায় নৌযানকে সাবধানতা অবলম্বন করে চলাচল করতে হয়। এসব হাওরের বিস্তীর্ণ অংশ অন্ধ মৌসুমে সম্পূর্ণ শুকিয়ে যায়।

ব্রিটিশ পরিব্রাজক উইলিয়াম হান্টারের মতে সিলেটের উত্তর দিকে পর্বতসমূহের পাদদেশে সামুদ্রিক শামুকের বাহুল্যই প্রমাণ করে এখানে এক সময় সমুদ্র ছিল। অনেক ইতিহাসবিদের মতে, আস্তে আস্তে সমুদ্র গরে যায় এবং সেখানে হাওর বা বিলের জন্য হয়। এমনিতে বৃহত্তর সিলেটের সুবিশাল এলাকা হাওরবেষ্টিত। তবে চার জেলার মধ্যে সুনামগঞ্জের প্রায় সবকটি থানা এবং হবিগঞ্জের মোট আটটি থানার মধ্যে চারটি থানা হাওর অঞ্চলে অবস্থিত। এসব হাওর বৃহত্তর জেলাকে খাদ্যশস্য ও মৎস্য সম্পদে সমৃদ্ধি করা ছাড়াও জাতীয় অর্থনীতির এক সিংহভাগ সমৃদ্ধির জোগানদার। এই বিভাগের আয় হচ্ছে বাংলাদেশের জাতীয় আয়ের চেয়ে ঝুড়ি শতাংশ বেশি। পাঠান, মোগলের দিল্লীর সিংহাসন নিয়ে ঐতিহাসিক বিবর্তনসহ যুদ্ধবিগ্রহের জের সিলেটকে প্রায় চারশত বছর ধরে ক্ষতবিক্ষত করেছে। পলাশী যুদ্ধের পর নবাব মীর কাশিমের নিকট থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী সিলেটের চুন ব্যবসায়ীদের অধিকার ভুক্ত হয়। আর্মেনীয়, গ্রিক, পুর্তগিজ, ওলন্দাজ ও ইউরোপীয়, শ্বেতাঙ্গগনও এই সিলেটকে ব্যবসার কেন্দ্র হিসাবে ব্যবহার করেছেন। পৃথিবীর সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাতের স্থান চেরাপুঞ্জির অবস্থান ভারতের মেঘালয় রাজ্যে। চেরাপুঞ্জিরর বৃষ্টির পানি সুনামগঞ্জের বাজিতপুর হয়ে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন ও অষ্টগ্রামের হাওর দিয়ে প্রবাহিতের পর বহু নদী হয়ে মেঘালয়ে পতিত হয়। সম্প্রতি ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম হাওরের মধ্যে বছরব্যাপী চলাচলের জন্য “অল ওয়েদার সড়ক” নির্মাণ করা হয়েছে। পরিবেশবিদদের অভিমত সড়কটি নির্মাণের কারণে এলাকার জীবনবৈচিত্র্যের মারাত্মক ক্ষতি সাধিত হয়েছে এবং এর পাশাপাশি পরিবেশগত দূর্ভোগ দেখা দিয়েছে। অল ওয়েদার সড়কটি সপক্ষের ব্যক্তিদের যুক্তি- এ সড়কের মাধ্যমে তিনটি উপজেলার মধ্যে বছরব্যাপী সড়ক যোগাযোগ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে যা সড়ক নির্মাণ পূর্ববর্তী বর্ষাকালে দূরহ ও পূর্গম ছিল।

তাদের দাবি, সড়কের বিভিন্ন স্থানে পানি প্রবাহের জন্য সেতু কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে এবং এ সড়কটি কোনোভাবেই সড়কের অকপটে আগের পানির প্রবাহে কোনো ধরণের বিঘ্ন সৃষ্টি করছে না। পরিবেশবিদরা এসব যুক্তি মানতে নারাজ। তাদের সুস্পষ্ট অভিমত এ সড়কের কারণে পানির প্রবাহে বিঘ্ন সৃষ্টি হয়ে সড়কেরা এক পাশের দীর্ঘমেয়াদী পানি জমে পানির ধারণ ক্ষমতার হ্রাস ঘটাবে এবং তা প্রতি বছর পার্শ্ববর্তী এলাকায় বন্যার জন্য এককভাবে দায়ী হবে। এ প্রকল্পটি বাস্তবায়নের আগে যদিও একনেকের অনুমোদন নেয়া হয়েছিল কিন্তু পরিবেশবিদসহ অর্থনীতিবিদদের একাংশের অভিমত এরূপ প্রকল্পের চেয়ে অধিক উপযোগী হলো দেশের বিদ্যমান নাব্যতা হারানো নদীগুলোর খনন ও নদীগুলোর উত্তর তীরে বাঁধ নির্মাণ। এই বাঁধ সড়ক হিসেবে ব্যবহার ও বাঁধের উভয় পাশে ফলদ, বনজ ও ঔষধি এবং শোভা বর্ধনকারী ফুলগাছ রোপন করে এ প্রকল্প থেকে বহুমুখী সুফল পাওয়া যে সিলেটের বন্যা পরিস্থতির উন্নতি না হতেই উজান থেকে নেমে আসা ঢলে নেত্রকোনা হবিগঞ্জে বন্যা সৃষ্টির আশংকা দেখা ও বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। তাছাড়া সরকারীভাবে জ্ঞান দেয়া হলেও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। অনেকেই ঘর-বাড়ি হারিয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে। এমনিতেই করোনার কারণে বহু মানুষের আয়-রোজগারের পথ বন্ধ হয়ে গেছে, তার ওপর বন্যার কারণে অনেকের বাসস্থান, কৃষিক্ষেত্র, মাছ ও গবাদিপশু ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এ অবস্থায় প্রশাসনের পাশাপাশি প্রবাসী এবং এনজিওগুলোর উচিত মূর্গতদের পাশে দাড়ানো।

জানা যায়, বিশুদ্ধ খাবার পানির অভাবে ঝুঁকি নিয়েই অনেকে দুষিত পানি পান করছে। এতে পানিবাহিত নানা রোগের প্রাদুর্ভাবের আশংকা রয়েছে। অনেক এলাকার নলকূপ বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। বন্যা করলতি এলাকার শৌচাগার সমস্যার মানুষ চরম বিপাকে পড়েছেন, গবাদিপশু নিয়ে বিপাকে রয়েছেন অনেকে। অন্যদিকে ত্রান দেয়ার ক্ষেত্রে যাতে কোনো রকম অনিয়ম না ঘটে, সেদিকে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ওপর মানুষের হাত নেই। তবে অপরিকল্পিত নগরায়ন, বৃক্ষ নিধন, নদীর নাব্যতা সংকট মানসম্মত বাধের অভাব, জলাশয়, খাল, নদী ভরাট করে ফেলা এসব কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ভয়াবহতা বাড়ছে। মানুষের দূর্ভোগও বাড়ছে। জলাবদ্ধতার কারণে যাতে মানুষের দুর্ভোগ না বাড়ে সেজন্য এখনই সর্তকতামূলক পদক্ষেপ নিতে হবে।

তিস্তা, পদ্মা ও যমুনা নদীর বাংলাদেশের অংশে ব্যাপক খননের মাধ্যমে নাব্যতা ফিরিয়ে এনে উভয় তীরে বাঁধ নির্মাণ করে বিস্তীর্ণ ভূমি উদ্ধারে চীন ও বিশ্ব ব্যাংকের সাথে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও অজানা কারণে ভারতের আপত্তির মুখে প্রকল্প বাস্তবায়নে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। এ নদী দুটির উভয় তীরে বাঁধ নির্মাণ করে নদীর ভূমি উদ্ধারে পরবর্তীতে কৃষিকাজ ও সিমেন্ট কারখানা প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর ফলে নদী নাব্যতা ফিরে পাবে, নৌযান চলাচল সহজতর হবে ফলে দেশের অর্থনীতিতে আশানুরূপ অবদান রাখবে। ধন্যা পরবর্তী পুনবার্সন কর্মকাণ্ডে যাতে স্বচ্ছতা বজায় থাকে, সেজন্য যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। দূর্গতদের কৃষিকাজে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়ার পাশপাশি সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণের ব্যবস্থা করা দরকার।

গত কয়েক দশকে দেশে প্রচুর বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ তৈরি হয়েছে। তবে বাঁধ রক্ষাবেক্ষণের ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষ সাফল্যের পরিচয় দিতে পারছে না। এটি এক বড় সমস্যা, সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে এবং অনিয়ম, দুর্নীতিরোধ করতে না পারাই এর মূল কারণ। দেশে প্রতিবছরই কম বেশি বন্যাপূর্ব প্রস্তুতি থাকা প্রয়োজন। ভয়াবহ বন্যায় সিলেটসহ দেশের ৯টি জেলায় ৭২ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের জয়েন্ট মিশন। তাদের মধ্যে ৬০ হাজার গর্ভবর্তী সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে। ঝুঁকিতে থাকা এসব নারীকে নিয়ে ইউএনএফপিএ ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছে। তাছাড়া বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা নারীদের নিরাপত্তা যাতে বিঘ্নিত না হয় সে দিকেও সরকারের পাশাপাশি নজর রাখছে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী এইন লুইস ২রা জুলাই ২০২২ সিলেটে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান। সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয় স্যাটেলাইট ইমেজ ও অন্য তথ্যের ভিত্তিতে জাতিসংঘ মনে করে সাম্প্রাতিক ভয়াবহ বন্যায় সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। এসব এলাকায় গত ২৭ জুন থেকে কাজ শুরু করেছে জাতিসংঘের জয়েন্ট মিশন। সরকারের পাশাপাশি এনজিওদের মাধ্যমে বন্যাদূর্গত এলাকায় ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা দিচ্ছে তারা।

সম্মেলনে আরও বলা হয়- প্রাথমিকভাবে তিনটি উদ্দেশ্যে নিয়ে মাঠে নামা হয়েছে। প্রথমতঃ ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য জুরুরী জীবন রক্ষা ও জীবিকা সহায়তা, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, দ্বিতীয়তঃ সবধরণের সেবা সহজীকরণ ও নিরাপদ ও স্বাস্থ্যকর আবাসন নিশ্চিত করা, তৃতীয়তঃ নারী, শিশু এবং প্রতিবন্ধীসহ ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা, মর্যাদা ও স্থিতিশীলতা পুনরুদ্ধার করা। তবে সবদিক বিবেচনা করে বাংলাদেশ সরকারের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রান মন্ত্রণালয় এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয় কার্যালয়ের নেতৃত্বে কারিগরি হিংস্যা নিটোরিয়ান কো অরনেশন টাস্ক টিম (এইচসিটিটি) জুলাই থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছয় মাসের পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে। (সাপ্তাহিক বাংলাদেশ পত্রিকা, যুক্তরাষ্ট্রে ৭ জুলাই, ২০২২ )

বাংলাদেশের অর্থনীতি সচল রাখতে ও বাদ্যের জোগান নিশ্চিতে অন্য যেকোনো বড় ধরণের প্রকল্পের চেয়ে অধিক জরুরী বন্যা নিয়ন্ত্রণ, আর বন্যা নিয়ন্ত্রণে প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা। এ দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ হিসেবে পর্যায়ক্রমে নদী খনন করে এগুলোর পানির ধারণ ক্ষমতা বৃদ্ধিসহ সারা বছর নৌ চলাচলের উপযোগি ও অব্যাহত ভাঙনের কারণে অস্বাভাবিক বিস্তৃত নদীগুলোর তীরে বাঁধ নির্মাণ করে উদ্ধারকৃত ভূমিতে চাষাবাদ করা হলে উৎপাদিত বাড়তি ফসল দেশের খাদ্য চাহিদা পূরণে ইতিবাচক অবদান রাখবে এবং প্রতিটি নদীর দু পাশের ও দেশের উপকূলবর্তী এলাকায় নির্মিত বাঁধের দু পাশে বৃক্ষরোপন করা হলে ও বাঁধগুলো সড়ক যোগাযোগের মাধ্যমে হিসেবে ব্যবহৃত হলে দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা এবং ফল-ফসলাদি ও কাঠের চাহিদা পুরণের যুগান্তকারী

পরিবর্তন সাধিত হবে। সিলেট, সুনামগঞ্জসহ দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে প্রলয়ংকরী বন্যা কতটা অসহায় অবস্থায় ফেলছে পূর্ণত পরিবারগুলোকে তা উপরে তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। দেশের ১৮ কোটি মানুষ যদি অসহায় মানুষের সাহায্যের জন্য হাত বাড়িয়ে দেয় তাহলে দুস্থ, বানভাসি, ক্ষুধার্ত মানুষগুলো একটু সুন্দর ভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখতে পারে।

বাংলাদেশ দুর্যোগ মোকাবিলায় জাতিসংঘসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশের প্রশংসা পেলেও এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, এবারের সিলেট অঞ্চলের বন্যার পূর্বাভাস থাকার পরও সরকারি সংস্থাগুলো একটু দেরিতে ত্রান ও উদ্ধার কার্যক্রম শুরু করেছে। এমনকি ওই অঞ্চলের সাংসদসহ জনপ্রতিনিধিদের আর দিকে বেশ কিছুদিন মূর্গতদের পাশে দেখা যায়নি। তবে প্রবাসীরা দুর্যোগ সময়ে যে সাহায্য ও সহযোগিতা করেছেন তার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ধী প্রশংসা করেছেন।

একই সঙ্গে একটি বিষয় মনে করিয়ে দিতে চাই, অতীতে আইলাসহ বিভিন্ন দুর্যোগে দেখা গেছে, সরকার ক্ষতিগ্রস্তদের পূর্নবাসনে যথেষ্ট পরিমাণ বরাদ্ধ দিলেও উপকারভোগীদের কাছ পর্যন্ত যাওয়ার আগে এর অনেকাংশই হাওয়া হয়ে গেছে। ফলে দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষ শেষ পর্যন্ত বঞ্চিতই থেকে গেছে। তবে আমাদের দেশের বিগত বছরগুলোর বিপর্যয় বিবেচনায় নিয়ে (পদ্মা সেতুর মত) দেশের সম্পদ দিয়েই দীর্ঘমেয়াদী বন্যার প্রকোপ থেকে উত্তরণের কার্যকর উদ্যোগ ও পদক্ষেপ গ্রহণ করলে আগামী দশকের মধ্যে সংকটের সমাধান ও এর সুফল যে আসবে তা নিয়ে দ্বিমতের অবকাশ কোথায়?

(লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রী কলেজ, সিলেট। পিএইচডি ফেলো।)

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।