দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : বরেণ্য দার্শনিক ও সার্থক শিক্ষাগুরু - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সন্ধ্যা ৭:২৫, ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : বরেণ্য দার্শনিক ও সার্থক শিক্ষাগুরু

newsup
প্রকাশিত ডিসেম্বর ৩০, ২০২২
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ :  বরেণ্য দার্শনিক ও সার্থক শিক্ষাগুরু

-ম. আমিনুল হক চুন্নু : ১৩০৪ সালে হজরত শাহজালাল (রহ.) এর শ্রীহট্ট জয়ের মাধ্যমে এই জনপদ পাদপ্রদীপের আলোয় আসে। এই মহান সাধকই সিলেটে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁরই অনুসারীরা একে বিভিন্ন অংশে ভাগ করে শাসন করতে থাকেন। ১৫৭৬ সালে স¤্রাট আকবরের সময় বঙ্গদেশ মোঘল শাসনের অধীন হলে সিলেটও অন্তভর্‚ক্ত হয়। ১৫৮২ সালে পুরো বঙ্গদেশ ১৯টি সরকার ও ৬৮২টি পরগনায় ভাগ করা হয়। পাঠান আমলের ইতিহাসও সিলেটে ছিল বলে জানা যায়। মোঘল ও পাঠানরা ফৌজদারদের মাধ্যমে সিলেটের শাসন চালাতেন।

১৯৫৭ খ্রীষ্টাব্দে পলাশীর পরাজয়ের আট বছর পর ১৭৬৫ খ্রীষ্টাব্দে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী বাংলা বিহার ও উড়িষ্যার দেওয়ানী সনদ লাভ করে। এ বছরই সিলেট বৃটিশ শাসনের আওতায় আসে। কোম্পানীর প্রথম প্রতিনিধি (কালেক্টর) নিযুক্ত হন মি. জনসামনার (১০ফেব্রæয়ারী ১৭৭১-১৭মার্চ ১৭৭৪খ্রী.)। শাসন কার্যের সুবিধার জন্য ১৮৭৭ খ্রীষ্টাব্দে সুনামগঞ্জ মহকুমা, ১৮৭৮ খ্রীষ্টাব্দে করিমগঞ্জ ও হবিগঞ্জ মহকুমা, ১৮৮২ খ্রীষ্টব্দে দক্ষিণ সিলেট বা মৌলভীবাজার মহকুমা প্রতিষ্টিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৮৪ সালে এই চারটি মহকুমাকে জেলাতে রূপান্তরিত করা হয়।

১৯০৫ সালে সিলেটকে আবার পূর্ব বঙ্গের সাথে যুক্ত করা হয়। ১৯১১ সালে বঙ্গ বিভাগ বাতিল হলে সিলেট আবার আসামের সাথে অন্তভর্‚ক্ত হয়। ১৯৪৭ সালে গণভোটের মাধ্যমে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে অন্তভর্‚ক্ত হয় সিলেট। ইতিহাস-ঐতিহ্য আর সম্পদে ভরপুর সিলেট বিভাগ বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। প্রাচীনকালে অস্ট্রিক, মঙ্গোলীয় ও আর্য জাতিদের সিলেট বিভাগে আগমন ঘটে ছিল। এক সময় সিলেট বিক্রমপুরের চন্দ্র বংশীয় রাজাদের অধীনে ছিল। হজরত শাহজালাল (রহ.) এর সিলেট আগমন বাংলার ইতিহাসে এক উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তাছাড়া ৯ মাসের প্রত্যক্ষ লড়াইয়ে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতা অর্জন করে।
আসামের সাথে সিলেটের সংযুক্তি সিলেটবাসীকে প্রতিনিয়ত অস্তিত্বের সংগ্রামে নিয়োজিত রাখলেও কখনও কিন্তু তারা সেই সংগ্রামে পিছনের সারিতে ছিলেন না। বরং সমাজের অগ্রসরমান রাজনৈতিক চেতনাসমৃদ্ধ জাতিতে নিজেদেরকে পরিণত করে ইতিহাসে স্থান করে নিয়েছিলেন। সিলেটের কৃতি সন্তানদের মধ্যে লাউড়ী সৈয়দ সুলতান, ষস্টীবর দত্ত, শেখ চান্দ, ইদাত উল্লাহ (আধ্যাতি¦ক সাধক) সৈয়দ শাহনুর, রাধারমন দত্ত, হাছন রাজা, কথা সাহিত্যের প্রাণ পুরুষ সৈয়দ মুজতবা আলী, বিপিন চন্দ্র পাল, খান বাহাদুর আব্দুল মজিদ (কাপ্তান মিয়া), ফজলুল হক সেলবর্ষী, আবু নছর মোহাম্মদ ওহীদ, আব্দুল মতিন চৌধুরী, জোবেদা খাতুন চৌধুরী, বসন্ত কুমার দাস ও জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ প্রমুখ সিলেটের মাটিতে জন্ম নিয়ে সিলেট বিভাগকে মর্যাদার আসনে বাংলাদেশের বুকে প্রতিষ্টিত করেছেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ একটি নাম, একটি ইতিহাস। আমাদের জাতিসত্তার বিকাশ ও বিনির্মানে যাঁদের নাম শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করতে হয়, সর্বজনমান্য দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাঁদের প্রথম কাতারের দার্শনিক ও মনীষী। এ কথা সর্বজন স্বীকৃত যে, ইতিহাস-ঐতিহ্যকে লালন ও নিয়ন্ত্রণ করে মানুষ, মানুষ যেমন রাজ্যকে ভাঙতে পারে তেমনি রাজাকেও উল্টাতে পারে। এ ভাঙ্গা-গড়ার পেছনে কাজ করেন গবেষক ও ঐতিহাসিকবিদরা।
প্রত্যেক সমাজেই কিছু বহুমুখী প্রতিভার দুর্লভ মানব সন্তান জন্ম গ্রহণ করেন। যাঁদের সারা জীবনভর ত্যাগ, মনন ও মেধার কারণে মানবমন্ডলী উপকৃত হয়। সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক পরিমন্ডলের কুয়াশা দূরীভ‚ত হয় যাঁদের জীবন সূর্যের আলোক রশ্নিতে- দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাঁদের একজন।
জাতীয় জীবনে নেমে আসা দূর্বহ সময়ে বিপন্ন বনিআদমের আর্তি আকুতি যাঁদের হৃদয় স্পর্শ করে- দার্শনিক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ তাদের হৃদয়ের কাছের মানুষ।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ বাংলাদেশের জাতীয় অধ্যাপক, উপমহাদেশের অন্যতম শ্রেষ্ট দার্শনিক, লেখক, উপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, গবেষক, প্রাবন্ধিক, সাহিত্য সমালোচক, শিক্ষাবিদ, রাজনীতিবিদ, সমাজ সংস্কারক, সম্পাদক, সাহিত্য সংগঠক, ইসলামী চিন্তাবিদ- বহুমুখী প্রতিভার উজ্জ্বল এক নক্ষত্রভরা আকাশ। ভাষা আন্দোলনের অন্যতম প্রাণপুরুষ। আইন সভার সদস্যও ছিলেন। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে কারাবরণও করেছেন। বড় বিচিত্র তাঁর জীবন- বর্ণিল তার সত্য সন্ধানী অভিযাত্রা। জীবনের বহু ক্ষেত্রে বিচরণ করেছেন, তবে তাঁর বড় পরিচয় তিনি জ্ঞানের সাধক, আজীবন জ্ঞানের চর্চা করে গিয়েছেন। সৃস্টিশীল সাহিত্যেও রেখে গিয়েছেন অবদান। একুশ শতকে দেশ ও দেশবাসী যাঁদের নিয়ে গর্বিত তিনি তাঁদের প্রথম সারির একজন।
হজরত শাহজালাল (রহ.)সহ ৩৬০ আউলিয়ার স্মৃতিধন্য সিলেট বিভাগের সুনামগঞ্জ জেলার দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়ার জমিদার পরিবারের সন্তান- দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফের জন্ম ২৫ অক্টোবর ১৯০৬ সনে সুনামগঞ্জ শহরস্থ তেঘরিয়া গ্রামে মরমী কবি দেওয়ান হাছন রাজার বাড়িতে। তাঁর মা ছিলেন হাছন রাজার বড় মেয়ে রওশন হোসেইন বানু। বাবা দেওয়ান আসক ছিলেন দুহালিয়ার জমিদার। তিনি ছিলেন একজন নামকরা রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, সমাজসেবী ও বৃটিশ খেদাও আন্দোলনের নেতা।
দেওয়ান আজরফ তাঁর নানা হাসন রাজার আদরে সোহাগে বেড়ে উঠেন। মায়ের কাছে বর্ণ পরিচয় লাভ করার পর পারিবারিক পরিবেশে গৃহ শিক্ষকের মাধ্যমে লেখাপড়া করেন। প্রথমে দুহালিয়া মধ্য ইংরেজি স্কুলে ভর্তি হন। পরে ১৯২৫ সনে জুবিলী হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে ম্যাট্টিক পাশ করেন। ১৯২৭ সনে মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে প্রথম বিভাগে আই এ পাশ করেন। ১৯৩০ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এ এবং ১৯৩২ সনে দর্শন শাস্ত্রে এম এ ডিগ্রী লাভ করেন।
১৯৩৭ সালে গোলাপগঞ্জ থানার মোহাম্মদ চৌধুরী (এমসি) একাডেমীর প্রধান শিক্ষকের দায়িত্বে ছিলেন। পরে এমসি কলেজ সিলেট এ সহকারী অধ্যাপক পদে যোগদান করেন। ১৯৪৮ সালে সুনামগঞ্জ কলেজে ইংরেজি, বাংলা ও যুক্তিবিদ্যা বিষয়ের অধ্যাপক পদে, ১৯৫২ সালে উপাধ্যক্ষ হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬৫ নরসিংদী কলেজ, ১৯৬৫ থেকে ১৯৬৭ মতলব কলেজে এবং ১৯৬৭ থেকে ১৯৮০ সাল পর্যন্ত আবুযর গিফারী কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দক্ষতার সাথে পালন করেন। ১৯৭২ থেকে ১৯৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন ও ইসলামিক ষ্টাডিজ বিভাগের খন্ডকালীন অধ্যাপক পদে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৯৩ সনে অক্টোবরে বাংলাদেশ সরকার জাতীয় অধ্যাপক পদে ভ‚ষিত করার পূর্বে তিনি অধ্যক্ষ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ নামেই স্বদেশ ও বিদেশে পরিচিত ছিলেন।
দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ১৯১৮ সালে ‘শিয়াল মামা’ শীর্ষক একটি গল্পের মাধ্যমে সাহিত্যাঙ্গনে প্রবেশ করেন। এই ছোট গল্পটি সে সময়ে কলিকাতার মাসিক ‘শিশু’ পত্রিকার সম্পাদক কর্তৃক গৃহীত হয়েছিল। কিন্তু পত্রিকাটি হঠাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়াতে গল্পটি আর প্রকাশ হয়নি। তাছাড়া ‘যাত্রী’ নামে একটি কবিতা মুরারীচাঁদ কলেজ ম্যাগাজিনে ১৯২৫ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল। গল্প লিখেছেন ১০৭টিরও অধিক। গল্প গ্রন্থ, উপন্যাস, নাটক, প্রবন্ধ ও আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থসহ তাঁর গ্রন্থ সংখ্যা পঁঞ্চাশাধিক। বাংলা ও ইংরেজিতে তাঁর রচনার অধিকাংশই প্রবন্ধ।
প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে তমদ্দুনের বিকাশ. সত্যের সৈনিক, আবুজর, ইতিহাসের ধারা, নতুন সূর্য (গল্প), জীবন সমস্যার সমাধানে ইসলাম, ঝপরবহপব ধহফ জবাড়ষঁঃরড়হ, ইসলামী আন্দোলন যুগে যুগে, ইধপশমৎড়ঁহফ ড়ভ ঃযব ঈঁষঃঁৎব ড়ভ গঁংষরস ইবহমধষ, ইসলাম ও মানবতাবাদ, চযরষড়ংড়ঢ়যু ড়ভ ঐরংঃড়ৎু, অনঁ উযধৎৎ এধরভধৎর, জীবন দর্শনের পুনর্গঠন, সন্ধানী দৃষ্টিতে ইসলাম, দর্শনের নানা প্রসঙ্গ, মরমী কবি হাসন রাজা, ইতিহাসে উপেক্ষিত একটি চরিত্র, ধর্ম ও দর্শন, নয়া জিন্দেগী (উপন্যাস), ব্যক্তিত্বের বিকাশ (অনুবাদ), অতীত দিনের কথা (আত্মজীবনী) উল্লেখযোগ্য।
অধ্যাপক মোহাম্মদ আজরফের অসংখ্য পান্ডুলিপি পড়ে রয়েছে। বিশ্বাসের প্রশ্নে অবিচল থাকায় তাঁর বিশ্বাস ও আদর্শের স্বপক্ষে উচ্চারণ সুস্পষ্ট ও বলিষ্ট থাকায় অনেকে তাঁর বই প্রকাশে আগ্রহ দেখান না। তাঁকে কিছুটা ছাড় দিতে বলেন অনমনীয় এবং সত্যের নিয়ত অনুগামী আজরফ বলেছেন- ‘আমার একটি বইও যদি প্রকাশিত না হয় তবুও আমি আমার বিশ্বাসের প্রশ্নে কোনো আপোষ করব না। আমি আর যা-ই হই, অন্তত মোনাফিক নই। জীবন ও কর্মে, বিশ্বাস ও চেতনায় মোনাফেকীতে আমি বিশ্বাস করি না, ঘৃনা করি-; ঘৃনা।’
প্রকাশিত গ্রন্থ, প্রকাশিত পান্ডুলিপি ছাড়াও জাতীয়, আন্তর্জাতিক, বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক, সাময়িকী, স্মারক, জার্নাল ও সংকলনে দেওয়ান আজরফের অসংখ্য লেখা প্রকাশিত হয়েছে- সে হিসেব তিনি নিজে যেমনি দিতে পারবেন না, অন্যের পক্ষেও প্রকৃত তালিকা প্রস্তুত অনেকটা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে।
গণমানুষের কবি দিলওয়ারের কবিতায় আজরফ কেমন ———?
‘ধ্রæপতি অন্বেষণে’ দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফকে নিবেদিত কবিতায় দিলওয়ার লিখেছেন-
‘‘হে বৃক্ষ নীরব কেনো
লা-ইলাহা’ উচ্চারণ করে।
বাকী হতে যুক্ত করো
স্ফুতি করো আলিঙ্গন ভরে।
আজন্ম নির্বাক বৃক্ষ
কথা বলে মর্মর ধ্বনিতে
ঃ এখনো আসেনি বন্ধু
পল্লবিত চোখের মনিতে।
প্রশ্নকারী রোমাঞ্চিত,
বিশ্বের ঘরে তার নারী
এখনো নিখোঁজ কি না,
ইল্লাল্লার অনল পিয়ারী।”
দেওয়ান আজরফ ১৯৪৬ সালে আসাম প্রাদেশিক পরিষদের আপার কাউন্সিলের সদস্য নির্বাচিত হন। বৃটিশ খেদাও আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। কারাবরণ করেছেন অনেক দিন আসাম সরকারের জন বিরোধী কার্যক্রমে প্রতিরোধ আন্দোলনে মাওলানা ভাসানীর আহŸানে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে। ১৯৪৭ সালে আসাম সরকারের ‘বঙ্গাল খেদা’- অভিযানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ-প্রতিরোধমূলক আন্দোলনে নের্তৃত্ব দেন এবং শিলচরে ১৪৪ ধারা অমান্য করে কারাবরণ করেন। ১৯৪৭ সালে আসামে প্রাদেশিক মুসলিমলীগ কর্তৃক নির্বাচিত হয়ে কলিকাতায় সীমানা নির্ধারণ কমিশনের নিকট ১৩ বার স্মারকলিপি পেশ করেন। ১৯৪৯ সালে যোগদান করেন ভাষা আন্দোলন ও ইতিহাস-ঐতিহ্য ভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসে। সে সময় থেকে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৪৮ সালে সিলেটে বিভিন্ন জমিদারের জমিদারিত্বে নি¤œ শ্রেণির লোকদের ভ‚মিতে স্বত্ববান হওয়ার আন্দোলনের সূচনা করেন। নিজে জমিদার হওয়া সত্তে¡ও জমিদার বিরোধী নানকার আন্দোলনে জোরালো সমর্থন ও নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং এক মাসের মধ্যে আপন জমিদারিতে এক হাজার নানকারকে জমির স্বত্ব প্রদান করেন। তাছাড়া ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৬ সাল প্রায় দেড় বছর জেলে ছিলেন। ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সাল পর্যন্ত ভাষা আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশ গ্রহণ করেন।
১৯৩৬ সালে মোহাম্মদ নুরুল হক ও অন্যান্যদের সহযোগিতায় সিলেট কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ প্রতিষ্ঠা করেন। মোহাম্মদ আজরফ পরপর দুবার এ সংসদের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৩৭ সালে মোতাওল্লীরূপে পৈতৃক ওয়াক্ফ সম্পত্তি পরিচালনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
১৯৪৮- এ ‘সাপ্তাহিক নও বেলাল’ এর প্রধান সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৫৪ সালে পাকিস্তান দর্শন সমিতির সদস্য পদ লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে বাংলা একাডেমীর কাউন্সিলর হন। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান দর্শন সমিতির লাহোর কংগ্রেসে ধর্ম দর্শন শাখার অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন এবং ১৯৬২-৬৩ তে বাংলা কলেজের গভর্ণিং বডির সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান দর্শন কংগ্রেসের অধিবেশনের একটি শাখায় সভাপতিত্ব করেন। ১৯৬৬ সালে বিজাতীয় সংস্কৃতি বিরোধী আন্দোলনে বলিষ্ট ভুমিকা রাখেন এবং একই বছর নজরুল একাডেমী প্রতিষ্ঠায় তাঁর ভুমিকা ছিল। ১৯৫৮ সালে অনেক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিদের সহযোগিতায় গড়ে তোলেন দারুল উলুম ইসলামিক একাডেমী। ১৯৬১ সালে উক্ত প্রতিষ্টানটিকে তৎকালীন পাকিস্তান সরকার ইসলামিক একাডেমী নামকরণ করে আল্লামা আবুল হাসিমকে এর পরিচালক নিযুক্ত করেন। যা বর্তমানে ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে পরিচিত। দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ আজীবন মানুষের কল্যাণের জন্য নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে গিয়েছেন। তাঁর নানা দেওয়ান হাসন রাজা ও মামা দার্শনিক ও কবি দেওয়ান একলিমুর রাজা কাব্যবিশারদ এর প্রভাব তাঁর উপর ছিল। পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত কুয়েটা টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত পয়েটস্ এন্ড ফিলসপারস্ অব ইষ্ট পাকিস্তান নামক আর্টিকুলে তিনি তার মামা ও নানার কথা উল্লেখ করেন। মামা ও নানা আজরফকে অত্যন্ত ¯েœহ করতেন। মোহাম্মদ আজরফ সম্পর্কে এক গানে দেওয়ান হাছন রাজা বলেন,- ‘পুতের গেল চুল পাকিয়া, নাতির উঠল রেখি।’ তবে দেওয়ান আজরফ ছিলেন একজন সুফি দরবেশ প্রকৃতির ও ইসলামী চিন্তাবিদ।
দেশ ও জাতি অপরিশোধ্য ঋনে-ঋনী তাঁর কাছে। তিনি সাহিত্য সাধনা করেছেন অন্তরগত প্রেরণায়। হৃদয়ের টানে এবং জাতীয় কল্যাণে। তাই রবীন্দ্রনাথের ভাষায় —
অন্তর হতে আহরি বচন
আনন্দলোক করি বিচরণ
গীতিরস ধারা করি সিঞ্চন
সংসার ধুলি জালে ————–।

সাহিত্য যুগে যুগে মানব হৃদয়ে আনন্দ ধারা প্রবাহিত করে চলেছে। রাজনীতি ও অর্থনীতির নীতিমালা মানব কল্যাণে যা করতে পারেনি সাহিত্য এর চেয়ে অধিক অবদান রেখেছে। জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজ-সভ্যতা, সংস্কৃতি, ধর্ম-দর্শন, ইতিহাস-ঐতিহ্য, শিল্প-সাহিত্য সকল ক্ষেত্রে তাঁর অগাধ পান্ডিত্য, জ্ঞানগর্ভ আলোচনা, অবিরাম লেখনী সককিছু মিলিয়ে দেওয়ান আজরফ এক বিস্ময়কর কম্পিউটার ও জীবন্ত বিশ্বকোষ।
দেওয়ান আজরফ আন্তর্জাতিক সম্মেলন ও সেমিনারে বিভিন্ন অধিবেশনে যোগদান, বক্তৃতা ও প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। নি¤েœ সংক্ষিপ্তভাবে আলোচনা করা হলোÑ ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান দর্শন সমিতির প্রতিনিধি হয়ে নিখিল ভারত দর্শন সমিতির আন্নামালাই নগর অধিবেশনে যোগ দিয়ে চযরষড়ংড়ঢ়ু ড়ভ ঃযব ঐরংঃড়ৎু বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং চৎড়পবংং ড়ভ জবাড়ষঁঃরড়হ বিষয়ে আলোচনায় অংশ গ্রহণ করেন। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান দর্শন সমিতির প্রতিনিধি হয়ে দিল্লীতে পাক-ভারতীয় সংস্কৃতিক সম্মেলনে যোগদান এবং সেখানে ঊফঁপধঃরড়হ ড়ভ গড়ৎধষরঃু বিষয়ে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৬২ সালে ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে বাগদাদ নগরীর সহ¯্র প্রতিষ্টা বার্ষিকী এবং দার্শনিক আনকিন্দির জন্ম সহ¯্র বার্ষিকীতে যোগ দেন। তাছাড়া আলকিন্দির জন্মবার্ষিকী অনুষ্টানে একটি প্রবন্ধ পাঠ করেন। ১৯৬৩ সালে ইরাক সরকারের আমন্ত্রণে ঐতিহাসিক আলকিন্দির মৃত্যু বার্ষিকীতে ছোট একটি প্রবন্ধ উপস্থাপন ও পরে আলোচনায় অংশ নেন। ১৯৮১ সালে ভারত সরকারের আমন্ত্রণে শান্তি নিকেতনে রবীন্দ্র ভারতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রব্বানী’ দর্শনের উপর বক্তৃতা করেন। ১৯৮৪ সালে দক্ষিণ কোরিয়ার রাজধানী সিউলে অনুষ্টিত ধর্ম সম্মেলনে ঋধরঃয ধহফ জবধংড়হ প্রবন্ধ উপস্থাপন এবং ১৯৮৫ সালে ইতালির রোমে ধর্ম সম্মেলনে যোগ দিয়ে ঐড়ষরহবংং রহ ওংষধস শিরোনামে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। ১৯৮৬ সালে ইরান সরকারের আমন্ত্রণে বিপ্লব বার্ষিকীতে যোগদান এবং বিভিন্ন সম্মেলনে অংশ গ্রহণ করেন। অন্যদিকে মোহাম্মদ আজরফ এর দেশ-বিদেশে বিভিন্ন সম্মেলনে প্রবন্ধ উপস্থাপন ও তাঁর বক্তৃতার গভীর উপলব্ধির সঙ্গে নিরপেক্ষতা তাঁর সমস্তের মধ্যেই একটি শান্ত মাধুর্য ও লাবণ্যের সঞ্চার ঘটে। ঘরোয়া আলাপেও তিনি বিস্ময়কর রকম মধুর ছিলেন। অচূর্ণ স্মৃতি তার তথ্য থেকে তত্তে¡ তার অবিশ্রাম যাওয়া-আসা।
জীবনকে মনে হয় তিনি অপরূপ এক শান্ত সহজতায় গ্রহণ করেছেন। “পোড়া বাড়ি আর ভাঙ্গা দরজাকে তিনি মিলিয়ে নিয়েছেন তাঁর ভিতরে”- শতায়ূ প্রায় এ জ্ঞান সাধককে ঘিরে আমাদের আকাংখা-
-“দিয়ে যাও প্রেরণা-
প্রেমপন্থী সুমহান আদর্শের পথে।”

জাতীয় জাগরণ, বিকাশ, বিনির্মান ও পূনর্গঠনে আজীবনের সাধনা ও মানবতার কল্যাণে নিরলস নিবেদিত থাকার ফলশ্রæতিতে দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করেছেন, সংবর্ধিত হয়েছেন। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- স্বাধীনতা দিবস পুরস্কার ১৯৮১, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পুরস্কার (সমাজ বিজ্ঞান) ১৯৮৩, বাংলা একাডেমীর ফেলো নির্বাচিত ১৯৮৪, বাংলাদেশ মুসলিম ওয়েল ফেয়ারমিশন পুরস্কার ১৯৮৫, কোরানিক সোসাইটি পুরস্কার ১৯৮৭, অতীশ দীপঙ্কর পুরস্কার ১৯৮৮। মাওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ স্বর্ণপদক ১৯৮৮। বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক ১৯৮৯। জ্ঞানতাপস ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৮৯। খান বাহাদুর আহসান উল্লাহ স্বর্ণপদক ১৯৯০। নাট্যলোক সংবর্ধনা সিলেট ১৯৯০। রোটারী ক্লাব অব ঢাকা প্রাইজ ১৯৯১। বাংলাদেশ জাতীয় সাহিত্য সংসদ স্বর্ণপদক ১৯৯১। বাংলাদেশ সাহিত্য পরিষদ পুরস্কার ১৯৯১। বিশ্বনাথ ছাত্র কল্যাণ সমিতি সংবর্ধনা ১৯৯২। জেলা জাতীয় মঙ্গল সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯২। মৌলভীবাজার পৌরসভা নাগরিক সংবর্ধনা ১৯৯২। একুশে পদক ১৯৯২। স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু পুরস্কার ১৯৯২। জাতীয় অধ্যাপক পদক ১৯৯৩। সুনামগঞ্জ জেলা উন্নয়ন সংস্থা সংবর্ধনা ১৯৯৫। কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদ সংবর্ধনা ১৯৯৬। রাগীব-রাবেয়া সাহিত্য পুরস্কার ১৯৯৮। দেওয়ান আজরফ সতত সত্যান্বেষী। তাঁর এই অন্বেষা তাঁকে টেনে নিয়েছে বিচিত্র জগতে, লাভ করেছেন অবিজ্ঞান। জীবনের ঘাত-প্রতিঘাত, দ্ব›দ্ব-সংঘাত তাঁকে তাঁর বিশ্বাস, আদর্শ ও সত্যান্বেষার সহজাত পথ থেকে বিচ্যুত করতে পারেনি। তিনি গোড়ামী ও অন্ধ বিশ্বাসের বন্ধ খোপে কখনো আবদ্ধ ছিলেন না। ক্রমাগত জ্ঞানচর্চা, পৃথিবীর জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে অবলোকনে অর্জিত অবিজ্ঞান, অখন্ড দর্শনচিন্তা ও প্রজ্ঞার মাধ্যমে সত্যান্বেষার মহাসড়কে তিনি পরিভ্রমন করেছেন ক্লান্তিহীন যাত্রায়। সত্যে উপনীত হয়েছেন, উপলব্দিকে নির্ভয়ে অকপটে উচ্চারণ করেছেন, নৈতিকতার ও মূল্যবোধের অনুশীলন ও মনন-চর্চা থেকে সরে যাননি এক পা-ও। প্রায় ৯৫ বছরের বর্ণাঢ্য বর্ণিল জীবন তিনি কর্ম ও জ্ঞানের সাধনায় নিরন্তর রত ছিলেন।
এই জ্ঞান তাপসের মন ও মুখে একটি কথার বাস্তব রূপায়ন দেখেছি তাঁর মাঝে। কি পেলাম আর কি দিলাম এ নিয়ে কোনদিন আক্ষেপ করতে দেখিনি। তাঁর সাফ কথা-‘কাজের মালিক মানুষ, ফলের মালিক আল্লাহ’। অতএব কাজ কর । কারণ-
এমন মানব জনম আর কি হবে
যা কর ত্বরায় কর মন এই ভবে।
–লালন শাহ
অথবা
মন মনিয়া রে
কোনদিন যাইবায় মনিয়া উড়িয়া রে।
তুমি তো হাওয়াই মনিয়া , হাওয়ায় যাইবায় উড়িয়া
আমি তো মাটির মনিয়া, মাটিতে রইমু পড়িয়া।।
তুমি যে যাইবায় উড়িয়া এই ভাবনা ভাবিয়া
হাছন রাজা ফিরতে আছে কাঁন্দিয়া কাঁন্দিয়া————–।।

দুস্ত-দুশমন কারো প্রতি কোন ধরণের হিংসা-বিদ্বেষ দেখিনি তাঁর মাঝে। যে কেউ বই লিখে হাজির হলে ভ‚মিকা বা মুখবন্ধ জাতীয় শুভকামনার জন্য ব্যাস, কোন কথা নেই। বিষয়বস্তুর আলোকে ব্যক্তি ও বিষয়ের উপর লিখে দিয়েছেন দু’কলম অনায়াসে। তাই এমনিভাবে হৃদয়ের সেতু বন্ধনে আপন করে নেয়ার মানুষ এ যুগে বিরল। যুদ্ধ করে রাজ্য জয় করা গেলেও মানুষের মন জয় করতে হলে প্রয়োজন সহমর্মী অন্তরের। “হৃদয় দিয়ে হৃদয় জয় করলে তা হারানোর ভয় থাকে না”। তাই লোক সাহিত্যের ভাষায় বলতে হয়-
ও মন রইলে অচেতন
ছয় চুরায় লুটিয়া নিল তোমার ঘরের ধন।

বিশ্বপন্ডিত সক্রেটিস বলেছিলেন- অহ টহবীধসরহবফ খরভব রং হড়ঃ ডড়ৎঃয খরারহম. অর্থাৎ পরীক্ষাহীন জীবন মূল্যহীন। আর এই পরীক্ষা নেয়ার একমাত্র প্রতিষ্টান ‘শিক্ষক’। যে কোনো শিক্ষককে একটি প্রতিষ্টানের সাথে তুলনা করা যায়। কোনো কারিগর- যেমন ধরুন, সুতার মিস্ত্রী, রাজমিস্ত্রী, ভাস্কর, শিল্পী প্রত্যেকেই একটি প্রতিষ্টান। তারা নিজেদের কাজের ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে কাজ করেন, তেমনি একজন শিক্ষককে স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে কাজ করতে হয়। শিক্ষাদান সবচেয়ে মহৎ কাজ এই বিশ্ব চরাচরে। নিয়ত আমাদের জীবনের চারপাশে শিক্ষকের কমতি নেই। আমরা নিজেরা শিক্ষকের কাছে যে কতো ঋণী তা বলা বাহুল্য। কোনো ব্যক্তি যদি বিভিন্ন বিষয়ে একজন বিশেষজ্ঞ হন এবং একই সাথে শিক্ষক হন, তার শিক্ষক পরিচয়টা সবচেয়ে সম্মানের। যেমন- সক্রেটিস একজন সাহসী যোদ্ধা ছিলেন, গ্রীকের একজন পাথর কাটার কারিগর ছিলেন, একজন ভাস্কর ছিলেন, কিন্তু সর্বোপরি তাঁর এসব পরিচয়কে ছাপিয়ে বিশ্ব ইতিহাসে তিনি একজন মহান শিক্ষক হিসাবে পরিচিত। কারণ শিক্ষক পরিচিতি অন্য যে কোনো পরিচয়ের চাইতে মহৎ। তেমনি দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দেশ, জাতি ও ধর্মের সেবা করে গিয়েছেন। অতি বৃদ্ধ বয়সেও তিনি ছিলেন সদা কর্ম তৎপর। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে আমরা তাঁকে বই প্রকাশনা, সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে জ্ঞানগর্ভ মূল্যবান প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে দেখেছি। তিনি ছিলেন জাতীয় অধ্যাপক ও জাতীর শিক্ষক। জাতিকে আজীবন জ্ঞান বিলিয়ে দিয়েছেন অকৃপনভাবে। মোহাম্মদ আজরফ ঢাকা সোহরাওয়ার্দি হাসপাতালে ১লা নভেম্বর ১৯৯৯ রাত ১১টায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। আদর্শ শিক্ষক, বরেন্য দার্শনিক, শিক্ষক, মানবতাবাদী, জাতীয় অধ্যাপক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ ছিলেন ত্রিকালদর্শী এক জীবন্ত কিংবদন্তী।

যে সূর্যের আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে তার তীক্ষè প্রভা, জ্যোতিতে বিশ্ব আলোকিত হয়, তাকে বাঁধা দেওয়ার এমন কোনো শক্তি নেই। তা এ আলোকে উদ্ভাসিত হয় এ আমার বিশ্বাস।
পরিশেষে তাঁর জীবনের সমাপনী টানতে গিয়ে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এর ‘বিদ্যার অভিশাপ’ কবিতার শেষের কয়েক ছত্র মনে পড়ে যায়–
কচ যখন দেবলোকে
প্রস্থানের সময় দেবযানীর প্রেম প্রত্যাখ্যান করে চলে যায়–
তখন দেবযানী অভিশাপ দেয়————–।
তোমাপরে
এই মোর অভিশাপ- যে বিদ্যার তরে মোরে করো অবহেলা, সে বিদ্যা তোমার সম্পূর্ণ হবে না বশ; তুমি শুধু তার ভারবাহী হয়ে রবে, করিবে না ভোগ ;
শিখাইবে , পারিবে না করিতে প্রয়োগ”।
তখন কচ উত্তরে বলে—
“কচ। আমি বর দিনু; দেবী, তুমি সুখী হবে
ভুলে যাবে সর্বগøানি বিপুল গৌরবে”।

এখানে জাতীয় অধ্যাপক বাংলাদেশের গর্ব দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার ভার শুধু বহনই করেননি, প্রয়োগও করেছেন। অনেক স্কুল-কলেজের প্রতিষ্টাতা- সার্থক শিক্ষাগুরু, নির্মান ও উন্নয়নে দক্ষতার সাথে কাজ করেছেন। প্রেম-প্রীতি, ভালোবাসায় থেকে নিজেকে উজার করে দিয়েছেন। আবার জাতিকে বর দিতে কার্পণ্যও করেননি। এখানে তাই শিক্ষক দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ মানুষের বিজয়কে সার্থকভাবে দেবলোকের কচের ওপরই প্রতিষ্টা করেছেন। আর তাঁর “ ‘বর’ শুধু তার পরিবার নয়, গোটা জাতিই পেয়েছে”।

(লেখক, গবেষক, প্রাবন্ধিক, প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ, নুরজাহান মেমোরিয়াল মহিলা ডিগ্রী কলেজ, সিলেট। পিএইচ ডি ফেলো, নিউইয়র্ক,)।
তথ্যসূত্র ঃ
১. সিলেট বিভাগের ইতিবৃত্ত : ড. মুমিনুল হক ( সেপ্টেম্বর, ২০০১)
২. সাপ্তাহিক ঠিকানা : যুক্তরাষ্ট্র (১১ জানুয়ারী, ২০১৯)
৩. তমদ্দুনের বিকাশ (তমদ্দুন মজলিশ) সিলেট-১৯৪৯।
৪. অতীত জীবনের স্মৃতি : দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ
৫. সাপ্তাহিক ঠিকানা : যুক্তরাষ্ট্র ১৪ জুন, ২০১৯।
৬. ইসলামী বিশ্বকোষ ২য় খন্ড : ইসলামিক ফাউন্ডেশন, বাংলাদেশ।
৭. নতুন সূর্য (গল্প সংকলন, পূর্বাঞ্চল প্রকাশনী ও বাংলাদেশ কো-অপারেটিভ বুক সোসাইটি লি. ১৯৫৯-১৯৯৭)।
৮. সত্যের সৈনিক আবুজর গিফারী (তমদ্দুন মজলিশ, ঢাকা
৯. সিলেট বিভাগের পরিচিতি : সৈয়দ মোস্তফা কামাল, সেপ্টেম্বর ২০০৪।
১০. মরহুম দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ : একুশে বইমেলা ২০০০ স্মারক গ্রন্থ, ২১ ফেব্রুয়ারী ২০০০, সম্পাদনায় শামীম আহমদ চৌধূরী।
১১. সিলেট : নিবাস বাংলাদেশ : শামসাদ হুসাম, জানুয়ারী ২০১৭।
১২. সাপ্তাহিক দেশ, যুক্তরাষ্ট্র : ১১ আগষ্ট ২০২১।
১৩. সাপ্তাহিক ঠিকানা : ১১ জানুয়ারী ২০১৮।
১৪. সাপ্তাহিক ঠিকানা : ১৪ জুন ২০১৯।
১৫. সাপ্তাহিক দেশ : ১লা সেপ্টেম্বর ২০২১।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।