ম আমিনুল হক চুন্নু :: কোন স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের জন্য, বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো আয়তনে, অর্থনীতিতে খাটো একটি দেশের জন্য বড় উদ্বেগ এবং উৎকণ্ঠার আর কিছু হতে পারে না। এই ভয়ংকর সংকটটি বাংলাদেশের জন্য তৈরি হয়েছে মিয়ানমার থেকে অন্যায় ও নৃশংসভাবে বিতাড়িত রোহিঙ্গাদের মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে দেশের ভেতরে বসবাসের জন্য জায়গা দিয়ে। আলামতে মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের এখন বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাসের একটি পাঁয়তারা চলছে। মিত্র বন্ধু, মিত্র নয়, শত্রুও নয় এমন কোন দেশকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়িয়ে বলতে দেখা যাচ্ছে না ‘যে কোন ভাবেই হোক, এই রোহিঙ্গা সংকটের আশু সমাধান চাই।’
১১ জুলাই ২০২৩ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার এক বক্তৃতায় বলেন, রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী আমাদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখন সসম্মানে মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনই এ সংকটের টেকসই সমাধান প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, করোনা মহামারির সময় আমাদের দেশে আশ্রয় নেওয়া মিয়ানমারের প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে ভুলে যায়নি। তাদের নিয়মিত টিকা, পরীক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া হয়েছে। এ বাংলাদেশে আশ্রিত বিশাল জনগোষ্ঠী আমাদের অঞ্চলের জন্য মানবিক সংকট তৈরি করছে এবং নিরাপত্তার জন্যও হুমকি।
বিশ্বজুড়ে যুদ্ধ, নিপীড়ন এবং সংঘাতের কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া মানুষের সংখ্যা ৭০ কোটি ৮০ লাখে পৌঁছেছে, যা গত সাত দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং ২০১৭ সালের তুলনায় এ সংখ্যা ২ কোটি ৩০ লাখ বেশি। প্রতিবেদন মতে, প্রতিদিন বিশ্বে ৩৭ হাজার মানুষ বাসস্থান ছাড়তে বাধ্য হচ্ছে। আর এর ফলে বিশ্বের মোট জনসংখ্যার তুলনায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা দ্রুতগতিতে বাড়ছে বর্তমান বিশ্বের প্রায় প্রতিটি মহাদেশেই জাতিগত সংঘাত, বর্ণবাদী আচরণ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সহ নানা কারণে যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে। যার ফলে অনেক দেশে মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, জীবন বাঁচানোর জন্য এক দেশ থেকে অন্য দেশে পাড়ি জমাচ্ছে। আর এসবের ফলে বিশ্বব্যাপী শরণার্থী সমস্যা ক্রমে বাড়ছে এবং রাষ্ট্র পরিচয়হীন মানুষের সংখ্যা ক্রমাগত বাড়ছে।
তাছাড়া অন্য এক প্রতিবেদনের তথ্য মতে, ২০১৮ সালে যে পরিমাণ মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে তা ১৯৫১ সাল থেকে বর্তমান পর্যন্ত রাখা হিসাব মতে সর্বোচ্চ। এর আগে ১৯৯২ পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তুলনায় বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা বেশি ছিল। সে সময় প্রতি ১ হাজার জনের মধ্যে ৩ দশমিক ৭ জন মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছে। অন্যদিকে ২০১৮ সালে এ সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে ৯ দশমিক তিনজনে পৌঁছেছে।
বিশ্বের এক দেশ থেকে আরেক দেশে দেশান্তরী হওয়াটা সুদূর অতীতকাল থেকেই চলছে। নেহাত পর্যটক হিসেবে কোনো দেশে যাতায়াত করলেও তীর্থযাত্রা, শিক্ষা, চাকরি, ব্যবসা এবং অভিযাত্রার কারণে গমনও অনেককে এক দেশ থেকে অন্য দেশে অভিবাসী করেছে। তবে বঙ্গীয় সমতলের মানুষ দেশান্তরী হয়েছে দাঙ্গার কারণে। ব্রিটিশরা এ উপমহাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ঘটে যাওয়া কলকাতার হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা বঙ্গীয় সমতলে স্থায়ী ক্ষত সৃষ্টি করে।
১৯২০-এর দশক থেকেই বাংলার মানুষদের হিন্দু-মুসলমানে ভাগ করার ও বাংলাবিরোধী শক্তির দ্বারা বাংলাকে পদানত করার ষড়যন্ত্র চলছিল। ব্রিটিশরা চলে যাওয়ার আগে ক্যাবিনেট মিশনের মাধ্যমে ১৯৪৬ সালের ১৬ ও ২৩ মে যখন তারা ভারতকে অইঈ এ তিন ভাগে ভাগ করার এবং সেই তৃতীয় ভাগে বাংলা, বিহার, আসাম রাখার প্রস্তাব দেয়, তখনই এ দাঙ্গার পরিকল্পনা করা হয়। এ দাঙ্গায় প্রায় ১০ হাজার মানুষের মৃত্যু হয়। এর পরে নোয়াখালীর দাঙ্গা ছিল হিন্দুদের ওপর এবং বিহারের দাঙ্গা ছিল মুসলমানদের ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার লক্ষ্যে। এর ফলেই সারা বাংলাকে হিন্দু-মুসলমান এলাকা ধরে ভাগ করা হয় এবং ভারত ও পাকিস্তানের অধীন করে দেয়া হয়। কিন্তু দাঙ্গা পরিস্থিতি থামেনি, ফলে লাখ লাখ মানুষ ভিটেমাটি ছেড়ে দেশান্তরী হয়ে যায়।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের আরাকান থেকে বাংলাদেশে আশা রোহিঙ্গাদের কাহিনী অত্যন্ত মর্মান্তিক। ব্রিটিশরা ১৮২৬ সালে আরাকান দখল করে-‘বিভেদ করে শাসন কর’-নীতি অনুসরণ করে। ১৯৪০ এর দশকে শুরু হওয়া দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে আরাকানের বৌদ্ধরা জাপানিদের পক্ষ নেয়। জাপানি সৈন্যরা এগিয়ে আসতে থাকলে ব্রিটিশরা রোহিঙ্গা মুসলমানদের নিয়োগ করে বাধা দেয়। মুসলমান ও বৌদ্ধদের মধ্যকার সৃষ্ট এ শত্রæতার ফলে ১৯৪২-৪৩ সালে দাঙ্গা হয় এবং উভয় পক্ষের হাজার হাজার লোক মারা যায়। এভাবে নৃতাত্ত্বিক ধারায় তারা পরস্পরবিরোধী হয়ে যায়। ১৯৪৮ সালে বার্মা স্বাধীন হলে যুদ্ধরত অবস্থায় এ দুই গোষ্ঠীকে বার্মার অধীনে দিয়ে ব্রিটিশরা চলে যায়। এ সময় রোহিঙ্গারা পাকিস্তানে যোগ দেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করলে পাকিস্তানি নেতারা তাদের সাহায্যে এগিয়ে আসেনি। ফলে তাদের পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়ে যায়। এরপর থেকে বিভিন্ন সময়ে দফায় দফায় রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশ করে।
সম্প্রতি সেখানে আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি নামের একটি বিদ্রোহী সংগঠন গড়ে ওঠে, যারা রোহিঙ্গা রক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর হামলা চালায়। ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট সংগঠনটির কথিত এক হামলার পরিস্থিতিতে মিয়ানমার সেনাবাহিনী নির্যাতনের মুখে রোহিঙ্গারা নিজের সম্পত্তি ও আবাদি জমি ফেলে ব্যাপক হারে বাংলাদেশে আসতে থাকে।
বাংলাদেশ ১৯৪৭ সালে পাকিস্তানের অংশ হিসেবে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পেয়েছিল। কিন্তু ওই পাকিস্তানের মানুষ বাংলাদেশের মানুষদের নয়, বাংলাদেশের সম্পদ চেয়েছিল। ১৯৭১ সালে স্বাধীন হয়ে যায়। সেই স্বাধীনতা যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ১৯৭১ সালে হয় বাঙালি বিহারি দাঙ্গা। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ বিহারি বাংলাদেশ ছেড়ে ভারত ও পাকিস্তানে চলে যায়। আজ স্বাধীনতার ৫৩ বছর পরে স্বাধীন বাংলাদেশের সীমানা ঘিরে উভয় পাশে বাস্তুচ্যুত মানুষদের নিয়ে এক অদ্ভুত পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের ভেতরে প্রায় ১৫ লাখ রোহিঙ্গা উদ্বাস্তু আছে, যারা শরণার্থী হয়ে ক্যাম্পে বাস করছে।
তাছাড়া এক শ্রেণির শরণার্থীরা স্বীয় রাষ্ট্রে থাকলেও সাধারণ নাগরিকদের তুলনায় এদের নাগরিক অধিকারের নিশ্চয়তা অনেক কম এবং আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা অবস্থায় যেসব শিশু জন্ম নিচ্ছে এদের যথাযথ হিসাব রাষ্ট্রের কাছে না থাকায় শিশুরা অনিবন্ধিত থাকছে। যার ফলে রাষ্ট্র কর্তৃক শিশুদের জন্য যে অধিকারগুলো দেওয়া হয় তা থেকে এরা বঞ্চিত হচ্ছে। প্রতিবেদন মতে, বিশ্বজুড়ে এসব শরণার্থীর দুই-তৃতীয়াংশের বেশি ইরাক, সিরিয়া, আফগানিস্তান, দক্ষিণ সুদান, মিয়ানমার ও সোমালিয়া এবং আফ্রিকার সাব-সাহারা অঞ্চল থেকে এসেছে। এর মধ্যে সিরিয়ার শরণার্থীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি প্রায় ৬৭ লাখ। এর পরই আছে আফগানিস্তান ২৭ লাখ। অন্যদিকে ২০১৭ সালের আগস্ট মাসের শেষ দিকে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের কারণে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ দাঙ্গার ফলে ৫০ লাখ উদ্বাস্তু ও স্থানীয় বাঙালি ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে দিনাতিপাত করছে। এসব নিরীহ মানুষ স্বেচ্ছায় নয়, জাতিগত দাঙ্গায় ঘর ছাড়া হয়েছে বা ঘরছাড়া হওয়ার হুমকিতে আছে। এছাড়া আছে তাদের কাহিনী, যারা মানব পাচারকারীদের প্রলোবনে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী জীবনযাপন করছে তার প্রকৃত তথ্য কারও কাছে নেই। তবে বিশ^ব্যাংক ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অভিযানের কারণে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা বাস্তুচ্যুত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। বাংলাদেশের বাইরে আসামে ‘বাঙাল খেদাও’ দাঙ্গার ফলে ৫০ লাখ উদ্বাস্তু ও স্থানীয় বাঙালি ভারতীয় নাগরিকত্ব হারানোর ভয়ে দিনাতিপাত করছে। এসব নিরীহ মানুষ স্বেচ্ছায় নয়, জাতিগত দাঙ্গায় ঘর ছাড়া হয়েছে বা ঘরছাড়া হওয়ার হুমকিতে আছে। এছাড়া আছে তাদের কাহিনী, যারা মানব পাচারকারীদের প্রলোবনে বিদেশে পাড়ি দিয়েছে। তবে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী কত মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়ে শরণার্থী জীবনযাপন করছে তার প্রকৃত তথ্য কারও কাছে নেই। তবে বিশ^ব্যাংক ২০১০ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে করা একটি গবেষণা প্রতিবেদন সম্প্রতি প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশে^র ১০০ কোটি মানুষ রাষ্ট্র পরিচয়হীন।
জাতিসংঘে বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি মাসুদ বিন মোমেন জাতিসংঘে তাঁর এক বক্তব্যে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গাদের বিতাড়নের ইতিহাস, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার প্রেক্ষিত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দরদি মন এবং মানবতার প্রতি তার অঙ্গীকার, রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তন, তাদের ভবিষ্যৎ এবং তাদের প্রত্যাবর্তনে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়দায়িত্ব নিয়ে গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মোমেন আরো বলেন, রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনের কোনো প্রক্রিয়াই দৃশ্যমান নয়। আবার ১৯৭০-এ যে পরিস্থিতিতে ভারত বাঙালিদের আশ্রয় দিয়েছিল, রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোটেও সে রকমটা নয়। বাঙালিদের সে ত্যাগ ছিল পাকিস্তানের শোষণ-নিপীড়ন, হত্যা-ধর্ষণ, বাঙালিদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে-পুড়িযে দেওয়ার মুখে দেশকে স্বাধীন করার অঙ্গীকার দেশ স্বাধীন হয়েছে, দেশত্যাগী বাঙালিরা ফিরে এসেছে স্বেচ্ছায় স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় পেয়েছে স্বাধীনতার লড়াইয়ে দেশত্যাগ করে নয়, তারা নিজ জন্মভ‚মি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করে দেশত্যাগে বাধ্য হয়নি। রোহিঙ্গাদের ভিটামাটি থেকে বিতারিত করা হচ্ছে জাতিগতভাবে তাদের নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে হত্যা, ধর্ষণ, নিপীড়নের মুখে তারা প্রাণ নিয়ে পালিয়ে এসে বাংলাদেশে এসেছে আশ্রয়ের আশায়।
এই বিপদের মুখে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দেন, দেশের শত সীমাবদ্ধতা নিয়েও। কিন্তু পরিস্থিতি বলছে, আশ্রয়গ্রহণকারীদের প্রত্যাবর্তন করে শেখ হাসিনার মানবিক মূল্যবোধের কোনো মূল্যায়ন হবে না কোনো পক্ষের কাছে। বিশেষ করে মিয়ানমার তার স্বার্থ ব্যতীত আর কিছুই বিবেচনায় নেবে না, নিচ্ছেও না। তাদের এই স্বার্থপর দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও তেমন উচ্চবাচ্য নেই। ভারত এবং চীনের তো নেই-ই। চীন অনেকটাই বাংলাদেশের পিঠে হাত রেখে প্রকাশ্যেই মিয়ানমারকে রোহিঙ্গা প্রশ্নে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকা বা ইউরোপের আহ্বান একেবারেই যে যথার্থ এবং যথেষ্ট নয়, তাও স্পষ্ট (১৫ জুলাই ২০২১, সাপ্তাহিক ঠিকানা)।
বাংলাদেশে অবস্থান করা কমপক্ষে ১২ লাখ রোহিঙ্গা অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশে অবস্থান করছে। এমন একটি চিত্রপট ক্রমশ যুক্তিগ্রাহ্য হয়ে উঠেছে, যদিও সুইডিশ সাংবাদিক ও লেখক বারটিল লিন্টনারের নোট বলছে, বাংলাদেশ সরকার মরিয়া হয়ে চায় না যে রোহিঙ্গা বাংলাদেশে থাকুক। এরই মধ্যে বাংলাদেশ ও মিয়ানমার সীমান্তের এই আশ্রয়শিবির বিশে^র সবচেয়ে বৃহৎ শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। সেখানে মানুষ উপচে পড়েছে। গাদাগাদি করে অবস্থান করছে তারা। আছে রোগ ছড়িয়ে পড়া ও মানব পাচারের বড় ঝুঁকি। লিন্টনার যেমনটা বলছেন, শরণার্থীদের নিয়ে ক্রমশ অসহিষ্ণু হয়ে উঠছেন বাংলাদেশি নাগরিকরা। তারা উদ্বিগ্ন এজন্য যে, তারা মনে করছেন রোহিঙ্গা স্থানীয়দের কাছ থেকে কর্মসংস্থান কেড়ে নিতে পারে বিশাল আকারের এই শরণার্থী শিবির পরিবেশের ক্ষতির কারণও। বাস্তবেই এ নিয়ে আশংকা আছে যে, এই দুর্দশাগ্রস্থ অবস্থার মধ্যে বাংলাদেশে যত বেশিদিন রোহিঙ্গা শরণার্থী থাকবেন, ততই বেশি উগ্রপন্থি গ্রæপগুলোর উগ্রবাদের টার্গেটে পরিণত হতে পারেন তারা।
অন্যদিকে মিয়ানমার সরকার যখন রোহিঙ্গাদের বলছে যে, তারা নিরাপত্তার সঙ্গে ফিরে যেতে পারেন, ঠিক তখনই দেখা যাচ্ছে রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়ার জন্য তারা প্রকৃতপক্ষে নিরাপদ, আস্থা অর্জনের মতো পরিবেশ সৃষ্টি করেনি (৬ সেপ্টেম্বর ২০১৯, সাপ্তাহিক প্রবাস)।
জাতিসংঘের ৭৭তম সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেয়া হয়েছে। মিয়ানমার সরকারকে অবশ্যই তাদের ফেরৎ নিতে হবে। আশ্রয়ের এই সাময়িক সময়ে বাংলাদেশ সরকার সাধ্যমতো শরণার্থীদের সহায়তা করবে। তিনি মিয়ানমার সরকারকে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন বন্ধের আহ্বান জানান।
অত্যাচার-নির্যাতনের মুখে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবিক কারণে আশ্রয় দেওয়ার সিদ্ধান্ত ইস্যুটিকে ঘিরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মূল টার্গেট ছিল দুটি। প্রথমত, রোহিঙ্গাদের পক্ষে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি করা। দ্বিতীয়, মিয়ানমারের রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ফেরৎ পাঠানো ও তাদের সম্মানের সঙ্গে বসবাস নিশ্চিত করা। এই দুটি লক্ষ্য স্থির করেই রোহিঙ্গা ইস্যুতে যাচ্ছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার পাশাপাশি রাজনৈতিক ক্ষেত্রে, জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনান নেতৃত্বাধীন রাখাইন এডভাইজরি কমিশন সেসব সুপারিশ করেছিল তা বাস্তবায়নে মিয়ানমারকে সমর্থন দেয়া উচিত আসিয়ানের। এর খসড়ায় যেসব কথা বলা হয়েছিল, তার যদি পূর্ণাঙ্গতা অনুধাবন করা যায় তাহলে সব সম্প্রদায় উপকৃত হবে।
দক্ষিণ এশিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থে অবিলম্বে রোহিঙ্গা সমস্যার আন্তর্জাতিক সমাধানের দাবি জানিয়েছেন, ‘১৯৭১ : গণহত্যা বাংলাদেশের সুবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশত বার্ষিকী শীর্ষক আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে বিশিষ্টজনরা। তারা আরো বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার যদি আন্তর্জাতিকভাবে সমাধান না হয় তাহলে এ অঞ্চলে শিগগিরই বিভিন্ন অন্তর্ঘাতমূলক জঙ্গি ও মৌলবাদী কর্মকান্ড শুরু হবে। যা থেকে ভারত, মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, চীন, রাশিয়া ও বাংলাদেশসহ পাশর্^বর্তী কোনো দেশ অভিঘাত থেকে বাদ পড়বে না। সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ ও গণহত্যা বিষয়ে ইতালি, কম্বোডিয়া, তুরস্ক, মিয়ানমার, যুক্তরাজ্য, ভারতের ১৭ জনসহ বাংলাদেশের শতাধিক গবেষক অংশ নিয়েছিলেন।
মিয়ানমারের মানবাধিকার কর্মী খিন জ উইল বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যু দক্ষিণ এশিয়ার একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা। এ সমস্যা মোকাবেলা করতে হলে সমন্বিত উদ্যোগ নিয়ে মিয়ানমার সরকারের ওপরে এ ব্যাপারে চাপ প্রয়োগ করতে হবে। এই সমস্যা বেশিদিন জিয়ে রাখা ঠিক হবে না।
বক্তারা তাদের বক্তৃতায় আরো বলেন, মিয়ানমারে গণতন্ত্র ফেরাতে কাজ করায় ২০২১ সালে মে মাসে মিয়ানমারের রাষ্ট্রীয় উপদেষ্টা ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী অং সান সূচিকে সম্মাননা দিয়েছিল লন্ডন সিটি করপোরেশন। রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতনের ঘটনায় সুচির এ সম্মাননা বাতিল করে সিএলসি। আলজাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লন্ডনের ঐতিহাসিক এবং অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলো পরিচালনা করা সিএলসি কর্তৃপক্ষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ভোটে সুচির সম্মান বাতিল করা হয়। এ বিষয়ে সিএলসি কমিটির প্রধান ডেভিড উট্রন বলেন, এই সিদ্ধান্ত মিয়ানমারের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য সিটি করপোরেশনের নিন্দার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু হেগ শহরে আন্তর্জাতিক আদালতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে গাম্বিয়ার করা মামলার শুনানিতে বিতর্কিত অবস্থানের পর সুচি আর এ সম্মানের যোগ্য নন বলে একমত হয়েছে সিএলসি।
হাসেম খান বলেন, বিশ্বজুড়ে যেসব গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে তার বিরুদ্ধে মানুষ সচেতন হবে। তরুণ প্রজন্ম গণহত্যাকারীদের রুখে দিতে শক্তি সঞ্চয় করবে। একই সঙ্গে তরুণরা গণহত্যার সহযোগী ও সহায়তাকারীদের প্রত্যাখ্যান করার সাহস পাবে।
রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে মায়ানমারে প্রত্যাবসানের কোজিত শেখ বাবুর গ্রুপ আলোকচিত্র প্রদর্শনীতে রোহিঙ্গাদের দুঃখ-দুর্দশার চিত্র ২০২২ সনের সেপ্টেম্বর-এ কানাডার টরেন্টো ডেন্টোনিয়া পার্কে আলোকচিত্র প্রদর্শনী জনসাধারণের সামনে তুলে ধরেন। এ সময় সংক্ষিপ্ত বক্তব্যে আহমদ ডি হোসাইন বলেন, বাংলাদেশে রোহিঙ্গা রিফিউজিদের মায়ানমারে প্রত্যাবসানে কানাডিয়ান সরকার বাংলাদেশের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছে। এমপি সালমা জাহিদ বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুটি কানাডা সরকার ও প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোর বিশেষ নজরে আছে। এমপিপি মাইক্যাল কটিউ বলেন, বাংলাদেশ সরকার ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মানবতার ডাকে সাড়া দিয়ে এক মহৎ দায়িত্ব পালন করেছেন, এখন বিশ্ববাসীদের এই দায়িত্ব ভাগাভাগি করে নিতে হবে। অন্যান্য বক্তারাও এই সমস্যা সমাধানে কানাডা, আমেরিকা, চীন, রাশিয়াসহ মোড়ল দেশগুলোকে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।
“বাংলাদেশের আকাশে কালো মেঘ রোহিঙ্গাদের স্থায়ী শরণার্থী করার ব্লুপ্রিন্ট” শিরোনামে যে সংবাদটি ঠিকানা পত্রিকার ৭ জুন, ২০১৯ সংখ্যার লিড নিউজ হয়েছিল, তাতে সেই আশংকাটাই স্পষ্ট ফুটে উঠেছে। ইতিমধ্যে ক’দিন আগেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাপান, সৌদী আরব, ফিনল্যান্ড সফর করে দেশে ফিরে যে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন, তাতে জানা গিয়েছে, তিনি সব দেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সরকার প্রধানদের কাছে রোহিঙ্গা শরণার্থী সংকটটি সমাধানের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু প্রকৃত অর্থে কারো কাছ থেকে কতোটা সাড়া আন্তরিকভাবে মিলেছে, তা মুহূর্তে বোঝা না গেলেও ভবিষ্যতে নিশ্চয়ই বোঝা যাবে। তবে বাস্তবতা যা, তাতে কেনো-যেনো পরিস্থিতিতে মোটেও বাংলাদেশের অনুক‚ল বলে মনে হচ্ছে না।
রোহিঙ্গা ইতিমধ্যে বাংলাদেশের জন্য এমন সমস্যা তৈরি করছে, যা বাংলাদেশের অস্তিত্বের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রথমত, রোহিঙ্গারা তাদের জন্য নির্দিষ্ট এলাকায় সীমাবদ্ধ না থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে পড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশের চিরায়ত সংস্কৃতি ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ার আশংকা যেমন দেখা দিয়েছে একদিকে, তেমনি অন্যদিকে তাদের বাহিত রোগ-ব্যাধিও ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে। অনেকে স্থানীয় ছেলে-মেয়েদের সঙ্গে বিয়ে-শাদী করে বাঙালি জনগোষ্ঠীর সঙ্গে মিশে যাওয়ারও চেষ্টা করছে।
এছাড়াও রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে আরো বেশ কিছু ভয়ংকর অভিযোগ উত্থাপিত হচ্ছে। যার মধ্যে আছে মাদক ব্যবসা, দেহ ব্যবসা। এসব ব্যবসার কর্তৃত্ব এবং প্রভাব নিয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি, খুনোখুনির ঘটনাও ঘটছে। স্পষ্টতই রোহিঙ্গা বাংলাদেশের জন্য এখন বিষফোঁড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি জানা যাচ্ছে, রোহিঙ্গারা ভুয়া তথ্য দিয়ে বাংলাদেশের পাসপোর্ট সংগ্রহ করছে। রোহিঙ্গাদের এরকম পাসপোর্ট সংগ্রহ করার কথা প্রকাশ পেয়েছে ঠিকানা পত্রিকার ৩১ শে ২০১৯ এ সংখ্যার একটি সংবাদে। সংবাদটি স্থান পেয়েছিল ভেতরে ৪৩ পৃষ্ঠায়। শিরোনাম ‘ভুয়া তথ্যে পাসপোর্ট নিচ্ছে রোহিঙ্গারা।’
এছাড়া অনেকের আশংকা, ভবিষ্যতে এই রোহিঙ্গারাই তাদের জন্য আজকের শরণার্থী অঞ্চল নিয়ে স্বাধীন ভ‚মির দাবি তুললে, আজকের সাহায্যদাতা অনেক দেশই হয়তো রোহিঙ্গাদের দাবির প্রতি সমর্থন দিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াবে; এবং ৭১-এর দৃষ্টান্ত তুলে ধরে বলার চেষ্টা করবে, “বাঙালিদের স্বাধীনতা যুদ্ধেও তো তাদের অনেকেই সমর্থন দিয়েছিল!”
রোহিঙ্গা সংকট বাংলাদেশের শিরে সংক্রান্তি। সর্বাধিক অগ্রাধিকার দিয়ে এ সংকট থেকে পরিত্রাণের উপায় বের করতে হবে। নিজের নাক কেটে অন্যের যাত্রাভঙ্গের সুযোগ নেই। দ্বিপাক্ষিক হোক, বহুপাক্ষিক হোক সর্বতোভাবে রাজনৈতিক ও ক‚টনৈতিক প্রয়াস নিতে হবে রোহিঙ্গা সংকট থেকে মুক্তি পেতে। এ সংকটের স্থায়ী সমাধানে মিয়ানমারে যে কোনো সদিচ্ছাই নেই, তা মনে হয় এরই মধ্যে স্পষ্ট হয়ে গেছে। এখন তাদেরকে বাধ্য করা ছাড়াও পথ নেই। সেই পথই এখন খুঁজতে হবে। এবং তা যতো দ্রুত হয়, বাংলাদেশের জন্য ততোই মঙ্গল। দিন যতো যাবে, সংকট ততোই গভীর থেকে গভীরতর হবে। সমাধানের পথও ততো জটিলতর হতে থাকবে। সবকিছু সামনে রেখেই সমাধানের উদ্যোগ নেয়াটা রাষ্ট্রের অস্তিত্বের দাবি।
১৩ জুন ২০২২ জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মিয়ানমার বিষয়ক মহাসচিবের বিশেষ দ্রæত ড. নোলিন হাইজারের ব্রিফিংয়ের পর প্রদত্ত বক্তব্যে জাতিসংঘে নিযুক্ত বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত রাবার ফাতিমা বলেন, ‘জীবন বাঁচাতে নিজভ‚মি থেকে রোহিঙ্গাদের পলায়নের পর ছয় বছর কেটে গেছে, যা সাম্প্রতিক ইতিহাসে সবচেয়ে বৃহৎ জোরপূর্বক নির্বাসনের ঘটনা। কিন্তু, তাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের প্রতিশ্রুতি অপূর্ণই রয়ে গেছে। এ পর্যন্ত একজন রোহিঙ্গাও নিজ দেশ মিয়ানমারে ফেরত যায়নি। বাংলাদেশে মানবিক আশ্রয়ে থাকা প্রায় ১৫ লক্ষ রোহিঙ্গা গভীর অনিশ্চয়তার মধ্যে দিনাতিপাত করছে। যে সকল রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে যেতে পারেনি তারা হয় আইডিপি ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছে অথবা জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ও নিরাপত্তাহীনতার অব্যাহত হুমকির মধ্যে রয়েছে।”
তিনি আরও বলেন, “শুধু আমাদের একক প্রচেষ্টার মাধ্যমে এ সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব নয়। মর্যাদাপূর্ণভাবে নিজ ভ‚মি মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনের অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে প্রয়োজন যথোপযুক্ত পদক্ষেপ ও কর্মসূচি। আর এটাই সবচেয়ে কাংখিত টেকসই সমাধান, যা রোহিঙ্গাদের দীর্ঘদিনের লালিত আকাংখা।” এছাড়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য, আশ্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা প্রদানে বাংলাদেশের প্রচেষ্টার কথা তুলে ধরে তিনি প্রত্যাবাসন উপযোগী সঠিক পরিস্থিতি সৃষ্টিতে আরও এগিয়ে আসতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান রাষ্ট্রদূত রাবার ফাতিমা।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র কংগ্রেসে পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটির র্যাঙ্কিং মেম্বার গ্রেগরি মিকস বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুর স্থায়ী ও টেকসই সমাধানে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ফলপ্রসূ হচ্ছে না রাশিয়া এবং চীনের কারণে। নিরাপত্তা পরিষদে এ দুটি দেশ ভেটো দিয়ে আসছে। গত ২৪ জুলাই’ ২৩ নিউইয়র্কের বাংলাদেশি অধ্যুষিত কুইন্সের জামাইকায় এক মত বিনিময় সভায় এসব কথা গ্রেগরি মিকস বলেন। কিন্তু কতদিন? প্রায় ছয় বছর ধরে মানুষ আশায় বুক বেঁধে রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানের। বাংলাদেশে তাদের এই আশ্রয় তো সাময়িক। এ প্রশ্নে বাংলাদেশের সুস্পষ্ট অবস্থান রোহিঙ্গাদের নিজ বাসভূমে ফিরে যেতে হবে।
প্রায় সাত বছরেও রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়নি। এই বিলম্ব দেশের মানুষকে ক্রমে ক্রমে অস্থির করে তুলছে। একাত্তরের অভিজ্ঞতায় তারা ভেবেছিল নয় মাসের মধ্যেই সমাধান। দেখেছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর অবিস্মরণীয় ক‚টনৈতিক তৎপরতা, তার বিরাট সাফল্য।
বাংলাদেশের মানুষ হয়তো রোহিঙ্গাদের ব্যাপারে এমনই কোনো আশার পথ চেয়েছিল। তারা ভেবেছিল রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে, রোহিঙ্গারা অচিরেই নিজেদের দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হবে। কিন্তু আট বছরেও তেমন কোনো সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে না। ইতোমধ্যে নানা ধরনের অবাঞ্ছিত পরিস্থিতির খবর আসছে রোহিঙ্গা আশ্রয় কেন্দ্রগুলিকে কেন্দ্র করে। সেখানে ঘটছে অপরাধমূলক কার্যকলাপ। আর ব্যাপক জন্মহারের কারণে ক্রমাগত বৃদ্ধি পেয়ে চলছে তাদের জনসংখ্যা, সে কারণে বিব্রত দেশের মানুষ, বিব্রত প্রশাসন।
আসলে কি হচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধানে? এ প্রশ্নে বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষীয় সূত্রের একটিই জবাব। ক‚টনৈতিকভাবে চাপ সৃষ্টি এবং বিশ^ জনমতকে রোহিঙ্গাদের পক্ষে আনার প্রয়াস চলছে। এ উদ্যোগে সফলভাবে এগিয়ে চলছে বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘে নিয়োজিত বাংলাদেশের সাবেক স্থায়ী প্রতিনিধি রাবার ফাতিমা, সম্প্রতি অনুষ্ঠিত সাংবাদিকদের সাথে তার প্রথম আলাপচারিতায়। তিনি বলেন, এই উদ্যোগের কারণেই আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে গাম্বিয়া মামলা করেছিল।
এ মামলার বাস্তব ফলটি কি পাওয়া গেল? রোহিঙ্গা গণহত্যা বন্ধের যে আদেশ আন্তর্জাতিক আদালত দিয়েছিল মিয়ানমার তা প্রত্যাখ্যান করেছে। লক্ষ্য করা যাচ্ছে, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ^ সংস্থাগুলিতে নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হচ্ছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের ক‚টনীতিকরা সর্বাত্মক প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু মিয়ানমার তাতে কোনো ভ্রুক্ষেপ করছে বলে মনে হচ্ছে না। আর বিশ্ব জনমতের মোড়ল যারা সেই সব দেশগুলি এ প্রশ্নে নিরব। প্রতিবেশী প্রভাবশালী দেশ চীনকে দেখা যাচ্ছে মিয়ানমারের পাশে অবস্থান নিতে। রোহিঙ্গা প্রশ্নে ভারতেরও কোনো ভ‚মিকা নেই।
সার্বিক বিবেচনায় এ কথা বলা বোধ করি অমূলক হবে না যে, জাতিসংঘ বা অন্যান্য বিশ্ব সংস্থাগুলিতে যতই নিন্দা প্রস্তাব গ্রহণ করা হোক, ক‚টনৈতিক চাপ যতই বৃদ্ধি করা হোক, তাতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবর্তনের পথ উন্মুক্ত হচ্ছে না। এমন অনেক নিন্দা প্রস্তাব তো বিশ্ব সংস্থাগুলিতে ফাইলবন্দী হয়ে রয়েছে কাশ্মীর নিয়ে, প্যালেস্টাইন নিয়ে। যুগ যুগ পেরিয়ে গেলেও এসব সমস্যার কোনো সমাধান হয়নি। একই পরিণতি কি হতে যাচ্ছে রোহিঙ্গা সমস্যা প্রশ্নে?
সুতরাং এ উপসংহারে আসাই যায় যে, বাংলাদেশের জন্য সামনে বহুমুখী সংকটই অপেক্ষা করছে। রোহিঙ্গা সংকট, ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী আদর্শের জাগরণ। একদিকে মানবতার দায়, অন্যদিকে মিত্রতার দায়। এসব থেকে পরিত্রাণ লাভ নির্ভর করছে সরকারের প্রজ্ঞা, প্রত্যয় ও সাহসিকতার উপর।
[লেখক : সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, শাহ্ খুররম ডিগ্রী কলেজ ও ভিজিটিং প্রফেসর এম সি কলেজ এবং বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়। কলাম লেখক, সাহিত্য-শিক্ষা ও সমাজ গবেষণামূলক বিষয়ে লেখালেখি করেন। পিএইচডি ফেলো]।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।