করিডোর-ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সকাল ৭:০০, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

করিডোর-ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ

banglanewsus.com
প্রকাশিত অক্টোবর ৮, ২০২২
করিডোর-ট্রানজিট-ট্রান্সশিপমেন্ট এবং দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ভবিষ্যৎ

ড. আইনুল ইসলাম :: সম্প্রতি বাংলাদেশের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) সিলেট-তামাবিল মহাসড়ক পৃথক এসএমভিটি (স্লো মুভিং ভেহিকল ট্রাফিক) লেনসহ চার লেনে উন্নীতকরণ এবং কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক নির্মাণ নামে দুটি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। বাংলাদেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সঙ্গে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে আন্তঃসীমান্ত সংযোগসহ উপ-আঞ্চলিক সড়ক যোগাযোগ স্থাপন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মানুষ যাতায়াত, পণ্য আমদানি-রফতানি সম্প্রসারণ এবং ভারতীয় ঋণে বাস্তবায়নাধীন আশুগঞ্জ নদীবন্দর ও আখাউড়া স্থলবন্দর ও ঢাকা, সিলেট ও চট্টগ্রামের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করাই এসব প্রকল্পের উদ্দেশ্য। এখানে উল্লেখ্য, ট্রান্সফার ইনফ্রাস্ট্রাকচার অ্যান্ড লজিস্টিক স্টাডি (বিটিআইএলএস) নামের এক সমীক্ষায় ভারতসহ এ অঞ্চলের অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপক্ষীয় ও উপ-আঞ্চলিক বাণিজ্য সম্প্রসারণে আটটি করিডোর অগ্রাধিকার ভিত্তিতে চিহ্নিত করা হয়েছিল। সে অনুযায়ী বাংলাদেশ আঞ্চলিক সংযোগকে গুরুত্ব দিয়ে সিলেট-তামাবিল ও কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া প্রকল্প বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছে। দিন কয়েক আগে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরকালে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধার আলোকে বাংলাদেশকে বিনা শুল্কে ভারতের স্থল, বিমান ও সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য পরিবহনের প্রস্তাব দিয়েছেন। এছাড়া বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ২০২৬ সালে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে মধ্য আয়ের দেশের তালিকায় প্রবেশ করার দিকে যাচ্ছে এবং ইউরোপে যুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে বিশ্ব অর্থনীতি নজিরবিহীন সংকটের মধ্যে আছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে একনেকে সিলেট-তামাবিল ও কুমিল্লা-ব্রাহ্মণবাড়িয়া মহাসড়ক ঘিরে ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের অনুমোদন বাংলাদেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক উন্নয়নসহ ভূরাজনৈতিকভাবে বিশেষ তাত্পর্য বহন করে।

বিশ্বায়ন ও বাজার অর্থনীতির এ যুগে একমাত্র ফলপ্রদ ও সমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থাই কেবল ভূরাজনৈতিক ও আর্থসামাজিকভাবে একটি অঞ্চলের চেহারা আমূল বদলে দিতে পারে, যার প্রমাণ ইউরোপ, আমেরিকা ও আসিয়ান অঞ্চলের উন্নত দেশগুলো। বিশ্বের দ্রুত, সহজ, নিরাপদ ও সমন্বিত সড়ক-মহাসড়কের প্রায় সবই রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, সৌদি আরব, কানাডা ও ইউরোপের ধনী অর্থনীতির দেশগুলো। অন্যদিকে বিশ্বের ধীরগতির সব সড়ক মূলত দরিদ্র দেশগুলোয়, যা তাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে মূল অন্তরায়। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ২০২২ সালের গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সবচেয়ে ধীরগতির সড়ক পাহাড়ি দেশ ভুটানে, যেখানে গাড়ির গড় গতি ঘণ্টায় ৩৮ কিলোমিটার। এরপর নেপাল ও পূর্ব তিমুর ৪০ কিলোমিটার। তৃতীয় অবস্থানে থাকা বাংলাদেশ ও হাইতির সড়কে গড় গতি ঘণ্টায় মাত্র ৪১ কিলোমিটার। দক্ষিণ এশিয়ার বাকি দেশগুলোর মধ্যে শ্রীলংকার ৫০, আফগানিস্তান ৫৭, ভারত ৫৮ এবং পাকিস্তানের ৮৬ কিলোমিটার। এ রকম প্রেক্ষাপটে সম্প্রতি একনেক বাংলাদেশের দুটি মহাসড়ক উন্নয়নের প্রকল্প বাস্তবায়নের সবুজসংকেত দিয়েছে, যার মূল লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্তের বিভিন্ন করিডোরের মাধ্যমে বাংলাদেশ দিয়ে ভারত, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার, চীনসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় সরাসরি সংযোগ স্থাপন করা এবং ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করা। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ এবং এ অঞ্চলের দেশগুলো অনেক দিন ধরেই স্থলবেষ্টিত বা প্রায় স্থলবেষ্টিত দেশ ও অঞ্চলের মধ্যে ট্রানজিট সেবার জন্য ১৫টি আলাদা করিডোর বিবেচনা করছে এবং নানা ধরনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। ভূপ্রাকৃতিক গঠনের কারণে বাংলাদেশের ট্রানজিট মূলত দুটি বিষয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। প্রথমত ভুটান, চীন, নেপাল ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো কর্তৃক চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর এবং দ্বিতীয়ত কলকাতা হয়ে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং মিয়ানমার ও চীনে পণ্য পরিবহনের জন্য করিডোর হিসেবে বাংলাদেশের সড়ক, রেল ও নৌপথের ব্যবহার। এ লেখায় আন্তঃদেশীয় সমন্বিত যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার কয়েকটি দিক বিশ্লেষণের চেষ্টা করা হয়েছে।

বাংলাদেশ কিংবা দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সংস্কৃতিতে প্রবেশ করা আন্তর্জাতিক ভূরাজনীতি ও রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সময়োপযোগী এক পদক্ষেপ। কেননা বাংলাদেশের সড়ক, নৌ ও সমুদ্র যোগাযোগের অনুপম এক সুবিধা বিদ্যমান, যা বিশ্বের খুব কম দেশেই দেখা যায়; বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তে ভারত, ভুটান, নেপাল; পূর্বে মিয়ানমার ও চীনের কুনমিং শহরের অবস্থান এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর; বাংলাদেশের অভ্যন্তর দিয়ে সরকারি হিসাবে ৪০৫টি ছোট-বড় নদ-নদী বয়ে গিয়েছে। অন্যদিকে বিশ্ব অর্থনীতির পর্যবেক্ষক, বিশ্লেষক ও নীতিনির্ধারকরা বেশ কিছুদিন ধরেই বলে আসছেন দক্ষিণ এশিয়া বর্তমানে বিশ্বের অন্যতম দ্রুত বিকাশমান অর্থনৈতিক অঞ্চল। ২০৫০ সাল নাগাদ এ অঞ্চলের চীন, ভারত ও বাংলাদেশ সম্মিলিতভাবে বিশ্ব অর্থনীতির সবচেয়ে বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করবে, যার অন্যতম কারণ হলো বিশাল জনসংখ্যা ও কর্মক্ষম শ্রমশক্তি। সম্মিলিতভাবে ৩২৩ কোটি ৪২ লাখ জনসংখ্যা নিয়ে ২০৫০ সালে ভারত, চীন ও বাংলাদেশ বিশ্ব তালিকায় যথাক্রমে প্রথম, দ্বিতীয় ও দশম স্থানে থাকবে এবং এ তিন দেশের জিডিপি দাঁড়াবে যথাক্রমে ৩০ ট্রিলিয়ন, ৫৮ ট্রিলিয়ন ও ৩ হাজার ৬৪ বিলিয়ন ডলার (বাংলাদেশের বর্তমান জিডিপি ৩২৪ বিলিয়ন ডলার)। শাসনগত সংকট থাকলেও বাংলাদেশের প্রতিবেশী ভুটান, নেপাল, মিয়ানমারও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত হচ্ছে। এ অবস্থায় ‘সেভেন সিস্টার’ হিসেবে পরিচিত ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের (অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা) এবং ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের সঙ্গে সরাসরি সড়ক-নৌ-আকাশ যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা গেলে এ অঞ্চলের দেশগুলোর শিল্পের বিকাশ ও আর্থসামাজিক উন্নয়নের নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে।

১৯৯৪ সালে স্বাক্ষরিত জেনারেল এগ্রিমেন্ট অন ট্যারিফস অ্যান্ড ট্রেড বা গ্যাট-এর (ধারা ৫, অনুচ্ছেদ ১) অনুযায়ী কোনো (ফ্রেইট) ট্রাফিক যদি কোনো দেশে প্রবেশের আগে যাত্রা করে এবং ওই দেশের বাইরে যাত্রা শেষ করে, তাহলে তাকে ট্রানজিট ট্রাফিক বলা হয়ে থাকে। করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট প্রায়ই সমার্থক হিসেবে ব্যবহূত হলেও এরা আসলে পরস্পর থেকে পৃথক। নিজ দেশের এক অংশ থেকে অন্য অংশে যাওয়ার জন্য ব্যবহূত ভূখণ্ড, যা দ্বিতীয় আরেকটি দেশের আয়ত্তাধীন তাকে সাধারণ ভাষায় করিডোর বলে। যেমন ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতা থেকে ত্রিপুরার আগরতলায় কিছু মালামাল পরিবহন করতে হবে। এখন ভারত যদি নিজের ভূখণ্ড দিয়ে এ মালামাল পরিবহন করতে চায় তাহলে তাকে দার্জিলিং, মেঘালয়, আসাম পার হয়ে আগরতলায় নিয়ে আসতে হবে, যার পরিবহন খরচ হবে অনেক, সময়ও লাগবে। এ অবস্থায় ভারতের পণ্য যদি বাংলাদেশের যশোরের বেনাপোল দিয়ে ঢাকা-কুমিল্লা কিংবা চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কুমিল্লা হয়ে আগরতলায় যায়, তাতে পরিবহন খরচ ও সময় নেমে আসবে এক-তৃতীয়াংশে। এ ক্ষেত্রে ভারত বাংলাদেশকে তার পণ্য পরিবহনের জন্য করিডোর হিসেবে ব্যবহার করছে। অন্যদিকে ট্রানজিট চলাচলের জন্য আকাশ-নৌ-স্থল সংযোগ প্রয়োজনীয় পূর্বশর্ত হলেও ট্রান্সশিপমেন্টে তা প্রয়োজনীয় ও পর্যাপ্ত নয়। যেমন বাংলাদেশ বর্তমানে ভারতের কোনো স্থল, সমুদ্র ও বিমানবন্দর ব্যবহার করে তৃতীয় কোনো দেশে পণ্য নিতে পারে না। পক্ষান্তরে ভারতের নেপাল ও ভুটান ভূবেষ্টিত দেশ হওয়ায় সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনের সুযোগ নেই। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে দেয়া প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ট্রানজিট প্রস্তাব অনুযায়ী স্থলপথে ভারতের ভূখণ্ড ও আকাশপথে তাদের বিমানবন্দর ব্যবহার করে পণ্য পরিবহনের সুযোগ নিতে পারবে বাংলাদেশ। ভারতের এই ট্রানজিট প্রস্তাব কার্যকর হলে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভুটানের মধ্যে পণ্য পরিবহন ব্যবস্থা আরো সহজ ও সাশ্রয়ী হবে। তিন দেশের পণ্যবাহী ট্রাকই ভারত হয়ে একে অন্যের পণ্য আনা-নেয়া করতে পারবে। বাংলাদেশের চিলাহাটি-হলদিবাড়ি ও বিরল সীমান্ত দিয়ে রেলপথে ভারতের ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা নিয়ে নেপাল ও ভুটানের সঙ্গেও বাণিজ্য করা যাবে। ভারতের প্রস্তাব অনুযায়ী, পশ্চিমবঙ্গের শিলিগুড়ির নিকটবর্তী বাগডোগরা বিমানবন্দরও ব্যবহারের সুযোগ পাবে বাংলাদেশ। বর্তমানে নেপাল ও ভুটানের পণ্যবাহী ট্রাক ভারতের ভূখণ্ড ব্যবহার করে বাংলাদেশ সীমান্তে এসে আমদানি-রফতানি পণ্য নিজের দেশে নিয়ে যায়।

সাম্প্রতিককালে এশিয়ার এ অঞ্চলে করিডোর, ট্রান্সশিপমেন্ট ও ট্রানজিট কর্মকাণ্ডের পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, ২০১৫ সালে বিবিআইএন (বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপাল) যোগাযোগ শীর্ষক অবাধ যান চলাচল চুক্তি হয়েছিল। ওই চুক্তির আওতায় অবাধে যাত্রী ও পণ্যবাহী গাড়ি চলাচলের কথা। কীভাবে যান চলাচল করবে, সেই প্রটোকল ও নিয়মকানুনের খসড়াও তৈরি রয়েছে। যদিও ভুটান ও নেপালের আমদানি ও রফতানি পণ্য কনটেইনার জটগ্রস্ত কলকাতা বন্দর ব্যবহার করে সম্পন্ন করা কঠিন হয়ে পড়েছে, তথাপি ভুটানের দ্বিধাদ্বন্দ্বের কারণে ২০২০ সালের ফেব্রুয়ারিতে ভারতের নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশ, নেপাল ও ভারত ত্রিদেশীয়ভাবে (বিএনআই) চুক্তি কার্যকরের উদ্যোগ নেয়, যার মাধ্যমে ঢাকা থেকে পণ্য ও যাত্রীবাহী গাড়ি যেমন অবাধে ভারতে যাবে, তেমনি ভারত হয়ে নেপালেও যেতে পারবে। তিন দেশই পরস্পরের সড়কপথ ব্যবহার করতে পারবে নির্দিষ্ট প্রটোকলের মাধ্যমে। ত্রিদেশীয় এ আঞ্চলিক ট্রানজিট চুক্তি ছাড়াও সার্কের আওতায় এ-সংক্রাস্ত আলাদা চুক্তিও রয়েছে। কিন্তু এসব চুক্তির কোনোটাই পুরোপুরি কার্যকর নয়। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশ থেকে ১ হাজার ৬৭ কোটি নেপালি রুপির (বাংলাদেশী ১ টাকা = নেপালের ১.৩৫ রুপি) সমপরিমাণ পণ্য রফতানি হয়েছে। অন্যদিকে নেপাল থেকে বাংলাদেশে এসেছে ৬৭ কোটি রুপির পণ্য। বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে নেপালে পণ্য নিতে গেলে প্রথমে বাংলাবান্ধা স্থলবন্দরে পণ্যের চালান নিতে হয়। সেখান থেকে নেপাল অথবা ভারতীয় ট্রাকে করে প্রায় ৩৪ কিলোমিটার ভূখণ্ড পাড়ি দিয়ে ভারতের পানির ট্যাংক-নেপালের কাকরভিটা সীমান্তে যায়। এরপর তা কাঠমান্ডুসহ অন্য স্থানে পৌঁছে। স্থলপথে একই প্রক্রিয়ায় নেপাল থেকে পণ্য আমদানি হয়। সীমান্তে গিয়ে এক ট্রাক থেকে পণ্য নামিয়ে আরেক ট্রাকে ওঠাতে হয়। পণ্যের এ যাত্রায় বিভিন্ন সীমান্ত ও চেকপোস্টে বারবার পণ্যের চালান খুলে দেখা হয়। এতে পণ্যের মান নষ্ট হওয়া ছাড়াও পরিবহনের ব্যয় ও সময় বেড়ে যায়। অন্যদিকে ভুটানে পণ্য রফতানি করতে হলে প্রথমে বুড়িমারী সীমান্তে পণ্যবাহী ট্রাক যায়। এরপর ওই পণ্য ভারতের প্রায় ৯০ কিলোমিটার ভূখণ্ড পাড়ি দিয়ে জয়নগর-ফুয়েন্টশিলিং সীমান্ত দিয়ে ভুটানে প্রবেশ করে। নেপাল ও ভুটানে বাংলাদেশের পণ্যের বাজার সম্প্রসারিত হচ্ছে। ভারতের প্রস্তাবিত ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্টের মাধ্যমে বাংলাদেশের পণ্যবাহী ট্রাক সরাসরি নেপাল ও ভুটানে যেতে পারলে পরিবহন খরচ, সময় ও হয়রানি কমবে। ফলে এ অঞ্চলে আন্তঃদেশীয় আমদানি-রফতানির পরিমাণও অনেক বাড়বে, যা সামগ্রিকভাবে এ অঞ্চলের মানুষের জীবনমানের উন্নয়ন ঘটাবে।

বিশ্বায়নের এ যুগে বড় ধরনের উপযোগিতা থাকলেও করিডোর, ট্রানজিট ও ট্রান্সশিপমেন্ট নিয়ে দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার জনগণ ও ব্যবসায়ী মহলে ব্যাপক নেতিবাচক ধারণা বিদ্যমান, যার পেছনে ঐতিহাসিক অনেক কারণও আছে। অতীতে দেখা গিয়েছে, ভারত-চীনের মতো বৃহৎ ও বড় অর্থনীতির দেশ অভ্যন্তরীণ প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক দীর্ঘসূত্রতার মাধ্যমে বাংলাদেশের মতো ছোট দেশগুলোর বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। যেমন এফটিএ থাকলেও ভারত তার স্থানীয় শিল্পকে সুরক্ষা এবং রাজ্য আইন ও নীতিমালার নামে বাংলাদেশের বিভিন্ন পণ্য রফতানি ও পরিবহনের ওপর কাউন্টারভেলিং ডিউটি (সিভিডি) বা ভর্তুকিবিরুদ্ধ শুল্ক আরোপ ছাড়াও নানা শর্ত আরোপ করে। ফলে অন্য দেশগুলোর ব্যবসায়ীরা ভারতের সঙ্গে করা কোনো চুক্তির সুবিধাই ঠিকমতো কাজে লাগাতে পারেন না। অথচ বাংলাদেশ পূর্ব প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী স্বাধীনতার পর থেকেই নৌ-প্রটোকলের আওতায় ভারতকে নিজের নৌপথ ব্যবহার করে পণ্য অন্য অঞ্চলে নিতে দেয়। পরে ২০১৬ সালে কলকাতা থেকে নৌপথে আশুগঞ্জ নৌবন্দর পর্যন্ত এবং পরে সড়কপথে আখাউড়া হয়ে আগরতলায় বহুমাত্রিক ট্রানজিট ভারতকে বাংলাদেশ দিয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রাম ও মোংলা সমুদ্রবন্দর ব্যবহার করে ট্রানজিটের পরীক্ষামূলক চালানও ভারতে গিয়েছে। এক্ষেত্রে চুক্তির শর্তের বাইরে কোনো শুল্ক বা বাধা আরোপের নজিরও বাংলাদেশ স্থাপন করেনি। এসব কারণে এ অঞ্চলে ভারত বা চীনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ, ভুটান, নেপালসহ অন্য প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণের মধ্যে যে ক্ষোভ ও অবিশ্বাসের জন্ম নিয়েছে, তা স্বাভাবিক।

সাম্প্রতিককালের বিশ্বায়ন ও দ্রুত ভূরাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের যেমন একদিকে অনুধাবন করা অপরিহার্য যে অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক বাংলাদেশের ট্রানজিট সেবার কোনো বাজার এ অঞ্চলের বাইরে নেই। অন্যদিকে ভুটান, চীন, ভারত, নেপাল, শ্রীলংকা, মিয়ানমার, আফগানিস্তান ও পাকিস্তানেরও উপলব্ধি করতে হবে যে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্তবর্তী ভারত, ভুটান, নেপাল, পূর্ব প্রান্তে মিয়ানমার ও চীনের কুনমিং শহর এবং ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের অরুণাচল, আসাম, মেঘালয়, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড ও ত্রিপুরা অঞ্চলের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বাংলাদেশের ট্রানজিট, ট্রান্সশিপমেন্ট ও করিডোর সুবিধা ছাড়া তাদের কোনো গতি নেই। কারণ, ভূপ্রাকৃতিকভাবে বাংলাদেশের পশ্চাদভূমি সম্পূর্ণ স্থলবেষ্টিত ভুটান ও নেপাল এবং ভারতের দুটি অঞ্চল। এ অবস্থায় সহযোগিতামূলক উদ্যোগ, কৌশল ও প্রতিযোগিতার মাধ্যমেই কেবল সবাই অধিকতর লাভবান হতে পারে। করিডোর ব্যবহারের জন্য ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোনো ধরনের চুক্তি না থাকায় ‘চিকেন নেক’-এর (ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসাম সীমান্তে অবস্থিত সংকীর্ণ ভারতীয় ভূখণ্ড) মাধ্যমে প্রায় ১ হাজার ৪০০ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে কলকাতা বন্দরে এসে আসামের চা ইউরোপে রফতানি করতে হয়। অথচ বাংলাদেশের স্থলবন্দরের মাধ্যমে করিডোর সুবিধা পেলে ওই দূরত্ব ৭০০ কিলোমিটারে নেমে আসত। অন্যদিকে আগরতলা থেকে চট্টগ্রাম বন্দরের দূরত্ব মাত্র ৪০০ কিলোমিটার। এ অল্প দূরত্বের সুবিধা কাজে লাগাতে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও চীনের কুনমিংয়ের মধ্যে সাউদার্ন করিডোর করা গেলে ২ হাজার ৩৯৯ কিলোমিটার দূরত্ব কমে প্রায় ৭০০ কিলোমিটার হতে পারে। এতে সাউদার্ন করিডোরের ট্রানজিট সুবিধার মাধ্যমে ভারত, চীন, ভুটান ও নেপাল নানাভাবে উপকৃত হবে এবং তাদের বহির্বাণিজ্যের জন্য মোংলা বা পায়রা সমুদ্রবন্দর ব্যবহারের সুযোগ হবে। সর্বোপরি সবদিক দিয়েই বাংলাদেশ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল, ভুটান, নেপাল, মিয়ানমার ও চীনের ইউনান প্রদেশের ট্রানজিটের কার্যকর গেটওয়ে হতে পারে।

পরিশেষে বলব, অর্থনীতির উন্নয়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ রক্ষণশীল চিন্তাভাবনা ত্যাগ করে প্রতিবেশী দেশ ছাড়াও ভারত-মিয়ানমার-থাইল্যান্ডের ত্রিপক্ষীয় হাইওয়েসহ মহাদেশীয় আরো কয়েকটি যোগাযোগ প্রকল্পের উদ্যোগে অংশীদার হওয়ার চিন্তাভাবনা করছে। তবে আঞ্চলিক ও উপ-আঞ্চলিক যেকোনো চুক্তির প্রস্তাব সুচিন্তিতভাবে দরকষাকষির মাধ্যমে গ্রহণ-বর্জন করতে হবে। কোন প্রস্তাব বাংলাদেশের জন্য ভবিষ্যতে অধিকতর সুবিধা এনে দেবে এবং লাভজনক হবে, তা নিরূপণে ব্যাপকভিত্তিক গবেষণার প্রয়োজন। সব ধরনের প্রস্তাব ও তার বিকল্প নিয়ে বিস্তারিত ও সম্যক ধারণাপত্র প্রণয়ন করা না থাকলে অংশীদার দেশগুলোর সঙ্গে দরকষাকষিতে পিছিয়ে পড়তে হবে। এ অঞ্চলের জনগণ, ব্যবসায়ী ও নীতিনির্ধারকদেরও মনে রাখা প্রয়োজন, আমেরিকার প্রতিষ্ঠাতা জনকদের মধ্যে একজন বেনজামিন ফ্রাঙ্কলিন বলেছিলেন, ‘এ পৃথিবীতে একমাত্র মৃত্যুবরণই হলো নিষ্কর’, বার্নার্ড শও আক্ষেপ করে বলেছিলেন, ‘আমার একটি নাটক জনপ্রিয় হলে বিশাল অংকের করের কারণে আমি শেষ হয়ে যাব।’ কিন্তু উত্তরসূরি সম্রাটরা যেখানে মূত্র বিসর্জনের ওপরও কর আরোপ করছিলেন, সেখানে রোমের সম্রাট আরোনিয়ান কর ও শুল্ক তুলে দিয়ে এ-সংক্রান্ত সব কাগজপত্র মহা-আড়ম্বরে পুড়িয়ে দিয়ে রোমান সাম্রাজ্যকে অধিকতর সমৃদ্ধ ও স্থায়ী করেছিলেন।

ড. আইনুল ইসলাম: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়; সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।