বছরের বিভিন্ন মাস ও দিনে আমলের গুরুত্ব ও পদ্ধতি সম্পর্কে অনেক প্রসিদ্ধ গ্রন্থ রয়েছে। এর মধ্যে একটি বিখ্যাত ও নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ হলো হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর ‘মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’। এ গ্রন্থের উর্দু অনুবাদ দেওবন্দের সাবেক মুফতীয়ে আযম মাওলানা মুফতী শফী সাহবের ছাহেবজাদা রদী ওসমানী কর্তৃক প্রকাশিত হয়েছে। মুফতী শফী সাহেব নিজে গ্রন্থের ভূমিকা লিখেছেন। গ্রন্থটি অনুবাদ করেছেন ইকবাল উদ্দিন সাহেব। ভূমিকায় মুফতী শফী সাহেব উক্ত গ্রন্থের ভূয়সী প্রশংসা করে লিখেছেন- “বছরের বিভিন্ন মাস ও দিনের ফযীলত বিষয়ক কিতাবের মধ্যে ‘মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’ একটি গুরুত্বপূর্ণ কিতাব। এই কিতাবের লেখক শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর নামের কারণেই এ কিতাব নির্ভরযোগ্য, গ্রহণযোগ্য ও উচ্চ মর্যাদা সম্পন্ন হবার দাবি রাখে। জ্ঞানীদের নিকট এ কিতাবের পরিচয় দেওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। এ কিতাবে এ সংক্রান্ত বর্ণিত হাদীসগুলো একত্রিত করা হয়েছে। আর প্রয়োজনীয় ও উপকারী তথ্য সংযোজন করা হয়েছে। এ কিতাব দীর্ঘকাল থেকে দুষ্পাপ্য ছিল। আলহামদুলিল্লাহ! বর্তমানে আমার ছেলে রদী প্রথমে উর্দু তরজমাসহ এর মূল আরবী ভাষ্য তার নিজের ছাপাখানা ‘দারুল এশাআত’ থেকে প্রকাশ করেছেন। আল্লাহ কবুল করুন এবং সকলের দীন-দুনিয়ার জন্য উপকারী বানিয়ে দিন।”
দারুল এশাআত থেকে প্রকাশিত উক্ত “মা ছাবাতা বিস সুন্নাহ’র উক্ত সংস্করণে শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) রবিউল আউয়ালের আমল বা কর্মসূচি সম্পর্কে লিখেছেন, “মুসলমানগণ সর্বদা মাহফিলে মীলাদুন্নবী করে আসছেন। মাহফিলে মীলাদের সাথে তারা সুস্বাদু খাবার ইত্যাদি পাকাতেন, দান-খয়রাত করতেন, আনন্দ প্রকাশ করতেন, অধিক নেক আমল করতেন, নবী করীম (সা.) এর জন্ম বৃত্তান্ত পাঠ করতেন। এ সকল নেক আমলের ওসীলায় তাদের উপর অফুরন্ত, অনুগ্রহ বর্ষিত হতো। মাহফিলে মীলাদুন্নবী করার অভিজ্ঞতালব্দ বিশেষ ফায়দা হলো, মীলাদকারীগণ উক্ত বছর আল্লাহর হিফাযতে থাকা এবং হাজত পূরণ ও উদ্দেশ্য সাধন হওয়ার দ্রুত সুসংবাদ লাভ করা। আল্লাহ সে ব্যক্তির উপর রহমত নাযিল করুন যে মীলাদুন্নবীর মাসের রাতসমূহকে ঈদ হিসেবে গ্রহণ করে। যাতে যার অন্তরে শত্রুতার রোগ রয়েছে সে যেন তার শত্রুতায় আরো কঠোর হয়।”
এখানে হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) পুরো রবিউল আউয়াল মাসকে যে ব্যক্তি “ঈদ” হিসেবে গ্রহণ করে তার জন্য রহমত কামনা করেছেন এবং রবিউল আউয়াল মাসে মুসলমানগণের আমল কী কী তা তুলে ধরেছেন। তার বর্ণিত আমলসমূহের মধ্যে রয়েছে,
১. রবিউল আউয়াল মাসে মাহফিলে মীলাদুন্নবী করা।
২. সুস্বাদু খাবার তথা শিরনী পাকানো।
৩. বিভিন্ন ধরনের দান-খয়রাত করা।
৪. প্রিয়নবী (সা.) এর শুভাগমন উপলক্ষে আনন্দ প্রকাশ করা।
৫. বেশি নেক আমল করা।
৬. নবী করীম (সা.) এর জন্মবৃত্তান্ত পাঠ করা।
প্রকাশ থাকে যে, পূর্বোক্ত আলোচনায় আছে, হযরত শাহ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) রবিউল আউয়াল মাস উদযাপনের শরীআতসম্মত পদ্ধতি বর্ণনা করেছেন এবং যে ব্যক্তি পূর্ণ এ মাসকে “ঈদ” হিসেবে গ্রহণ করে তার জন্য দুআ করেছেন। আকাবিরীনে দেওবন্দ এর নিকট তিনি অত্যন্ত গ্রহণযোগ্য ব্যক্তিত্ব। মাওলানা আশরাফ আলী থানভী সাহেব সহ অনেক দেওবন্দী আলিম গুরুত্বের সাথে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে শায়খ আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহমাতুল্লাহি আলাইহি এর মাকবুলিয়তের কথা উল্লেখ করেছেন। থানভী সাহেবের ‘মালফুযাত’ এবং মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া রচিত ‘উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী’সহ বিভিন্ন কিতাবে আছে, “কোনো কোনো ওলী আল্লাহ এমনও রয়েছেন যে, প্রত্যেক দিনই তাঁরা স্বপ্নে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যিয়ারত লাভ করতেন। তাদেরকে ‘সাহেব হুজুরী’ বলা হয়। তন্মধ্যে হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) একজন ছিলেন। তিনি যখন মদীনা মুনাওয়ারায় ইলমে হাদীসের অধ্যয়ন সুসম্পন্ন করলেন, তখন তাকে স্বপ্নে প্রিয় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এই নির্দেশ প্রদান করলেন, তুমি হিন্দুস্থানে গমন কর এবং ইলমে হাদীসের প্রচারে আত্মনিয়োগ কর, যেন সেখানকার লোকেরা উপকৃত হয়। তিনি আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) হিন্দুস্থানে গমন করলে আপনার দরবারে কিভাবে হাজির হবো? আর আপনার দরবারে হাজির হতে না পারলে কী করে বাঁচবো? তখন হুকুম এল, তুমি ব্যাকুল হয়ো না। রাতে মুরাকাবা করো, আমার নিকট পৌঁছে যাবে। প্রত্যেক দিনই তুমি যিয়ারত লাভ করবে। এভাবে নিশ্চিত হাবার পর যখন হিন্দুস্থানে রওয়ানা দিলেন; তখন প্রিয়নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে নির্দেশ দিলেন, হিন্দুস্থানে যারা আল্লাহ ওয়ালা রয়েছেন তাদের দিকে নযর রেখো। এ নির্দেশটির বিশেষ প্রতিক্রিয়া হলো হযরত আব্দুল হক মুহাদ্দিসে দেহলভী (র.) এর উপর। তাই হিন্দুস্থানের যে স্থানেই তিনি গমন করতেন, সেখানে যদি কোনো আল্লাহ ওয়ালা লোক থাকতেন, তবে তাঁর সঙ্গে দেখা করতেন।” (মালফুযাতে হযরত থানবী, ৭ম খ-, পৃষ্ঠা: ৬-৭; তাযকেরায়ে গাউসিয়া, পৃষ্ঠা: ৩৮৯-৩৯০; ইনশিরাহুস সুদূর, পৃষ্ঠা: ৩০৯; সীরাতুন্নবী বাদ আয বেসালাতুন্নবী, পৃষ্ঠা: ২৩৯-২৪১; উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, ১ম খ-, পৃষ্ঠা: ২৪০)
[প্রবন্ধটি লেখকের ‘মীলাদুন্নবী ﷺ কিছু পর্যালোচনা’ গ্রন্থ থেকে নেয়া]
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।