নিউজ ডেস্ক: পত্রিকার প্রথম পাতার একটি বড় অংশজুড়ে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের ছবি। সেখানে লাল কালিতে লেখা, ‘তিনি আমাদের ভোট হারিয়েছেন।’ নভেম্বরের শুরুর দিকে মিশিগানের ডিয়ারবর্ন থেকে দুই ভাষায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকার মূল শিরোনাম ছিল এটি। আর এই পত্রিকার গ্রাহক সেখানকার আরবিভাষী মানুষ।
আগামী বছরই যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আর এই শিরোনাম বলে দেয়, আরব ও আমেরিকান মুসলিম ভোটাররা গাজা-ইসরায়েল যুদ্ধে বাইডেনের ভূমিকাকে কীভাবে নিচ্ছেন। তাঁদের ভোট এবার তাঁর বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনাই–বা কতটুকু।
এই যুদ্ধে ইসরায়েলের পক্ষে বাইডেন প্রশাসনের ‘অকুণ্ঠ’ সমর্থন আরব ও মার্কিন মুসলিমদের মধ্যে একধরনের হতাশা তৈরি করেছে। এই হতাশা ও তীব্র ক্ষোভ কমাতে বাইডেন ও তাঁর শীর্ষ সহযোগীরা নড়েচড়ে বসেছেন। যেমন আরব ও মুসলিম অধিকারকর্মীদের সঙ্গে গত অক্টোবরের শেষ দিকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও হোয়াইট হাউস বৈঠক করেছে। পাশাপাশি ইসলামবিদ্বেষ দূর করতে প্রথমবারের মতো জাতীয় কৌশল ঘোষণা নিয়ে ১ নভেম্বর বৈঠক করেছে হোয়াইট হাউস।
ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের বক্তব্যেও পরিবর্তন এসেছে। এখন তারা গাজায় বেসামরিক নাগরিকদের সুরক্ষার ওপর জোর দেওয়ার পাশাপাশি সেখানে সাহায্য পাঠানোর সুযোগ চাইছে। ইসরায়েলের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে হামলার মধ্যে ‘মানবিক বিরতি’র। দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের ওপর জোর দিচ্ছে। বাইডেন এখন বলছেন, ইসরায়েলের গাজা দখল হবে বড় ভুল।
কিন্তু ফিলিস্তিনি অধিকারকর্মীদের ভাষ্য, বাইডেন প্রশাসনের এ আহ্বান তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে না। আমেরিকান আরব অ্যান্টি-ডিসক্রিমিনেশন কমিটির (এডিসি) নির্বাহী পরিচালক আবেদ আইয়ুব বলেন, ‘তারা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল যুদ্ধ নিয়ে যে ভূমিকা রেখেছে, সেটা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ জন্যই আমরা তাদের ইসলামবিদ্বেষ ঠেকানোর নামে নতুন কৌশলের ফাঁদে পা দিচ্ছি না।’
আবেদ আরও বলেন, ‘আমরা সেসব কাটিয়ে এসেছি। ফলাফল কী, তা দেখতে চাই। এই প্রশাসন কিছু করেছে, তা আমাদের দেখাক এবং আমাদের আস্তাকুঁড়ে ফেলে দেয়নি, সেই প্রমাণ দিক। তারা কী বৈঠক করেছে, তা নিয়ে আমাদের মাথাব্যথা নেই। সত্যিই নেই। এসব বৈঠক থেকে কিছুই বেরিয়ে আসবে না।’
গোপন বৈঠক
আরব আমেরিকান ইনস্টিটিউট গত মাসে আরব আমেরিকান কমিউনিটিতে একটি জরিপ চালায়। এতে দেখা যায়, বাইডেনের সমর্থনে ব্যাপক ধস নেমেছে। তাঁদের মাত্র ১৭ শতাংশ মানুষ চান, বাইডেনের আবার ক্ষমতায় ফিরে আসুক। অথচ ২০২০ সালে এই হার ছিল ৫৯ শতাংশ।
একইভাবে এনবিসি নিউজের এক জরিপে দেখা যায়, দোদুল্যমান রাজ্য মিশিগানে মাত্র ১৬ শতাংশ আরব ও মুসলমান বাইডেনের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করেছেন। তা–ও এই পরিমাণ মানুষ ভোট দেবেন যদি আজ নির্বাচন হয়।
বিশ্লেষকেরা বলেন, এই সমর্থনে ভাটা পড়ার অনেক কারণ আছে। প্রথম কারণ যুদ্ধে মানবিক পরিস্থিতির করুণ দশার কথা না বলে বাইডেন ইসরায়েলকে অকুণ্ঠ সমর্থন দিয়েছেন।
এমনকি প্রেসিডেন্ট বাইডেন ইসরায়েলকে রাজনৈতিক ও সামরিক সমর্থন দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতেই ক্ষান্ত হননি। গাজায় ইসরায়েল বোমা হামলা চালাচ্ছে, তখন তিনি তাদের আরও ১ হাজার ৪০০ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি সহায়তা দিতে কংগ্রেসকে অনুরোধ করেছেন। অথচ ইসরায়েল আগে থেকেই প্রতিবছর যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে ৩৮০ কোটি ডলার সহায়তা পেয়ে আসছে।
আরব আমেরিকান ও প্রগতিশীলদের ক্ষুব্ধ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো, গাজায় মৃত মানুষের সংখ্যা নিয়ে বাইডেনের সন্দেহ প্রকাশ করা। সেখানে মৃত মানুষের সংখ্যা সাড়ে ১১ হাজার ছাড়িয়ে গেছে। অথচ তিনি বলেছেন, সেখানে যে হতাহতের সংখ্যা বলা হচ্ছে, তাতে তাঁর আস্থা নেই।
কিন্তু দেশের ভেতরে ইসলামবিদ্বেষের ক্রমবর্ধমান খবর আসতে থাকলে বাইডেন প্রশাসনের সুরে পরিবর্তন আনেন। গত ১৪ অক্টোবর শিকাগোয় ওয়াদিয়া আল-ফায়োমি নামের ৬ বছর বয়সী এক ফিলিস্তিনি শিশুকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয়। তার মা গুরুতর আহত হন। ধারণা করা হচ্ছে, ইসলামবিদ্বেষ থেকে এমনটা হয়েছে।
বাইডেন জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে ওই হত্যাকাণ্ডের প্রসঙ্গটি টানেন। তিনি বলেন, ‘আমাদের অবশ্যই ইহুদিবিদ্বেষের নিন্দা করতে হবে। আমাদের অবশ্যই দ্ব্যর্থহীনভাবে ইসলামবিদ্বেষের নিন্দা জানাতে হবে।’
এই হত্যাকাণ্ডের পরই ফিলিস্তিনি ও মুসলমানদের অধিকার নিয়ে কাজ করেন—এমন ব্যক্তিদের নিয়ে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করে বাইডেন প্রশাসন।
গত ২৩ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যন্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, তিনি আরব ও ফিলিস্তিনি আমেরিকান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করেছেন। এর কিছুদিন পর হোয়াইট হাউস পাঁচজন মুসলিম প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকের আয়োজন করে। তবে সেই বৈঠকের বিষয়টি প্রকাশ করেনি প্রশাসন।
আরব সেন্টার ওয়াশিংটন ডিসির একজন জ্যেষ্ঠ ফেলো ডানা এল কুর্দ আল–জাজিরাকে বলেন, এসব ঘটনায় প্রশাসনের ভূমিকা নিয়ে লোকজন খুবই ক্ষুব্ধ। এটা অনেকটা আগুনে ঘি ঢেলে দেওয়ার মতো।
মুসলিম আমেরিকান অ্যাডভোকেসি গ্রুপের রাজনৈতিক পরিচালক ও আইনপ্রণেতা ইয়াসমিন তায়েব বলেন, বাইডেনের প্রতি সমর্থন কমে যাওয়ায় মুসলিম ও আরব আমেরিকানদের প্রতি প্রশাসনের এই বার্তা। মূল উদ্দেশ্য তাঁদের সমর্থন টানা, এর বাইরে কিছু নয়। প্রশাসনের এ উদ্যোগকে তিনি সত্যি বলে মনে করছেন না। তারা যে ক্ষতি করেছে, সেটার প্রভাবকে কমিয়ে আনার চেষ্টা করছে।
ইসলামবিদ্বেষবিরোধী কৌশল
আরব আমেরিকানদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টার আরেকটি দিক হলো, ইসলামবিদ্বেষের মোকাবিলায় হোয়াইট হাউসের জাতীয় কৌশল।
১ নভেম্বর হোয়াইট হাউস এক ঘোষণায় বলেছে, ‘আমাদের জাতির আত্মাকে পুনরুদ্ধার করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেন আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে লড়তে চাইছেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন। আমেরিকাতে কারও বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানোর কোনো জায়গা নেই।’ তবে কবে পরিকল্পনা চূড়ান্ত হবে, সে বিষয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কিছু বলা হয়নি।
ইতিমধ্যে দেশটির মুসলিমদের অধিকার নিয়ে কাজ করা সবচেয়ে বড় সংগঠন কাউন্সিল অব ইসলামিক রিলেশনস (সিএআইআর) হোয়াইট হাউসের এ উদ্যোগকে নাকচ করে দিয়েছে।
সিএআইআর এক বিবৃতিতে বলেছে, মুসলিমবিরোধী মতাদর্শ মোকাবিলা করতে প্রেসিডেন্ট বাইডেনকে এখন যে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিতে হবে, তা হলো, আমেরিকান মুসলিম নেতারা যে দাবি জানিয়ে আসছেন, তা পূরণ করা। আর সেটি হচ্ছে, গাজায় যুদ্ধবিরতির দাবি।
গাজায় ইসরায়েলের বেসামরিক মানুষকে গণহত্যা, অমানবিক কর্মকাণ্ড, বর্ণবাদী আচরণ ও বারবার ইসরলামবিদ্বেষী বক্তব্যরে কারণে এই ইসলামবিদ্বেষ বাড়ছে। ইসরায়েলি গণহত্যাকে ‘যুদ্ধের মূল্য’ হিসেবে ন্যায্যতা দিতে এবং বিশ্বজুড়ে মুসলিম ও ফিলিস্তিনিদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়াতে বিশ্বব্যাপী ইসলামভীতি ব্যবহার করা হচ্ছে।
গত মাসে বাইডেন বলেছিলেন, ‘যুদ্ধ চালানোর মূল্য’ হিসেবে গাজায় হাজার হাজার বেসামরিক মানুষের মৃত্যু হয়েছে।
তায়েব বলেন, মুসলিম আমেরিকান অধিকারকর্মীরা দীর্ঘদিন ধরে ইসলামবিদ্বেষী মনোভাবের বিরুদ্ধে মার্কিন সরকারের আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ চেয়ে আসছে। কিন্তু এমন সময়ে এ নিয়ে ঘোষণা দেওয়ায় প্রশ্নও উঠছে।
তায়েব বলেন, এখন গাজায় চলমান গণহত্যার মধ্যে তাদের (মার্কিন প্রশাসন) সম্পর্কে যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে, তা প্রশমিত করতে চাইছে তারা। দেখাতে চাইছে, এখানকার মুসলমানদের তারা গুরুত্বের সঙ্গে দেখে। কিন্তু পুরো জিনিসটাই অর্থহীন।
ফিলিস্তিনি আমেরিকান অ্যাডভোকেট হান্না হানানিয়া বলেন, ‘বাইডেন প্রশাসনের এই যোগাযোগ বাড়ানোর উদ্যোগ “খুবই কম, একই সঙ্গে অনেক দেরিও হয়েও গেছে।” আমার মনে হয় না, এসব করে এখানকার মুসলিম সম্প্রদায়ের ওপর তেমন প্রভাব পড়বে। তারা খুবই ক্ষুব্ধ ও হতাশ।
সবই শেষ
বাইডেন প্রশাসন ফিলিস্তিনিদের বর্বর হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছে, অথচ তারা হলো ভুক্তভোগী। উদাহরণ টেনে তিনি হোয়াইট হাউসের প্রেস সেক্রেটারি কারিন জিন-পিয়েরের সাম্প্রতিক এক বিবৃতির প্রসঙ্গে টানেন। সংবাদ ব্রিফিংয়ের সময় ইসরায়েলবিরোধী বিক্ষোভ সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি ২০১৭ সালের ভার্জিনিয়ার নব্যনাৎসিদের বিক্ষোভের প্রসঙ্গ টেনেছিলেন।
হানানিয়া বলেন, বাইডেনও মিথ্যা বলেছেন। তিনি বলেছিলেন, ইসরায়েলে শিশুদের শিরশ্ছেদ করা হয়েছে, এমন ছবি তিনি দেখেছেন।
৪ নভেম্বর ওয়াশিংটন ডিসিতে লাখো মানুষ জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করেন, যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানিয়েছিলেন। সেখানে বাইডেন ছিলেন মূল লক্ষ্য। তাঁর বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের হত্যা এবং ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধে পৃষ্ঠপোষকতার অভিযোগ আনা হয়।
আরব ও মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকজন যদি বাইডেন ও তাঁর ডেমোক্রেটিক পার্টিকে ছেড়ে যায়, তাহলে অনেক রাজনীতিকের আর আসন পাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে না।
রিপাবলিকান পার্টির অনেকেও ইসরায়েলপন্থী মনোভাব দেখিয়েছে। গত সপ্তাহে রিপাবলিকান আইনপ্রণেতারা ফিলিস্তিনিরা যাতে যুক্তরাষ্ট্রে ভিড়তে না পারে এবং ইতিমধ্যে যাঁরা ১ অক্টোবরের পর ভিসা পেয়ে এখানে এসেছেন, তাঁদের বিতাড়িত করতে নতুন আইন প্রণয়ন করতে একটি উত্থাপন করেছে।
রিপাবলিকানদের এমন উদ্যোগ সত্ত্বেও ৪ নভেম্বর বেশ কয়েকজন বিক্ষোভকারী আল–জাজিরাকে বলেছেন, গাজায় যেভাবে মৃত্যু বাড়ছে, তাতে ডেমোক্র্যাটদের ভোট দেওয়ার জন্য ‘মন্দের ভালো’ এই যুক্তি আর ভবিষ্যতে কাজ করবে না।
লেবানিজ বংশোদ্ভূত এক মার্কিন বিক্ষোভকারী ডেমোক্র্যাটদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার পরিবার বা অন্য কারও কাছ থেকে তাঁরা কোনো ভোট পাবেন না। সব শেষ। আগে তাঁদের ভোট দিয়েছি। কারণ, আমার কাছে তাঁদের চেয়ে ভালো কোনো বিকল্প ছিল না। এখন তাঁরা কোনো পছন্দের তালিকাতেই নেই।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।