শ্রেষ্ঠ সুফি হাকীমুল উমমত আশরাফ আলী থানভী রহ. - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ২:৩৯, ৯ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

শ্রেষ্ঠ সুফি হাকীমুল উমমত আশরাফ আলী থানভী রহ.

banglanewsus.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৪
শ্রেষ্ঠ সুফি হাকীমুল উমমত আশরাফ আলী থানভী রহ.

সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী (রাহা:)

ডেস্ক রিপোর্ট :

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘আল্লাহর বান্দাদের মধ্যে কিছু লোক এমন আছে, যারা নবীও নয়, শহীদও নয়। কিন্তু কিয়ামতের দিন আল্লাহর কাছে তাদের মর্যাদা দেখে নবী ও শহীদরা তাদের ওপর ঈর্ষা করবেন”।মাওলানা আশরাফ ‘আলি থানভি, অনেক দক্ষিণ এশিয়ার মুসলমানদের দ্বারা হাকিম আল-উমা (“মুসলিম উম্মার আধ্যাত্মিক চিকিৎসক”) এবং মুজাদ্দিদ আল-মিল্লা (“জাতির সংস্কারক”) হিসাবে উল্লেখ করা হয়েছে, তিনি ইসলামি পুনরুজ্জীবনের এক বিশাল ব্যক্তিত্ব এবং ঊনবিংশ-বিংশ শতাব্দীতে দক্ষিণ এশিয়ার পুনর্জাগরণ। মাওলানা থানভি ছিলেন “তার সময়ের সবচেয়ে বিশিষ্ট ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব, একজন প্রখ্যাত লেখক এবং আধুনিক ভারতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুফি বলে বিশ্বাস করা হয়।”আশরাফ আলী থানভী ছিলেন একজন দেওবন্দি আলেম, সমাজ সংস্কারক, ইসলামি গবেষক এবং পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি ভারতের থানা ভবনের নিবাসী হওয়ার কারণে তার নামের শেষে “থানভী” যোগ করা হয়। ভারতীয় উপমহাদেশ ও এর বাইরের অসংখ্য মানুষ তার কাছ থেকে আত্মশুদ্ধি এবং তাসাওউফের শিক্ষা গ্রহণ করার কারণে তিনি “হাকীমুল উম্মত” (উম্মাহর আত্মিক চিকিৎসক) উপাধিতে পরিচিত। মুসলমানদের মাঝে সুন্নতের জ্ঞান প্রচারের জন্য তিনি দাওয়াতুল হক নামক সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন।

জন্ম ও শৈশব:

হযরত থানভী রহ.-এর বাবার নাম ছিল আবদুল হক। তিনি হজরত উমর ইবনুল খাত্তাব (রা:) বংশের লোক ছিলেন আর তার মাতা ছিলেন ছিলেন হজরত আলীর (রা:) বংশধর । । তার জন্ম বৃত্তান্ত অলৌকিক ঘটনার সহিত সম্পৃক্ত। তার পিতার কোন পুত্র সন্তানই জীবিত থাকত না।তিনি একটি জটিল চরম রোগের শিকার হয়ে ডাক্তারের অভিমতে এমন এক ঔষধ সেবন করেন যাতে তার প্রজন্মের সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেন।এতে থানভী রহ. -এর মাতা দুঃশ্চিন্তা গ্রস্ত হয়ে পড়েন। এই কারণেই তিনি বিশিষ্ট বুজুর্গ হাফেয গোলাম মুরতাযা পানিপথী রহ.-এর শরণাপন্ন হন।তিনি ছিলেন খোদার প্রেমে আত্মহারা এক আল্লাহ ওয়ালা।তিনি বললেন,ওমরও আলীর সাথে সংযুক্ত করে নাম রাখার দরকার নাই।এবার পুত্র সন্তান জন্ম হলে হযরত আলীর সাথে মিলিয়ে নাম রাখ। ইনশাআল্লাহ জীবিত থাকবে।তারপর আশরাফ আলী থানভী ১৯ আগস্ট, ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে /৫ রবিউস সানী , ১২৮০ হিজরীতে ভারতের উত্তর প্রদেশের থানাভবনে জন্মগ্রহণ করেন। প্রখ্যাত মজজুব সাধক হাফিজ গোলাম মুর্তদা পানিপতি নামে একজন মাতৃ আত্মীয় তাঁর নাম আশরাফ ‘আলী রেখেছিলেন। থানভী ভাইবোনদের মাঝে সকলের বড় ছিলেন। শৈশবে মাত্র পাঁচ বছর বয়সে তিনি মাকে হারান।শৈশব থেকেই থানভীর চাল-চলন ছিল অত্যন্ত সুন্দর ও পরিচ্ছন্ন। তিনি কখনো বাইরের ছেলেদের সঙ্গে মিলামিশা করতেন না।ছোট ভাই আকবর আলীর সাথে নিজ বাড়ীর সীমার মধ্যে খেলাধুলা করতেন।বাল্যকালে তিনি অত্যন্ত শান্ত ও সুবোধ ছিলেন। সেজন্য অমুসলিমরাও তাঁকে অত্যন্ত স্নেহের চোখে দেখত। ছোট কাল থেকেই তিনি নিয়মিত নামাজ পড়ার উদ্যোগী ছিলেন এবং বারো বছর বয়সে তিনি নিয়মিত তাহাজ্জুদ পড়তেন। চাচী আম্মা নিষেধ করা সত্ত্বেও তিনি নিয়মিত নামায পড়া থেকে বিরত থাকেন নাই।

শিক্ষাজীবন:

তিনি থানা ভবনে তার মামা ওয়াজিদ ‘আলি এবং মাওলানা ফাত মুহাম্মদের অধীনে প্রাথমিক আরবি এবং ফারসি শিক্ষা অর্জন করেন এবং মিরাটের হাফিজ হোসেন ‘আলির কাছ থেকে খুব অল্প বয়সে কুরআন মুখস্ত করেন। ১২৯৫ হিজরীতে আশরাফ আলী ইসলামি জ্ঞান-বিজ্ঞানে উচ্চশিক্ষা অর্জনের জন্য দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন।পাঁচ বছর পর ১৯ বছর বয়সে তিনি দেওবন্দের শিক্ষা সমাপ্ত করেন। দারুল উলুম দেওবন্দে তিনি হাদীস, তাফসীর, আরবী সাহিত্য, ইসলামী দর্শন, যুক্তিবিজ্ঞান, ইসলামি আইন এবং ইতিহাস অধ্যয়ন করেন। তাঁর শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন মাওলানা মুহাম্মদ কাসিম নানোতভী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী, মাওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব নানোতভী এবং শায়খ আল-হিন্দ মাওলানা মাহমুদ আল-হাসান। দেওবন্দে থানভীর ছয় বছর খোদাভীরু পুরুষদের শিক্ষকতা ও নির্দেশনায় অতিবাহিত হয়েছিল, যাদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর আধ্যাত্মিক ছাত্র।দারুল উলুম দেওবন্দের প্রথম যুগের শিক্ষা সমাপনকারী ছাত্রদের মাঝে তিনি অন্যতম। আশরাফ আলী থানভী দারুল উলুম দেওবন্দে থেকে 1301 হি (1884 খ্রিস্টাব্দে) স্নাতক হন। কুতুবুল আলম মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গোহী স্নাতক অনুষ্ঠানের জন্য উপস্থিত হলে, শায়খ আল-হিন্দ মাহমুদ আল-হাসান তাঁকে জানিয়েছিলেন যে সেদিন একজন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান ছাত্র স্নাতক হবে। গাঙ্গোহী এই মেধাবী ছাত্রকে পরীক্ষা করতে চেয়েছিলেন। তাই, প্রকৃত অনুষ্ঠানের আগে, গাঙ্গোহি থানভিকে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন যা তিনি ভাবতে পারেন। তার উত্তরগুলো বিস্মিত ও খুশি হয়ে গেল মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গোহী।গ্রাজুয়েশনে পাগড়ি বাঁধা অনুষ্ঠান (দস্তর বান্দি) পরিচালনা করেন রশীদ আহমদ গঙ্গোহী। কুতুবুল আলম রশীদ আহমদ গাঙ্গুহী রহ. থানভী রহ. এর মাথায় পাগড়ী পরিধান করিয়ে দেন। এবং তার জন্য বিশেষ দুআ করেন।থানভী রহ. এর বিশেষ গুণ এই ছিল যে,পাঠ্য জীবনে কারো সাথে মিলামিশা করতেন না। অহেতুক আড্ডা দিয়ে মুল্যবান সময় অপচয় করতেন না।হয়ত কিতাব মুতালায় ব্যস্ত থাকতেন, নতুবা অবসর হলে ইয়াকুব নানূতবী রহ. এর খিদমতে বসে থাকতেন। দেওবন্দ শহরে তার অনেক আত্মীয় স্বজন থাকা সত্ত্বেও তারা বারবার পিড়াপিড়ি করা সত্ত্বেও তিনি পড়া নষ্ট হবে ভেবে কখনো তাদের বাসায় যেতেন না এবং বলতেন যে, আমার পিতা আমাকে এখানে পড়ার জন্য পাঠিয়েছেন, বেডানোর জন্য নয়।

দেওবন্দে দুটি স্বপ্ন:

১, একবার তিনি স্বপ্নে দেখেন যে,একটি কুপ হতে রৌপ্য স্রোত প্রবাহিত হয়ে তার পিছে পিছে চলছে। ২, অন্য এক স্বপ্নে তিনি দেখেন যে, জনৈক বুজুর্গ ও কোন এক দেশের গভর্নর এই দুই ব্যক্তি তাকে একটি চিঠি লিখেন। উভয় চিঠিতে এ কথা লিপিবদ্ধ ছিল যে,আমরা আপনাকে মর্যাদা প্রদান করলাম।ঐ চিঠির একটিতে নবীজির নাম মোহর অংকিত ছিল। তার লেখা গুলো বেশ স্পষ্ট সুন্দর ছিল। অবশ্য অন্য চিঠিটির মহরের চিহ্ন অস্পষ্ট থাকায় পড়া যাচ্ছিল না। থানভী রহ. উভয় স্বপ্নের ব্যাখ্যা নিজ প্রাণপ্রিয় উস্তাদ এবং দেওবন্দের শিক্ষাসচিব মাওলানা ইয়াকুব নানূতবী রহ. এর নিকট জিজ্ঞাসা করেন। উত্তরে তিনি প্রথম স্বপ্নের ব্যাখ্যায় বলেন যে, পৃথিবীর ধন-সম্পদ তোমার পদ চুম্বন করবে কিন্তু তুমি সেদিকে ভ্রূক্ষেপ করবে না। আর দ্বিতীয় স্বপ্নের ব্যাখ্যা এই যে, ইনশাআল্লাহ দ্বীন -দুনিয়ায় তোমার যথেষ্ট মান- সম্মান হবে।ছাত্র কাল থেকেই তিনি শিক্ষকদের খিদমত করতেন।ফলে তিনি ছাত্র জীবনে সর্বোত্তম ছাত্র, আর কর্ম জীবনে সর্বোত্তম আলেম নামে খ্যাতি লাভ করেন।

হাজী ইমদাদুল্লাহর অধীনে আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ:

রাসুলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “ওলামাদের সঙ্গ নিজের উপর বাধ্যতামূলক করুন এবং জ্ঞানীদের কথা শুনুন, কারণ মহান আল্লাহ তায়ালা প্রজ্ঞার আলো দ্বারা মৃত হৃদয়ে জীবন ফিরিয়ে দেন। যেমন তিনি বৃষ্টির মাধ্যমে মৃত পৃথিবীকে জীবিত করেন” (আসকালানী ২৫)।একজন ধার্মিক, খোদাভীরু শায়খের সাহচর্য প্রত্যেক মুসলমানের জন্য আবশ্যক। থানভি তার অভ্যন্তরীণ সংশোধনের দিকে মনোনিবেশ করার বিষয়ে ব্যাপকভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে, তিনি কুতুবুল আলম মাওলানা রশিদ আহমদ গঙ্গোহীকে আধ্যাত্মিক বিজ্ঞানে প্রশিক্ষণ দিতে বায়আত হওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন । কিন্তু গাঙ্গোহী তাকে তার ঐতিহ্যগত পড়াশোনা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার পরামর্শ দেন।আশরাফ ‘আলী থানভি অস্থির ছিলেন এবং গাঙ্গোহীর আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক পীর সাহেব হাজী ইমদাদুল্লাহকে গাঙ্গোহীর কাছে সুপারিশ করার জন্য উপায় খুঁজছিলেন। যখন গাঙ্গোহী হজে যান, তখন থানভি তার সাথে হাজী ইমদাদুল্লাহর কাছে একটি চিঠি পাঠান, যাতে তিনি গাঙ্গোহীকে তার আধ্যাত্মিক নিয়মে দীক্ষা দিতে ও বায়আত করানোর জন্য অনরোধ করতে বলেন। হাজী ইমদাদুল্লাহ চিঠি পরে আশরাফ ‘আলী থানভির জন্য একটি ভাল একটা কথা বললেন, “ঠিক আছে, আমি নিজেই তাকে বায়আত করাবো ।” তিনি থানভিকে লিখেছেন, “চিন্তা করবেন না। আমি তোমাকে আমার নিজের পরামর্শের অধীনে নিয়েছি।” থানভি চিঠিটি পড়লে তার মন আনন্দে ভরে ওঠে।দেওবন্দ থেকে স্নাতক হওয়ার পর, থানভি তার পিতার সাথে পবিত্র শহর মক্কা ও মদিনায় যান। তার প্রথম হজ পালনের পর, থানভি ক্বারি মুহাম্মদ আবদুল্লাহ মুহাজির মক্কির অধীনে কোরআন তেলাওয়াতের শিল্পে দক্ষতা অর্জন করেন। মক্কায় তিনি হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর তাকে বায়আত করেন এবং সাথে থাকার সুযোগও পেয়েছিলেন, যার আধ্যাত্মিক মনোযোগ, ব্যক্তিত্ব, শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের পদ্ধতি থানবীকে তিনি যে সংস্কার আন্দোলনের নেতৃত্ব দেবেন তার জন্য প্রস্তুত করেছিলেন।আশরাফ ‘আলী থানভি তার প্রথম হজের সময় হাজী ইমদাদুল্লাহর সাথে দেখা করেন কিন্তু বেশি দিন তার সাথে থাকতে পারেননি। আশরাফ ‘আলী থানভি দ্বিতীয়বার তীর্থযাত্রার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন এবং হজ করার পর ছয় মাস শায়খের সাথে অবস্থান করেন।

কর্মজীবন:

১৩০০ হিজরীতে থানভী কানপুরের ফয়যে আম মাদ্রাসায় মাসিক ২৫ টাকা বেতনে শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। তার জ্ঞানের কারণে তার উপাধি দেয়া হয় বাহরুল উলুম (জ্ঞানের সাগর)।পরবর্তীতে তিনি কানপুর শহরের পটকাপুর মহল্লায় জামেউল উলূম মাদ্রাসার শায়খুল হাদীস ও প্রধান পরিচালকের দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি ১৪ বছর শিক্ষকতা করেন এবং এই মাদ্রাসা থেকে উনার ছাত্রদের মধ্যে রয়েছেন মাওলানা ইসহাক বর্ধমানী এবং মাওলানা হাবীবুল্লাহ চাটগামী। পরবর্তীতে ১৩১৫ হিজরীতে হাজী ইমদাদুল্লাহ্ মুহাজিরে মক্কীর পরামর্শে তিনি থানাভবনের খানকাহে ইমদাদিয়ায় অবস্থান গ্রহণ করেন এবং জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সেখানে অবস্থান করেই ইসলাম প্রচার, আত্মশুদ্ধি,তাসাওউফ ও রচনার কাজ করে যান।

রচনাবলী:

মাওলানা থানভী একজন বিশিষ্ট লেখক ছিলেন। দীনের এমন কোনো দিক নেই যে বিষয়ে তিনি কলম ধরেন নি।তাঁর সাহিত্যিক অবদান “উপদেশ, আলোচনা, বক্তৃতা, গ্রন্থ অনেক উচ্চমানের ও । সাইয়্যেদ সুলায়মান নদভী বলেন, “মাওলানা থানভী কুরআনের একজন অনুবাদক ও ব্যাখ্যাকারী (মুফাসসির) ছিলেন। তিনি এর হুকুম ও প্রজ্ঞা ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি সন্দেহ দূর করেন এবং কুরআন সম্পর্কিত প্রশ্নের উত্তর দেন। মাওলানা থানভী ছিলেন একজন হাদীসের পন্ডিত (মুহাদ্দিস) এবং এর জটিলতা ও সূক্ষ্মতা ব্যাখ্যা করেছিলেন। তিনি একজন আইনজ্ঞ (ফকিহ) ছিলেন যিনি হাজার হাজার আইনি আদেশ (ফতওয়া) জারি করেছিলেন। তিনি ছিলেন একজন চলমান বক্তা (খতিব) যার বক্তৃতা ছিল বক্তৃতার সমস্ত দক্ষতা। তিনি একজন চমৎকার উপদেশদাতা (ওয়ায়েজ) ছিলেন এবং তার শত শত বক্তৃতা প্রকাশিত হয়েছে এবং ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। মাওলানা থানভীর প্রচেষ্টা এবং অবদানের বর্ণনা দিয়ে, মুফতি মুহাম্মদ তাকী ‘উসমানী লিখেছেন, “তার কৃতিত্বের উপমা অনেক পূর্ববর্তী শতাব্দীতে পাওয়া যায় না”।ভারতীয় আইনবিদ কাদি মুজাহিদুল ইসলাম কাসিমি বলেছেন, “ইসলামী বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র যা তার লেখার দ্বারা অনুপস্থিত রয়েছে তা ভাবা কঠিন”।তিনি সারা জীবনে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে বারো হাজারের উপরে গ্রন্থ রচনা করেছেন। তাঁর প্রসিদ্ধ গ্রন্থগুলোর মাঝে অন্যতম হলো ফিকাহ বিষয়ক গ্রন্থ বেহেশতী জেওর । যা ভারত উপমহাদেশের সাধারণ মুসলমানদের মাঝে বহুল পঠিত। এছাড়া তাঁর রচিত কুরআন শরীফের উর্দূ তরজমার গ্রন্থ বয়ানুল কুরআন (কুরআনের ব্যাখ্যা) সুপরিচিত। তিনি জাতির কল্যাণের জন্য তাঁর সকল গ্রন্থের স্বত্ব উন্মুক্ত রেখেছেন।যদিও মাওলানা থানভী তার সময়ের সবচেয়ে প্রসিদ্ধ লেখক ছিলেন, তিনি তার কোনো বই আয়ের উৎস হিসেবে ব্যবহার করেননি।

আশরাফ আলী থানভীর উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা:

☞ এক ব্যক্তি হাকীমুল উম্মতের জন্য আখের গুড় হাদিয়া সরুপ আনিল, কিন্তু তিনি উহা গ্রহণ করিলেন না। পরে জানা গেল যে, ঐ গুড় ছিল জাকাতের।
☞ হে হযরত হাকীমুল উম্মতের খেদমতে এসলাহের জন্য আসিলে তিনি তাহার গোপনরোগ ধরিতে পারিতেন এবং ঐ হিসাবে তাহার এসলাহ করিতেন। তাঁহার নিকট কোন রোগ গোপন রাখার উপায় ছিলনা।
☞ তাঁহার কোন ভক্ত রোগারোগ্যের জন্য দো‘আ চাহিয়া পত্র লিখিলে লেখার সঙ্গে সঙ্গে নিরাময় হইয়া যাইত।
☞ কানপুরে কলিমুল্লাহ নামে এক ব্যক্তির হামেশা অসুখ লাগিয়া থাকিত। আরবী ‘কিল্ম’ (অর্থ জখম) হইতে এই কলিমুল্লাহ নামের উৎপত্তি বলিয়া তাঁহার নাম রাখিয়া দিলেন ছলিমুল্যাহ। অতপর ঐ ব্যক্তির কোন অসুখ হইত না।
☞হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানভী রাহ. ওয়াজ করে কখনো কোনো প্রকার বিনিময় গ্রহণ করতেন না। এমন কি হাদিয়ার ক্ষেত্রেও যদি বিনিময়ের আকৃতি প্রকাশ পেতো, তাহলে সে হাদিয়াও গ্রহণ করতেন না।একবার কানপুরে নবাব সিদ্দীক হাসান খান ছাহেবের কন্যা সুফিয়া বেগম হযরত থানভী রাহ.-কে ওয়াজের জন্য দাওয়াত করলেন। ওয়াজ শেষ হওয়ার পর বড় অংকের টাকা হযরতের খেদমতে পেশ করলেন। হযরত থানভী রাহ. গ্রহণ করতে পরিষ্কারভাবে অস্বীকৃতি জানালেন। তখন তিনি বললেন, “এটা বিনিময় নয়।” হযরত থানভী রাহ. বললেন, পদ্ধতিটা তো বিনিময়েরই মতো। পরবর্তীতে হাদিয়া দেওয়ার সামর্থ্য না থাকলে, কেউ আর ওয়ায করানোর সাহস করবে না। এরপর সুফিয়া বেগম খানা খাওয়ার অনুরোধ করলে হযরত বললেন, আমার বাসায় পাঠিয়ে দিবেন। যাতে এতেও বিনিময়ের সন্দেহ না হয়। কারণ আমি এখন অন্য আরেকজনের মেহমান।
খানা বাসায় পাঠাতে বলাটাও কেবল এ ভদ্র মহিলার খাতিরেই ছিলো। কারণ তাঁর ইখলাস সম্পর্কে হযরত রাহ. তাঁর পূর্বের আচরণেই অবগত হয়েছিলেন। (আশরাফুস সাওয়ানেহ ১ম খণ্ড ৬৪ পৃষ্ঠা)

☞হাকীমুল উম্মত হযরত থানভী রাহ. কখনো কারো নির্দেশিত বিষয়ে ওয়াজ করতেন না। ওয়াজ করার সময় আল্লাহ্ পাকের পক্ষ হতে যে বিষয় মনে আসতো সেটাই বয়ান করতেন।একবার এক লোক বললো, হযরত! ওয়াজে একটু ঢোল বাজানেওয়ালাদের খবর নিয়েন। হযরত থানভী রাহ. বললেন, “আমি কারো সমালোচনা করে কথা বলি না। এটা আমার অভ্যাস নয়। আমার যা বুঝে আসবে, তাই বয়ান করবো।”হযরত থানভী রাহ. আরো বলতেন, ওয়াজে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ছাড়া অন্য কিছু উদ্দেশ্য হওয়া ঠিক নয়। ফরমায়েশী (অর্ডারী) বিষয় সাধারণত বিশেষ উদ্দেশ্যে হয়ে থাকে। ফলে ওয়াজের প্রতিক্রিয়াও খারাপই হয়ে থাকে। (আশরাফুল সাওয়ানেহ, ১ম খণ্ড, ৬৫ পৃষ্ঠা)

আশরাফ আলী থানভীর শিষ্য:

মাওলানা থানভি জনসাধারণের সংস্কারের জন্য কঠোর পরিশ্রম করেছিলেন এবং সমগ্র দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে ছড়িয়ে থাকা বিপুল সংখ্যক শিষ্যকে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।আশরাফ আলী থানভীর শিষ্যদের তালিকায় উনবিংশ-বিংশ শতাব্দীর ভারতীয় সুফি ও দার্শনিক আশরাফ আলী থানভীর সেসব স্বীকৃত শিষ্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যাদের তিনি জীবদ্দশায় নিজের উত্তরসূরি বা খলিফা মনোনীত করেছিলেন। তিনি ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির কাছ থেকে চার তরিকার খেলাফত পেয়েছিলেন। তার মুরিদের সংখ্যা শতসহস্র। তার মধ্যে ১৩৯ জনকে তিনি উত্তরসূরি মনোনীত করেন। যার মধ্যে ৭০ জন ছিলেন বায়আতের অনুমতি প্রাপ্ত খলিফা বা মাজাযিনে বায়আত। আর ৫৯ জন ছিলেন সুহবতের অনুমতি প্রাপ্ত বা মাজাযিনে সুহবত। তার খলিফাদের মধ্যে সর্বশ্রেণির ব্যক্তি রয়েছেন। তারা খলিফায়ে থানভী নামেও পরিচিত বাংলাদেশ এ যাদের খিলাফতের দায়িত্ব দিয়েছেন তারা হলেন হযরত শামসুল হক ফরিদপুরী , হযরত আতহার আলী,মুহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী,হযরত শাহ আব্দুল ওয়াহহাব পীরজী হুজুর, হযরত হাবিবুল্লাহ কুরাইশি, হযরত মাওলানা সগির মুহাম্মদ, হযরত নুর বখশ, মাওলানা মকসুদুল্লাহ(বরিশাল) এরা প্রত্যেকেই হযরত থানভী রহঃ এর হাতেগড়া মানুষ ছিলেন।

মৃত্যু:

১৬ রজব, ১৩৬২ হিজরী/ জুলাই ১৯, ১৯৪৩ খ্রিষ্টাব্দে আশরাফ আলী থানভী থানাভবনে মৃত্যুবরণ করেন। সেদিন সোমবার ছিল। তার জানাযার নামাজে ইমামতি করেন তাঁর ভাগ্নে, হাদীসের মহান পণ্ডিত মাওলানা জাফর আহমদ ‘উসমানী’র নেতৃত্বে অনুষ্ঠিত হয় থানাভবনেই ইশকে বাযান নামক কবরস্তানে জামেন শহীদের মাযারের পাশে তাকে দাফন করা হয়।
তিনি জনসাধারণের একজন সংস্কারক, একজন অনুকরণীয় আধ্যাত্মিক পথপ্রদর্শক (শাইখ), একজন প্রখ্যাত লেখক, একজন আধ্যাত্মিক আইনজ্ঞ, একজন বুদ্ধিজীবী,বাহার-উল-উলুম (জ্ঞানের সাগর) এবং ইসলামী ঐতিহ্যের একজন শক্তিশালী হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন, যিনি এমন এক সময়ে যখন মুসলমানরা শারীরিক ও বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে আক্রান্ত হয়েছিল। পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি, আধুনিক যুগের সমস্ত ধর্মহীন প্রভাবের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তাঁর বক্তৃতা, লেখা, আইনি রায় (ফতোয়া) এবং আধ্যাত্মিক প্রশিক্ষণ (তারবিয়া) আকারে তাদের সাহিত্যিক এবং একাডেমিক ফায়ারপাওয়ার সরবরাহ করেছিল। মাওলানা থানভীর মহান ধর্মীয় সেবা ও প্রচেষ্টার বর্ণনা দিয়ে, মুফতি মুহাম্মদ তাকী ‘উসমানী লিখেছেন, “তাঁর কৃতিত্বের উপমা বহু পূর্ববর্তী শতাব্দীতে পাওয়া যায় না”

হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী (রহ:) এর নসিহত:

1.কোনো কাজে তাড়াহুড়া করবে না।এটা অত্যন্ত খারাপ,শয়তানের কাজ।
2.হক্বের অনৃুসরন করবে,নিজের কথা বা মতের উপর জমে থাকবে না।
3.সুখ্যাতির দ্বারা দ্বীনি ও দুনিয়াবি ক্ষতি হয়। যে সুখ্যাতি নিজের ইখতিয়ার ও ইচ্ছার মাধ্যমে অর্জিত হয়, তা অনিষ্টকর। কিন্তু যে খ্যাতি অনিচ্ছাকৃতভাবে হয়ে যায়, তা আল্লাহর নেয়ামত।
4.সঠিক অনুভব ও দ্বীনের গভীর জ্ঞান সে-ই অর্জন করতে পারে, যে মনোযোগ দিয়ে পড়ে এবং ওস্তাদগণকে সন্তুষ্ট রাখে। যে ছাত্র শুধু শ্রম ব্যয় করে; কিন্তু ওস্তাদগণকে সন্তুষ্ট রাখে না, সে প্রকৃত ইলম কখনো হাসিল করতে পারে না।
5.সবার সাথে ভাইয়ের মতো জীবন-যাপন করবে; কিন্তু লেনদেন করবে অপরিচিতের মতো।
6.তাড়াতাড়ি বাইয়াত হওয়া ভালো নয়। শায়েখের সাথে যখন ভালরূপে মহব্বত সৃষ্টি হয়, ঐ সময় বাইয়াত হলে বেশি উপকার পাওয়া যায়।
7.সূফী-সাধকগণ সব যুগেই বদনামের শিকার হয়ে থাকেন। কারণ, তারা চুপচাপ থাকেন এবং সহনশীল হন। কিন্তু আমরা কি জানি, তারা কেন ধৈর্যশীল হয়ে থাকেন? মূলত তারা সবরের মাধ্যমে আল্লাহকে নিজের বন্ধু বানিয়ে নেন।
8.অন্য ছাত্রের মেধা ও স্মরণ শক্তি নিয়ে কখনও হিংসা করবে না। এতে তোমার কোন ফায়দা তাতে হবেই না উল্টো ক্ষতি হবে। সর্বদা পেরেশানির গ্লানি বোঝা হয়ে থাকবে। মন বিক্ষিপ্ত থাকবে। ফলে লেখা-পড়ায় মন বসবে না। এ ছাড়াও হিংসার কারণে নেক আমল ধ্বংস হয়ে যায়।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।