মীর লিয়াকত :
ভেজালের বেড়াজালে
একটা জোক দিয়ে শুরু করতে চাই আজকের প্রসঙ্গ। একবার জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পথ চলছে দুই কিশোর এবং একজন বৃদ্ধলোক। জঙ্গলের মাঝ বরাবর আসার পর তারা তিনজনই দেখতে পেল একটা প্রকাÐ গন্ডার অচেতনের মতো ঘুমাচ্ছে। হঠাৎ কিশোর দুটি ছুটে গিয়ে গন্ডারটিকে কাতুকুতু দিয়ে উঠাতে চেষ্টা করল। বৃদ্ধ নানা বলরেনন গনডারটি জেগে গেলে তোমাদেরকে মেরে ফেলবে। চলো আমরা চলে যাই। নানার কথা শুনে দুই নাতি চলে গেলো তাদের গন্তব্যে। ফেরা পথে আবার ঐ একই গাছের তলায় তারা এসে দেখতে পেল গন্ডারটি সেভাবেই আছে কিন্তু তাদের দিকে চেয়ে চেয়ে গন্ডারটি অবরাম হেসে চলেছে। নাতি দুটি নানাকে বলল ‘নানা, কি ব্যাপার গন্ডারটি এমন করে হাসছে কেন?’ নানা ভারিকিক চালে বললেন, তোমাদের মনে নেই তিনদিন আগে এই পথে যাবার সময় তোমরা গন্ডারটিকে কাতুকুতু দিয়েছিলে? নাতিরা বলল কিন্তু সেতো তিন আগে। নানা সবজান্তার হাসিহেসে বললেন, গন্ডারের চামড়া খুব মোটা। তাই তিনদিন আগের কাতুকুতু এখন এ্যাকশন করেছে। তাই হাসছে এখন গন্ডারটি।
আসলে কথা তো ঠিকই। গন্ডারের চামড়া তো খুবই শক্ত। হয়তো এমন হতেই পারে। আমাদের চামড়া গন্ডারের মতো হয়ে গেছে। সবকিছুই যেন আজকাল আমাদের সয়ে যায়। এই যে সারা দেশ জুড়ে পণ্যে খাদ্যে বেমালুম ভেজাল দিয়ে পুরো জাতির সর্বনাশ করা হচ্ছে তা কিভাবে সয়ে যাচ্ছি আমরা?
আমরা তো কিছুই না করতে পারছিও না। মানুষে জীবন নষ্ট কারী এসব ভেজাল খাদ্যে মেশানো কি পাপ নয়? এই যে দেশজুড়ে কার্বাইড দিয়ে পাকিয়ে নেওয়া হচ্ছে কলা, গুঁড়ো মশলায় দেওয়া হচ্ছে ইটের গুঁড়ো কিংবা কাঠের গুঁড়ো তারপর বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে হচ্ছে ওজন, চাপাতায় ওজন বাড়ানোর জন্য দেওয়া হচ্ছে নিদ্বির্ধায় শুকনো গোবর গুঁড়ো, নি¤œমানের চাল ছেটে সরু বানিয়ে উন্নতমানের সীলগালা করে দ্বিগুণ দাম নেওয়া হচ্ছে, নামী দামী ব্রান্ডের দুধে আছে মেলামাইন, সেলাইন, ইঞ্জেকশন এমনকি জীবনরক্ষাকারী ওষুধেও মিশ্রিত হচ্ছে ভেজাল। আমরা প্রতিদিন এসব দেখছি অথচ কেউ কিছু বলছি না। কে কাকে বলতে বললে কেউ শুনবে না শুনলেও কারে কিছু করার, নেই থাকবে না। আমাদের কাজ অনেক। অনেক কাজ ফেলে তো এসব ‘অপ্রয়োজনীয়’ কাজ করার মতো সময় আমাদের হাতে নেই। এই যে, শারীরিকভাবে এক অকেজো প্রজন্মের জাতি আমরা তৈরি করে দিচ্ছি কে নেবে এর দায়িত্ব? অভিষ্যতের গড়ে ওঠা এ অসুস্থ পঙ্গু জাতি কি করতে পারবে দেশের জন্য?
চারদিকে জিঘাংসার জাল ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। স্বার্থ মগ্নতার উর্ধ্বে এদেশে শুভবুদ্ধির উদয় হবে কবে? নিস্বার্থভাবে কেউ কোনো কাজে এগিয়ে আসতে চায় না। চাইলেও দেখা যায় সেই চাওয়ার নেপথ্যে রয়েছে দীর্ঘ মেয়াদী কুটকৌশল। কেউ আর ভালো দেখতে চায় না। এমন অবস্থা তো বাঙালি জাতির হবার কথা নয়। বাঙালি একটি গর্বিত জাতি। সংগ্রাম করে করে সশস্ত্র যুদ্ধ করে তারা স্বাধীনতার লাল স্বাধীনতার লাল সূর্য ছিনিযে আনতে সক্ষম হয়েছে। রক্ত দিয়েছে, ইজ্জত দিয়েছে-দিয়েছে নিজের জীবন দেশটা তো এখন নিজেদের। তাহলে আমাদের এতেসব মরণ ভাবনা কেন। বিষয়টি সিত্যই দুর্দমনীয় কিছু? হাঁ করে সরকারের দিকে তাকিয়ে থাকার কোনো প্রয়োজন আছে কি?
প্রতি গ্রামে প্রতি মহল্লাায় যদি সামাজিকভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলা যায় তাহলে কি সম্ভব এ ধরনের পণ্যে খাদ্যে ভেজাল মেশানো? সরকার কি আর রোকনদ্দৌলা নেই? সরকার শুধু প্রয়োজনে সহয়তা দেবে বাকি কাজে এগিয়ে নিতে হবে স্থানীয় সর্বস্তরের মানুষকে। আমি যদি আমার এলাকাকে ভেজালমুক্ত করতে পারি তাহলে এভাবে সকল এলাকাই বেজলামুক্ত হতে পারে। সহজ সরল অংক।
পলিটিক্যাল লিডারদের এ ব্যাপারে সোচ্চার হবার কথা। এটা হতে পারতো সর্বদলীয় পলিটিক্স এর একটা সুবিশাল ইস্যু এই যে দু’বছর কেয়ার টেকার নামক সরকার ক্ষমতায় আছেন, ছাগল, শেয়াল থেকে শুরু করে কুমীর, বাঘ, সিংহ সবাইকে ধরে ধরে জেলের ভাত খাইয়েছে এই সরকার। তাদের বিচার হচ্ছে। দল বেঁধে জেলে আবার দল বেঁধে মুক্ত। দুর্নীতির জন্য এতো বিশাল একটা কাজ করতেও সরকার টলেনি। কিন্তু এই যে মানুষ ভেজাল খেয়ে জাতির স্বাস্থ্যের বারোটা বাজাচ্ছে তার কি হবে? সরকার থাকলেন দুই বছর না হয় ১৮ জিসেম্বরের নির্বাচন ১ মাসের জন্য পিছিয়ে এই ১ মাসে ভেজালের বারোটা বাজানোর কাজটি করতেন? কি-ই বা হতো একমাসে? শীর্ষ ভেজালকারীদের ধরে শীর্ষ শাস্তির ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে পারলে কী কোনো দুঃখ থাকতো দেশবাসীর মনে? মানুষ কি শান্তি পেত না?
এখন দেশের সাংবাদিকতা এগিয়ে গেছে অনেক দূর। শুধু রাজনীতিক আর সরকারই নয় কিছু মিডিয়ার ক্যামেরার স্তুপ মুহূর্তে ছুটে যায় ক‚টনীতিকদের বক্তব্যের জন্য। দেশের ১০টি টিভি চ্যালেন প্রতিনিয়ত রয়েছে ব্যস্ত। শুধু ক‚টনীতিকদের অকারণে প্রতিদিন স্ক্রীনে আনা ছাড়া সব কাজই তাদের দেশের সেবায়। টক-শো তে বুদ্ধিজীবীরা কথা বলেই চলছেন। কিন্তু পণ্যে খাদ্যে ভেজাল মিশিয়ে জনস্বাস্থ্য ধ্বংস বন্ধ করার জন্যতো তেমন আন্তরিকতা চোখে পড়ে না। আমার তো মনে হয় এ মুহূর্তে যদি শুধুমাত্র সাংবাদিকরা মাত্র কয়েক মাসের একটা এ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে দেশময় ভেজাল বিরোধী বিশেষ ভ‚মিকা নিতে পারতেন তাহলে এসব শেকড়সহ উৎপাটনই সম্ভব হতো।
কুটনীতিক, রাজনীতিক, সরকার ইত্যাদি ফ্লাশিং না কিছু দিনের জন্য বন্ধ করা যেতো। এতে তেমন তো ক্ষতি হতো না। কারণ এখনও তো আমরা তিমিরে আছি সে তিমিরেই রয়ে গেছি। এমনও তো হতে পারে যে অবস্থায় ওয়ান ইলেভেনের আগে ছিলাম দেশ আবার সে অবস্থা ফিরে গেছে- যদিও আমরা চাই না এমন হোক। যাই হোক ভেজালের সর্বনাশটা হচ্ছে করলেই তো আমরা এ দীর্ঘসময়ের মধ্যে করে নিতে পারতাম। কিন্তু আমরা করিনি। সব ব্যাপারেই আমরা নাক গলিয়েছি ফায়দা পাইনি কোথাও। জিনিসপত্রের দাম কমাতে চেয়েছি পারিনি। রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা আনতে চেয়েছি পারিনি। দুর্নীতিবাজদের জেলে রাখতে চেয়েছি-পারিনি। দুইনেত্রীকে এক টেবিলে বসাতে চেয়েছি-পারিনি। সবশেষ ভেজাল বন্ধ করার ছিটো ফোঁটা উদ্যোগ নিয়েছি-তাতে কোনো কাজ হয়নি। এখন দেখতে হবে আমরা আসলে কি চাই। আসলে আমরা আন্তরিকভাবে কিছুই চাই না। যা চাই তা কিছুদিন পর চাইতে ভালো লাগে না। নতুন কিছু চাই। নতুন কিছু চাইলে চাইলে পরে আবার তা ভুলে যাই। সবকিছুই আমরা অতি সহজে ভুলে যাই। আমরা কি এসব করে ভালো করছি?
ধরা যাক আজই সরকার ভেজালবিরোধী অভিযান সপ্তাহ ঘোষণা করে গ্রামে মহল্লায় সামজিক প্রতিরোধকারীদের সাথে নিয়ে এ্যাকশনে নামলো। যিনি ধরা পড়লো সরাসরি দীর্ঘ মেয়াদের শস্তি। ইনফ্রারেড ও নিযার ইফ্রারেড (আইআরএনআইআর) এবং স্পেক্ট্রোস্কোাপি যন্ত্রের মাধ্যমে পরীক্ষা করে দুধের মান নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা করলেন। এ রকম বাস্তবসম্মত কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে কি টনক নড়বে না ভেজালকারীদের? ১৮ ডিসেম্বর নির্বাচন হলে ধরা যাক নতুন রাজনৈতিক সরকার গদিতে বসলেন। তিনি কি করবেন। তিনি আর যাই করেন গদিতে বসেই কন্তিু এ রকম বোকামী করে বলবেন না যে, ‘সবকিছু একদিকে রেখে সবাই ভেজালবিরোধী ভ‚মিকা নিন।
কারণ ক্ষমতা গেলে তাদের বহুতর জরুরী কাজ থাকবে। সেগুলো সম্পাদন না করে অন্য কাজের আশা করা যায় কি? আমার এক জুনিয়র লেখক বন্ধু কথাশিল্পী ও সাংবাদিক আকমল হোসেন নিপু বছর কয়েক আগে আমার একটি বই এর প্রকশনা উৎসবে বক্তৃতায় বলেছিলেন আজকাল আর ‘মফস্বল^’ বলে কিছু নেই্ লেখালেখির ক্ষেত্রে ঢাকায় বসে যা করা যায় মফস্বলেও সেরকম সুযোগ সুবিধা রয়েছে। বন্ধুর মন্তব্য সঠিক নয় তা বলছি না, তবে মফস্বলে সাংবাদিকদের নিরাপত্তা বলতে কিছু নেই। মফস্বল এলাকায় প্রতিহিংসা প্রতিশোধ বহুলাংশে সহজ। নইলে শামসুর রহমানদের প্রাণ দিতে হতো না। এদেশ এখন ভেজালে অভয়ারণ্য। এ মুহূর্তে প্রয়োজন সাংবাদিকদের তৎপরতা। চাওয়া মাত্র নিরাপত্তা পেলে এক্ষেত্রে সাংবাদিকদের কোনো জুড়ি আছে বলে মনে হয়না।
উন্নত বিশ্বে একজন অনুসন্ধানী সাংবাদিক স্পটে গিয়ে সাধারণ বার্তা পাঠালেই আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সমূহের সহায়তা পায় সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিয়ে। বাংলাদেশে এ রকম নজির আছে কি? কতো সাংবাদিককে নির্মমভাবে প্রাণ দিতে হয়েছে। কেউ কি সুবিচার পেয়েছেন? আমি বলছিনা রাজধানীতে সব সাংবাদিক নিরাপদ। তবে সমস্যা মফস্বলে বেশি। এদেশে রাজনীতি কি সাংবাদিকতা থেকে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ? যদি শীর্ষ একজন নেতা নিরাপত্তার সুযোগ পান তাহলে শীর্ষ একজন সাংবাদিক কেন পাবেনা না?
এ মুহূর্তে বাংলাদেশ ভেজালের স্বর্গ! এভাবে চলতে দেওয়া যেতে পারে না। গন্ডারের চামড়া শক্ত বলে সেই গল্পে কাতুকুতু দেওয়ার তিনদিন পর তো গন্ডার হেসেছিল। আমরা তো এতসব ভেজালের পরও কিছু করছি না, কিছু বলছিও না। সর্বংসহার মতো সহ্য করে চলেছি। কিন্তু এখনও কি আমাদের কাতুকুতু দেওয়ার ‘তিনদিন’ পার হয়নি? এখন তো আমাদের এ্যাকশন হওয়ার কথা, হেসে ওঠার কথা। একবার অন্ততঃ চেষ্টা করে দেখতে দোষ কি! দেশের নাগরিক হিসাবে আমাদের সবার দায়বদ্ধতার কথা তো আমরা ভুলে যেতে পারি না। নিজেদের না জাগালে সরকারই বা জাগবে কেন? নিজেরা জাগলে সরকারকে জাগতেই হয়।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।