চীনের মতো বাংলাদেশে কর্মমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে
০১ ফেব্রু ২০২৩, ০২:০৫ অপরাহ্ণ

মাহফুজ আদনান : চীন অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য প্রায় ১২ বছর তাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কার্যক্রম বন্ধ রেখেছিলো। চীন সরকারের বক্তব্য ছিল, এত হাজার হাজার বেকারকে চাকরী দেয়ার মত প্রতিষ্ঠান চীনে নেই। এই সময়টায় চীন ছাত্রছাত্রীদের আধুনিক প্রশিক্ষন দিয়েছিল নানা ধরণের ট্রেড কোর্সে। স্বল্প মেয়াদী ট্রেড কোর্স শিখে চীনের ছেলেমেয়েরা স্বাবলম্বী হয়ে গেলো। প্রতিটি বাড়ি গড়ে উঠল একটা করে ছোট ছোট কারখানায়। পরিবারের সবাই সেখানে কাজ করে। বড় কারখানা করার আলাদা খরচ নেই। ফলে পণ্যের উৎপাদন খরচ কমে গেলো। বর্তমানে যে কোন পণ্য স্বস্তায় উৎপাদন করার সক্ষমতায় তাদের ধারে কাছে কেউ নেই।
পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলে চাইনিজ পণ্যের প্রসার বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে তারা বিশ্ব বাণিজ্যের এক অপ্রতিরোধ্য পরাশক্তি। উপযুক্ত মুল্য দিলে তারা এমন জিনিস বানিয়ে দেবে যার গ্যারান্টি আপনি চাইলে ১০০ বছরও দিতে পারবেন।
বাংলাদেশে সিমফোনি, ওয়ালটনসহ বহু প্রতিষ্ঠান এই চায়নার বদৌলতেই কিছু করে খাচ্ছে। অপর দিকে বাংলাদেশে প্রতিনিয়ত গড়ে উঠছে বেকার বানানোর কারখানা। এর আধুনিক নাম বিশ্ববিদ্যালয়। প্রতি বছরই দুই একটা নতুন বিশ্ববিদ্যালয় তৈরী হচ্ছে আর বের হচ্ছে কয়েক হাজার বেকার। দল বেঁধে পড়ানো হচ্ছে বিবিএ, এমবিএ অথবা চিরচরিত সেই ডাক্তারি অথবা ইঞ্জিনিয়ানিং। এত বেকারের ভীড়ে চাকরী বাংলাদেশে একটি সোনার হরিণ। কোম্পানীরাও এটা বুঝে। ফলে এই দেশের শিক্ষিত ছেলেরা প্রত্যাশা অনুযায়ী অবশ্য, দীর্ঘদিন বিভিন্ন জাতির শোষণের যাতাকলে পিষ্ট হয়ে আমাদের জাতির জীবনে প্রবেশ করেছে ভৃত্যগিরির মানসিকতা। আমরা মনে করি স্যুট, টাই পড়ে কোন কাজ করতে পারলেই বুঝি সেখানেই জাতির সফলতা। এটা আসলে একটি অপ্রকাশ্য দৈন্যতা, যা কেউ স্বীকার করছেন না। এই দেশের অর্থনীতির জন্য সামনে খুব ভয়াবহ দিন অপেক্ষা করছে। তাই, বাংলাদেশের উচিত চীনের মত একটা পদক্ষেপ নেয়া। চাকরী করে দেশের উন্নতি হয় না, আমাদের উদ্যোক্তা প্রয়োজন। তাই শিক্ষা ব্যবস্থার আমুল পরিবর্তন প্রয়োজন, গুরুত্ব দেয়া উচিত কর্মমুখী শিক্ষায়।
আজকের তরুণরাই আগামী দিনে দেশ পরিচালনায় নেতৃত্ব দেবে। তরণদের দক্ষ করে গড়ে তোলা গেলে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আরও সুন্দর হবে। দেশের লাখ লাখ শিক্ষিত বেকার তরুণ যুবসমাজকে দেশের উন্নয়নে কাজে লাগানো প্রয়োজন। বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশই তরুণ। এ দেশের কর্মসংস্থানেও তারুণ্যের ভূমিকা রয়েছে অসামান্য। বাংলাদেশে শিক্ষিত বেকারের হার সবচেয়ে বেশি। প্রতি ১০০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার।
শিক্ষিতদের বড় একটা অংশ যদি উন্নয়ন প্রক্রিয়ার বাইরে থাকে, তাহলে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিক্ষা বলতে আমরা বুঝি, কোনো বিষয় জানা এবং বোঝা। আসলে মানুষ জন্মের পর থেকেই চারপাশের পরিবেশ থেকে নানান কিছু শিখতে থাকে।
এ জন্যই কবি বলেছেন, ‘বিশ্বজোড়া পাঠশালা মোর সবার আমি ছাত্র’। তবে যাই হোক না কেন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাকেই আমরা শিক্ষা হিসেবে বুঝি। শিক্ষাই মানুষকে তার মনুষ্যত্ব অর্জনে সাহায্য করে। তাই বলা হয় শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞানের আলো দান করে ও কুসংস্কার দূর করে। মানুষে মানুষে সম্প্রীতি বাড়ায় এবং সংস্কৃতি ও সভ্যতাকে করে সমৃদ্ধ। তাই শিক্ষা জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত শিক্ষাই কর্মমুখী শিক্ষা। শুধু কর্মসংস্থান নয়, উন্নয়নের জন্যও প্রয়োজন কর্মমুখী শিক্ষা। যে শিক্ষাব্যবস্থায় মানুষ কোনো একটা বিষয়ে হাতে-কলমে শিক্ষালাভ করে জীবিকা অর্জনের যোগ্যতা অর্জন করে, তা-ই কর্মমুখী শিক্ষা।
সাধারণ শিক্ষার অনিশ্চয়তার পরিপ্রেক্ষিতে বৃত্তিমূলক শিক্ষার গুরুত্ব বেড়েছে। আধুনিক বিশ্বে বেঁচে থাকার জন্য নানা কলাকৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে। অথচ ব্যবসা-বাণিজ্য, জীবনযাত্রায় আমরা ক্রমেই পিছিয়ে পড়ছি। বর্তমান বিশ্বে যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত, সে জাতি তত উন্নত। শিক্ষা মানুষকে জ্ঞান দিয়ে সম্প্রীতি বাড়ায়, কুসংস্কার দূর করে সমাজকে আলোকিত করে। অধুনা শিক্ষাকে দুটো শ্রেণিতে ভাগ করা হচ্ছে। এক সাধারণ শিক্ষা ও দ্বিতীয়ত বৃত্তিমূলক বা কারিগরি শিক্ষা।
বর্তমানে সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কর্মমুখী শিক্ষার অগ্রযাত্রার ফলেই পৃথিবী দ্রুত উন্নতির দিকে এগিয়ে চলছে। তাই কর্মমুখী শিক্ষা উন্নতি ও উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য।
শিক্ষা মানুষকে সমৃদ্ধ করে। শিক্ষার সঙ্গে রাষ্ট্রের উন্নয়ন ও অগ্রগতি নির্ভরশীল। কিন্তু দেশে শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা হলেও শিক্ষাকে পরিকল্পিত গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে মানুষের উপযোগী করে তোলা যায় সে বিষয়টি তেমনভাবে ভাবা হয়নি। যদি সেরকম গবেষণা হতো তবে মানবসম্পদ সৃষ্টিতে কোন ধরনের শিক্ষাব্যবস্থা আমাদের দেশের জন্য প্রয়োজন সেটি বের করা যেত। যখন আমরা মানবসম্পদের কথা বলি তখন জীবনসম্পৃক্ত শিক্ষাব্যবস্থার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
যখন শিক্ষাকে জীবনসম্পৃক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হবে, তখন কারিগরি শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। তবে কারিগরি শিক্ষায় প্রবেশের আগে জীবনাচরণগত শিক্ষার প্রয়োজন রয়েছে। দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে দক্ষ মানবসম্পদের কোনো বিকল্প নেই। শিক্ষাই দক্ষ মানবসম্পদ সৃষ্টির অন্যতম হাতিয়ার। তাই শিক্ষার মূল ভিত্তিই হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা।
দেশের জাতীয় উন্নয়ন প্রক্রিয়ায় কার্যকরী ভূমিকা পালন করার জন্য প্রয়োজন একটি শিক্ষিত জাতি। আর প্রাথমিক শিক্ষা হচ্ছে দেশের সব মানুষকে ন্যূনতম শিক্ষায় শিক্ষিত করার প্রথম সোপান। তাই জাতীয় অগ্রগতি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। ফলে দেশের বিপুল সংখ্যক জনগোষ্ঠীকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরিত করে উন্নয়নের মূল স্রোতধারায় সম্পৃক্ত করতে শিক্ষাই একমাত্র মাধ্যম। প্রাথমিক শিক্ষা শিক্ষিত জাতি গঠনের মূল ভিত্তি। মানুষকে উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে বিবেচনায় আনলে উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নে মানবসম্পদের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন, সঠিক সংগঠন গড়ে তোলা এবং যথাযথ প্রযুক্তি নির্দিষ্টকরণ ও প্রয়োগের জন্য দক্ষ, যোগ্য, দেশপ্রেমিক, নিষ্ঠাবান, সৎ ও উৎপাদনশীল মানবসম্পদের প্রয়োজন।
আর দেশের জনসম্পদকে মানবসম্পদে রূপান্তর করাতে হলে শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। কারণ শিক্ষা মানবসম্পদ উন্নয়নে বিভিন্নভাবে অবদান রাখে। মানবসম্পদ হচ্ছে মানুষের শক্তি, দক্ষতা, মেধা ও জ্ঞান যা পণ্য উৎপাদন ও সেবার ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়। সমাজের সব মানুষের জ্ঞান, দক্ষতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়াই হচ্ছে মানবসম্পদ উন্নয়ন। মানবসম্পদ উন্নয়ন হচ্ছে প্রয়োজনীয় সব উপায়ের মাধ্যমে মানুষের উন্নয়ন। মানবসম্পদ উন্নয়নের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হলো মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকার জন্য তার মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণের পাশাপাশি তার সহজাত ও সুপ্ত ক্ষমতা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ ও সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়া।
লেখক : প্রধান নির্বাহী, বাংলানিউজইউএসডটকম ।