নীলফামারীর ১৩ দর্শনীয় স্থান
৩০ নভে ২০২২, ১২:২৬ অপরাহ্ণ

ডেস্ক নিউজ: বাংলাদেশে শীতকাল অন্যতম আকর্ষণীয় ও মোহনীয়। অনেকেই শীতকালকে ভ্রমণের মৌসুম বলে থাকেন। এ সময়টাকে উপভোগ করতে সবাই যে যার মতো বন্ধু-স্বজন নিয়ে ছুটে চলেন দেশের এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে। আবার কেউ কেউ যান বিদেশ ভ্রমণেও। কর্মব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে শীতের এই সময়ে কিছুটা প্রশান্তির জন্য আপনি যখন মুখিয়ে আছেন তখন উত্তরের জেলা নীলফামারী হতে পারে আপনার ভ্রমণের জন্য উপযুক্ত জায়গা।
নীলসাগর
সমুদ্র নয়, তবে সমুদ্রের নামের সঙ্গে মিল রেখে ১৯৮০ সালে নামকরণ হয়েছে ‘নীলসাগর’। এর আয়তন ৯৩.৯০ একর। তবে গভীরতা আজও নির্ধারণ করা যায়নি। ধারণা করা হয়, বছর জুড়ে ৮০ থেকে ৮৫ ফুট পানি থাকে এখানে। সাগরপাড়ে আছে বৃক্ষরাজি তরুলতা, সুউচ্চ পাড় বেষ্টিত বেত বন ও গুল্মলতা। শীতের দিনে অতিথি পাখির কলতানে মুখর হয়ে ওঠে এ এলাকা।
নীলসাগর রেস্ট হাউস
১৯৮০ সালে এই দীঘি আধুনিকায়ন করেন নীলফামারীর তৎকালীন জেলা প্রশাসক আব্দুল জব্বার। সংস্কার কাজের উদ্বোধনকালে তিনি এর নাম দেন ‘নীলসাগর’। এই স্থানের নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, পত্রিকা, যানবাহন, এমনকি নীলফামারী-ঢাকাগামী আন্তঃনগর ট্রেনের নামকরণ হয়েছে।
বিনোদন কেন্দ্রটি জেলা শহর থেকে ১৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে নীলফামারী-দেবীগঞ্জ-পঞ্চগড় সড়কের পাশে অবস্থিত। জেলা শহর থেকে ভ্যান, অটোরিকশা, বাস, মাইক্রোবাস, ট্রেনে যোগাযোগের সুব্যবস্থা রয়েছে। এছাড়া আকাশপথে সৈয়দপুর বিমানবন্দর থেকে বাস বা ট্রেনে আসা যায়।
তিস্তা ব্যারেজ
প্রতিদিন দর্শনার্থীদের সমাগমে মুখর হয়ে ওঠে এই এলাকা। ব্যারাজটি এক নজর দেখার জন্য কুড়িগ্রাম, রংপুর, লালমনিরহাট, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড় ও বগুড়া জেলার ভ্রমণপিপাসুরা প্রতিদিন ভিড় করেন। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী তিস্তা। এটি ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পর বাংলাদেশে এসে তিস্তা ব্রহ্মপুত্র নদের সঙ্গে মিলিত হয়েছে।
তিস্তা নদীর মোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিলোমিটার। এর মধ্যে ১১৫ কিলোমিটার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে লালমনিরহাট জেলায় অবস্থিত। আর দর্শনীয় ব্যারাজটি তিস্তা সেচ প্রকল্পের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত বৃহত্তম সেচ প্রকল্প। নীলফামারী, রংপুর ও দিনাজপুর জেলার ৫ লাখ ৪০ হাজার হেক্টর উত্তরাঞ্চলের খরাপীড়িত এলাকা হওয়ায় ১৯৩৭ সালে তিস্তা ব্যারাজ নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তবে এর মূল পরিকল্পনা করা হয় ১৯৫৩ সালে।
নীলকুঠি
কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, তেঁভাগা আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন ও ৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ নীলফামারীর ইতিহাসে গৌরবময় কিছু অধ্যায়। ১৮০০ খ্রিস্টাব্দে মৌজা নটখানায় নীলচাষের একটি বৃহৎ খামার ছিল। ১৮৪৭-৪৮ খ্রিস্টাব্দে নীলচাষে লোকসান হওয়ায় কৃষকরা মুখ ফিরিয়ে নেয়। এতে নেমে আসে নিরহ কৃষকদের ওপর নিপীড়ন, নির্যাতন ও অত্যাচার। ১৮৫৯-৬০ সালে কৃষকদের ব্যাপক আন্দোলনের ফলে নীলচাষ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। তখন এলাকা ছেড়ে নীলকরেরা পালিয়ে যায়। সেই নীল খামার থেকে নীল খামারি আর বর্তমানে নীলফামারী নামের সার্থকতা লাভ করে। তাই জেলাবাসীর মুখে মুখে বহমান- ‘নীলখামারের নীল খামারি-নীল বিদ্রোহে আজ নীলফামারী।’
কুন্দুপুকুর মাজার
নীলফামারী শহর থেকে চার কিলোমিটার দূরে কুন্দুপকুর ইউনিয়নে অবস্থিত কুন্দুপুকুর মাজার। এ এলাকায় ইসলাম প্রচার করতে আসা সুফি হযরত মীর মহিউদ্দিন চিশতির (র.) মাজার এটি। ৩০ একর জমি জুড়ে রয়েছে মাজার ও মাজার সংলগ্ন পুকুর। প্রতি বছরের ৫ মাঘ থেকে তিন দিন ওরশ অনুষ্ঠিত হয় এখানে। জনশ্রুতি আছে, ওই পুকুরের পানি পান করলে মানুষ বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্তি পায়। এজন্য সারাবছর বিভিন্ন এলাকার মানুষ এখানে ফিরনি এনে তবারক হিসেবে দেওয়া হয়।
ভীমের মায়ের চুলা
ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নীলফামারীর কিশোরগঞ্জে ভীমের মার আখাঁ (ভীমের মায়ের চুলা)। তিনদিক উঁচু মৃৎ-প্রাচীর বেষ্টিত স্থাপনার যার প্রাচীরের উপরের তিনটি স্থান অপেক্ষাকৃত উঁচু। ভিতরের অংশ গভীর এবং বাইরের তিনদিকে প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত। প্রায় কয়েক’শ বছর আগে মহাভারতের পঞ্চপাণ্ডবদের মধ্যে দ্বিতীয় ভীম এ জায়গাটিতে অবস্থান নিয়ে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। ভীমের মা কুন্তিদেবী যুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের রান্নার জন্য তৈরি করেন একটি চুলা। এই চুলায় একসঙ্গে ১০ হাজার যোদ্ধাদের জন্য করা হতো রান্নাবান্না।
এর পূর্ব-দক্ষিণে একটি বাঁশবাড়ি রয়েছে। চুলার ব্যবহার্য জ্বালানি/খড়ির উদ্ধৃতাংশ এখানে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। সেই উদ্ধৃত বাঁশের মুড়া থেকে এ বাঁশ গজিঁয়ে উঠেছে। এর দক্ষিণ পাশে ‘মারগলা’ নদী হিসেবে প্রবাহিত। লোককাহিনী রয়েছে ভীমের এক সন্ধ্যার খাবারেই পরিবেশিত হয়েছিল ৭টি মহিষের ভর্তা। পরবর্তীতে ইতিহাসের স্বাক্ষী স্বরুপ বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকজন এ চুলাটি দেখতে আসে।
কিশোরগঞ্জ উপজেলা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম দিকে প্রায় দু’শ মিটার দূরে পুটিমারী ইউনিয়নের কাচারীপাড়া গ্রামে অবস্থিত ভীমের মার আখাঁ। এটি তিনদিক থেকে উঁচু মাটির প্রাচীর দিয়ে ঘেরাও করা। যার উপরের তিনটি তুলনামূলকভাবে উঁচু। এর ভেতরের অংশ গভীর এবং বাইরের তিনদিক প্রায় ২০ ফুট প্রশস্ত পরিখা বেষ্টিত। ফলে আবিস্কৃত স্থাপনাটি চুলার আকারে পরিদৃষ্ট হয়।
ধর্মপালের রাজবাড়ী
ধর্মপালের গড়ের কাছাকাছি একটি মজা জলাশয় রয়েছে, জলাশয়ের পাড় বাধানো ঘাট এবং কয়েক ফুট উচু ঢিবি রয়েছে, এই ঢিবির ভিতরের প্রাচীরে ইট দেখেই ধারণা করা হয় এটি ধর্মপালের রাজবাড়ি। গড় ধর্মপালের কাছাকাছি নদীর তীরে ধর্মপালের রাজ প্রাসাদ ছিল।
হরিশচন্দ্রের পাঠ
হরিশচন্দ্র পাঠ বাংলাদেশের নীলফামারীর জলঢাকার খুটামারা ইউনিয়নের একটি গ্রাম। একে সেখানকার রাজা হরিশচন্দ্রের নাম অনুসারে গ্রামের নামকরণ করা হয়। রাজা হরিশচন্দ্র দানবীর হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এ অঞ্চলে তাকে নিয়ে অনেক পালাগান, যাত্রাপালা রচিত হয়েছে। কথিত আছে রাজা হরিশ্চন্দ্রের কন্যা অধুনা’র সঙ্গে রাজা গোপী চন্দ্রের বিয়ে হয়। তৎকালীন প্রথা অনুসারে গোপী চন্দ্র দান হিসেবে তার ছোট শ্যালিকা পদুনাকেও পান। এ নিয়েও অনেক গল্প প্রচলিত আছে। হরিশচন্দ্র পাঠ গ্রামে অনেক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ আজও তার স্মৃতি বহন করছে। হরিশচন্দ্রের শিবমন্দিরে বছরে ৩টি উৎসব এই মন্দিরকে ঘিরে বেশ ধুমধাম করে পালিত হয়।
সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা
নীলফামারী জেলার সৈয়দপুর দেশের প্রাচীন শহরগুলোর মধ্যে একটি। ব্যবসা-বাণিজ্যের জন্য এই শহর অনেক আগে থেকে প্রসিদ্ধ হলেও অনেকের কাছে রেলের শহর হিসেবে বেশি পরিচিত। ১৮৭০ সালে ১১০ একর জমির ওপর সৈয়দপুরে নির্মিত হয় দেশের প্রাচীন এবং বৃহত্তম রেলওয়ে কারখানা। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত এ রেল কারখানার ২৬টি উপ-কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করে থাকেন। রেলের ছোট বড় যন্ত্রাংশ থেকে শুরু করে ব্রডগেজ ও মিটারগেজ লাইনের বগি মেরামতসহ সব কাজ করা হয় এই কারখানায়। রেলওয়ে সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান অর্জনে দেশের বিভিন্ন কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ছাড়াও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ এই কারখানা পরিদর্শন করেন।
যেভাবে যাবেন নীলফামারী
একটু আরামদায়ক ও ক্লান্তিহীন ভ্রমণ চাইলে ট্রেনই জুতসই। ঢাকা থেকে রেলপথে নীলসাগর এক্সপ্রেস ট্রেনে করে সৈয়দপুর বা নীলফামারী আসতে পারবেন। এরপর সড়ক পথে এসব দর্শনীয় স্থানে যাওয়া যায়। সড়কপথে ঢাকার গাবতলী, উত্তরা, মহাখালী, কল্যাণপুর থেকে নীলফামারী বা সৈয়দপুর আসার জন্য এসি/ননএসি বাস সার্ভিস রয়েছে। এছাড়া আরামদায়ক এবং অল্প সময়ে উড়ালপথেও সৈয়দপুর আসতে পারেন।