পরিবার ও প্রাথমিক বিদ্যালয়েও স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার থাকা প্রয়োজন মহিউদ্দিন শিহাব - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ৩:৩৯, ১৭ই জানুয়ারি, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

পরিবার ও প্রাথমিক বিদ্যালয়েও স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার থাকা প্রয়োজন মহিউদ্দিন শিহাব

newsup
প্রকাশিত জুন ১২, ২০২৩
পরিবার ও প্রাথমিক বিদ্যালয়েও স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার থাকা প্রয়োজন মহিউদ্দিন শিহাব

বই জীবনের একটি প্রধান অনুষঙ্গ। সমাজ ও সভ্যতা বিকশিত হয়েছে বইয়ের হাত ধরে। মানুষের অনবদ্য সৃষ্টিগুলো মলাটবন্দি হয়ে বইতে রূপ পায়। মানুষ একদিন নশ্বর পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেও তার সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য ও অবদানগুলো বইতে লিপিবদ্ধ হয়ে যুগ যুগ ধরে মানুষের কল্যাণে তা ব্যবহৃত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানসহ বহুমুখী ক্ষেত্রে বইয়ের ব্যবহার হচ্ছে প্রধান নিয়ামক শক্তি। শিক্ষার মানে তো বই আর বই মানেই তো শিক্ষা। বইয়ের কদর শিক্ষিতজনের কাছে সবসময় এক ভালোবাসার বিষয়। এই বইগুলো যেখানে সুনিয়ন্ত্রিতভাবে রাখা হয় সেটাকে আমরা লাইব্রেরি বা গ্রন্থাগার বলে থাকি। এই গ্রন্থাগার যেন পরম শান্তির এক জায়গা। যেখানে ঢুকলেই বইয়ের সংস্পর্শে মন যেন এক অনাবিল প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। এ গ্রন্থাগারের প্রয়োজনীয়তা সর্বজনবিদিত। প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যক্তি পর্যায়ে গ্রন্থাগার তৈরি করে মানুষকে মননশীল ও সৃষ্টিশীল করে তোলার যে কার্যক্রম তা শুধু নিজের আত্মতৃপ্তির জন্যই নয় বরং তা বৃহত্তর সমাজের অবশ্যই কল্যাণকর। এই গ্রন্থাগার সরকারি ও বেসরকারি নানা পর্যায়ে তৈরি ও পরিচালিত হয়। যেভাবেই তৈরি ও পরিচালিত হউক না কেন গ্রন্থাগার তৈরির যে ভাবনা তা সবসময়ের জন্যই ইতিবাচক। একজন পাঠকের বহুমুখী রুচিবোধ থাকতে পারে। তার পাঠাভ্যাসের এই বহুমুখী রুচিবোধ নিরসনের জন্যই প্রয়োজন গ্রন্থাগার। এক ব্যক্তি যিনি বইপ্রেমী তিনি অবশ্যই তার প্রিয় বই সংগ্রহে রাখার চেষ্টা করেন এবং ব্যক্তি পর্যায়ে বাসায় কিংবা বাড়িতে ছোটখাটো গ্রন্থাগার করে বই সংগ্রহে রাখেন। কিন্তু বৃহত্তর পরিমণ্ডলে বহুমুখী জ্ঞান-বিজ্ঞান শিল্প, সাহিত্য, সংস্কৃতির বিষয়গুলো জানতে বৃহত্তর গ্রন্থাগারের সাহায্য নিতেই হতে পারে। তাই জনগণের মধ্যে পাঠাভ্যাস সৃষ্টি এবং পাঠাভ্যাস বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে গ্রন্থাগার স্থাপন। এ লক্ষ্যে সরকারি-বেসরকারি গ্রন্থাগারগুলোর কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করা প্রয়োজন। অনেক পরিবার আছে যে পরিবারগুলি গ্রন্থাগারমুখী। যে পরিবারে গ্রন্থাগার আছে, ঐ পরিবার এক ধরনের আলাদা দ্যুতি ছড়ায় সমাজে। তাদেরকে দেখে অনেকেই উৎসাহিত হয় এবং উদ্দীপনা লাভ করে। এই ভাবে সমাজ সচেতন প্রতিটি পরিবারেই যদি একটি পারিবারিক লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠা করা যায় তাহলে সমাজ মননশীলতা দিকে ধাবিত হতে পারে। শিশুদের বই পড়ার যে অভ্যাস তার পারিবারিকভাবেই বীজ রোপণ করতে হবে। শিশুদের বই পড়ার জন্য উৎসাহিত করতে পারিবারিক গ্রন্থাগার একটি বড় ভূমিকা রাখতে পারে। পরিবারের পরে শিশুদের স্থান হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুশ্রেণি, প্রথম এবং দ্বিতীয় শ্রেণি বাদ দিলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রছাত্রীরা শিশুতোষ নানা বই পাঠের অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য লাইব্রেরি ব্যবহার করার চর্চায় মনোনিবেশ করতে পারে। এজন্য প্রয়োজন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সরকারি বাধ্যতামূলক লাইব্রেরি রাখা সংক্রান্ত বিধি। কিন্তু সত্য যে, মাধ্যমিক, নিম্নমাধ্যমিক, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় নির্দিষ্ট সংখ্যায় বই রেখে লাইব্রেরি থাকার যে বাধ্যতামূলক বিধি চালু আছে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাধ্যতামূলক সে ধরনের বিধি নেই। পাঠদান ও একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদান নীতিমালা-২০২২ অনুযায়ী নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের লাইব্রেরির জন্য ১০০০টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয়, উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় ও কলেজ ও উচ্চমাধ্যমিক কলেজের লাইব্রেরির জন্য ২০০০টি বই রেখে স্বতন্ত্র লাইব্রেরি রাখা বাধ্যত্যমূলক। আর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিধি মোতাবেক কলেজের জন্য অবশ্যই একটি সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার থাকতে হবে। গ্রন্থাগারে প্রতিটি বিষয়ের পাঠ্যসূচি অনুযায়ী অন্তত ৩০০০টি বই থাকতে হবে। এ বিধিতে নির্দিষ্ট পাঠ্যপুস্তক ছাড়াও প্রয়োজনীয় রেফারেন্স বই রাখার কথাও বলা হয়েছে। কলেজ সম্মান পর্যায়ের হলে প্রতিটি বিষয়ের একটি লাইব্রেরিতে সংশ্লিষ্ট বই ও রেফারেন্স বইয়ের সংখ্যা কমপক্ষে ২০০০টি হতে হবে। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এ রকম কোনো বিধি নেই। অথচ প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে সরকার অবকাঠামো, স্বাস্থ্য, স্যানিটেশন, আসবাবপত্র ক্রয় ছাড়াও ক্ষুদ্র পরিসরে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে স্লিপ ফান্ড, ক্ষুদ্র মেরামতসহ নানা খাতে প্রতিবছর প্রচুর টাকা ব্যয় করে। কিন্তু এখানে শিশুদের উপযোগী বই ক্রয় করে একটি শিশুদের পাঠাগার তৈরির বাধ্যতামূলক কোনো উদ্যোগ নেই। কিছু কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নিতান্তই ব্যক্তিগত পর্যায়ে এ রকম উদ্যোগ দেখা যায়। এখানে পাঠসূচির বইগুলো রেখে শিশুর মানস গঠনের নানা ধরনের বই, শিশুসাহিত্যের নানা ধরনের বই রাখা যেতে পারে। বতর্মানে সরকারি উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু কর্নার চালু হয়েছে সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, সেখানে প্রাথমিক শিক্ষাও আছে। এখানে বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত কিছু বই রাখা হচ্ছে। কিন্তু শিশুর মননশীলতা বিকাশে এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি প্রাথমিক শিশু উপযোগী প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুতোষ বই সমৃদ্ধ একটি ছোট গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এক্ষেত্রে নির্দিষ্ট বইয়ের সংখ্যা দিয়ে একটি বিধিমালা জারি করা যেতে পারে। যেভাবে নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও অনার্স কলেজে বইয়ের সংখ্যা নির্ধারণ করে স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠার বিধি জারি আছে। প্রাথমিক বিদ্যালয় সময়ে সময়ে পরিদর্শন করেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। তাঁরা এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা, শিক্ষার্থী ও শিক্ষকেরা তা ব্যবহার করেন কিনা তার দেখভাল করতে পারেন। আমাদের শিশুসাহিত্য অত্যন্ত সমৃদ্ধ। দেশের বড় বড় কবি সাহিত্যিক সকলেই শিশুদের বিষয়ে সাহিত্য রচনা করেছেন। বড় হয়ে যে শিশুরা রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জসীম উদ্দীন, সত্যজিৎ রায় কিংবা অন্য বড় কবি সাহিত্যিকদের লেখালেখির সাথে পরিচিতি হচ্ছে, তারা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের গ্রন্থাগারের মাধ্যমে তাঁদের শিশুতোষ লেখনীর সাথে পরিচিত হতে পারে। এছাড়া দেশে অনেক বরেণ্য শিশুসাহিত্যিক আছেন যাঁদের বইয়ে সমৃদ্ধ হতে পারে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুতোষ পাঠাগার। এ ব্যাপারে প্রাথমিক র্পযায়ে কোনো শিক্ষককে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে এবং পরবর্তী পর্যায়ে ধীরে ধীরে একজন সহকারী লাইব্রেরিয়ানও নিয়োগ দেয়া যায়। যেভাবে মাধ্যমিক স্কুল এবং কলেজের লাইব্রেরিগুলো পরিচালিত হয় তার কিছুটা প্রয়োগ প্রাথমিক স্তর থেকে শুরু করা যায়। পাঠাভ্যাস সৃষ্টির জন্য এগুলো শিক্ষার সাথে অবশ্যই গঠনমূলক কতগুলো কাজ এবং এই কাজগুলো মোটেও অপচয় নয়। ইদানিং প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পিওন, নৈশ প্রহরী ও শিশু শ্রেণির জন্য আলাদা শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে-যেগুলো আগে ছিলো না। তাই ক্ষুদ্র পরিসরে হলেও প্রতিটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্বতন্ত্র গ্রন্থাগার চালু করা উচিত। মাধ্যমিক স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে যে লাইব্রেরি আছে সেখানে বই পড়া এবং তা সচল রাখার ওপরও গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষার্থীদের যদি আমরা সৃষ্টিশীল জ্ঞানের রাজ্যে বিচরণ করাতে সক্ষম হই তাহলে তাদের আত্মা পরিশুদ্ধ হবে, মনের দিগন্ত উদ্ভাসিত হবে। এ কারণে ইভটিজিং, মাদকাসক্তের মত সমাজ বিরোধী কার্যকলাপে তারা জড়িত হবে না। এই গ্রন্থাগারের মাধ্যমে দেশ বিদেশের বিভিন্ন লেখক ও মহামানবদের সাথে পরিচিত হয়ে নিজেদের মানস গঠন চর্চায় নিজেকে নিবেদিত করতে পারে। গ্রন্থাগারের যে শ্রেণি তাতে দেখা যায় জাতীয় গ্রন্থাগার, গণগ্রন্থাগার, একাডেমিক গ্রন্থাগার, বিশেষ গ্রন্থাগার, ভ্রাম্যমাণ গ্রন্থাগার, সামাজিক গ্রন্থাগার নামের নানা গ্রন্থাগার রয়েছে। বাংলাদেশের গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের এক তথ্য অনুযায়ী জানা যায় দেশে জেলা, উপজেলা পর্যায়ে এখন মোট গণগ্রন্থাগারের সংখ্যা ৭১টি। বাংলাদেশের জাতীয় গ্রন্থাগারে বই রয়েছে প্রায় ৫ লাখের মত। সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারের বইয়ের সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ৯ হাজার। ৫৮ জেলায় মোট বইয়ের সংখ্যা প্রায় ১৭ লাখ ৩৭ হাজার। এক পরিসংখ্যানে জানা যায়, সুফিয়া কামাল জাতীয় গণগ্রন্থাগারে নাকি প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ হাজার ৩৬০ জন পাঠক আসেন। জেলা গ্রন্থাগারগুলো দৈনিক ব্যবহার করছেন গড়ে প্রায় ২ লাখ ৭৬ হাজার পাঠক। বাংলাদেশে গ্রন্থাগার ব্যবহার করতে সক্ষম এ রকম শিক্ষিত জনসংখ্যার অনুপাতে গ্রন্থাগারের সংখ্যা, বইয়ের সংখ্যা এবং পাঠকের সংখ্যা নিতান্তই সামান্য। এ পরিসংখ্যার হার বাড়াতে হলে ব্যক্তি, পরিবার ও প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা থেকেই তার গোড়াপত্তন করতে হবে। এখানে একাডেমিক যে গ্রন্থাগারের কথা বলা হয়েছে সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তার প্রসারতা বাড়াতে হবে। সমৃদ্ধ জাতি গঠনে গ্রন্থাগারের যে প্রয়োজন তার গুরুত্ব সবাইকে উপলব্ধি করতে হবে। জ্ঞান-বিজ্ঞানকে মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়া এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে গ্রন্থাগার শুধু অপরিহার্য নয় বরং মানসম্মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একটি মাপকাঠি হচ্ছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার। প্রাবন্ধিক মোতাহের হোসেন চৌধুরী তাঁর ‘লাইব্রেরি’ নামক প্রবন্ধে বলেছেন ‘লাইব্রেরি জাতির সভ্যতা ও উন্নতির মানদণ্ড। কারণ বুদ্ধির জাগরণ-ভিন্ন জাতীয় আন্দোলন হুজুগপ্রিয়তা ও ভাববিলাসিতার নামান্তর, আর পুস্তক অধ্যয়ন ব্যতীত বুদ্ধির জাগরণ অসম্ভব।’ বুদ্ধিভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণের জন্য, শিশুকাল থেকেই শুদ্ধ মননশীল চর্চার জন্য লাইব্রেরির কার্যক্রম ও ব্যবহার পরিবার এবং প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করতে হবে।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।