সম্পাদকীয়:
মাতৃভাষার গৌরব ও স্মৃতিবিজড়িত ফেব্রুয়ারি মাস। মহান স্বাধীনতার স্মৃতিবিজড়িত মার্চ মাস ও রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর চূড়ান্ত বিজয়ের ডিসেম্বর মাস। ফেব্রুয়ারির পর মার্চ, সবশেষে ডিসেম্বর। এ গর্বের কোনো শেষ নেই। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয় হলো,
গোটা জাতির মূল ঠিকানা ও আশ্রয় এ তিনটি মাসকেও আমরা আলাদা করে কৃতজ্ঞতা,সম্মান ও শ্রদ্ধাপূর্ণ দৃষ্টিতে দেখতে পারি না। বলতে গেলে ফেব্রুয়ারির শুরু থেকেই বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় সংঘটিত ঘটনা নিয়ে প্রকাশিত একের পর এক খবরে আমরা আহত হই। আহ, এই বিশ্ববিদ্যালয়, এই শিক্ষক, এই শিক্ষার্থী (ছাত্ররাজনীতি,ছাত্রনেতা)! ঘটনার বর্ণনা দিয়ে ভাষার মাসে সচেতন মহল কিংবা সাধারণ পাঠকের মনকে আর ভারাক্রান্ত করতে চাই না। ঔপনিবেশিক শাসনাধীন পূর্ববঙ্গবাসীর
অত্যন্ত সাধনার ধন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (স্থাপিত ১৯২১)। সাধারণ বা সামান্য কোনো ব্যাপার নয়, কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার (১৮৫৭) ৬৪ বছর পর অবিভক্ত বৃহত্তর বাংলায় (বাংলাদেশ; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, উড়িষ্যা প্রভৃতি প্রদেশ)উচ্চশিক্ষা দান-গ্রহণের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা। এ যেন এক বিপ্লব। ৬০০ একরের বেশি জায়গার বিস্তৃতি, আচার্য, উপাচার্য,কোষাধ্যক্ষ, অধ্যাপক; উচ্চশিক্ষা, অনার্স, মাস্টার্স, গবেষণা; কনভোকেশন, ডাকসু আরও কত কী! শত বছরের পথপরিক্রমায় খ্যাতিমান অনেক উপাচার্য, শিক্ষক ও কীর্তিমান শিক্ষার্থীর বর্ণনায় ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরব-গরিমা ও কর্মকাণ্ডের অনেক কিছু উঠে এসেছে। এমনই একজন খ্যাতিমান সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু (১৯০৮-১৯৭৪)। ঢাকা
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি সাহিত্যের মেধাবী শিক্ষার্থী হিসাবে কিংবদন্তিতুল্য। ১৯৩০ সালের অনার্স পরীক্ষায় তিনি যে নম্বর পান, আজ অবধি আর কোনো শিক্ষার্থীর পক্ষে তা স্পর্শ করা সম্ভব হয়নি। বুদ্ধদেব বসুর বিখ্যাত ‘আবছায়া’ গল্পে তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি বর্ণনা পাওয়া যায়। ক্স‘‘আই.এ. পাশ ক’রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেদিন ভর্তি হলাম সেদিন মনে ভারি ফুর্তি
হ’লো। বাস রে, কত বড়ো বাড়ি! করিডরের এক প্রান্তে দাঁড়ালে অন্য প্রান্ত ধু-ধু করে। ঘরের পরে ঘর, জমকালো আপিশ, জমজমাট লাইব্রেরি, কমনরুমে ইজিচেয়ার, তাসের টেবিল, পিংপং, দেশ-বিদেশের কত পত্রিকা-সেখানে ইচ্ছেমতো হল্লা, আড্ডা, ধূমপান সবই চলে, কেউ কিছু বলে না। কী যে ভালো লাগলো বলা যায় না। মনে হ’লো এতদিনে মানুষ হলুম, ভদ্রলোক হলুম। এত বড়ো একখানা ব্যাপার-যেখানে ডীন আছে, প্রভোস্ট আছে, স্টুয়ার্ড আছে, আরো কত কী আছে, যেখানে বেলাশেষে আধ মাইল রাস্তা হেঁটে টিউটোরিয়াল ক্লাশ করতে হয়, তারও পরে মাঠে গিয়ে ডন কুস্তি না করলে জরিমানা হয়,
যেখানে আজ নাটক, কাল বক্তৃতা, পরশু গান-বাজনা কিছু-না-কিছু লেগেই আছে, রমনার আধখানা জুড়ে যে-বিদ্যায়তন ছড়ানো, সেখানে আমারও কিছু অংশ আছে, এ কি কম কথা! অধ্যাপকেরা দেখতে ভালো, ভালো কাপড়চোপড় পরেন, তাদের কথাবার্তার চালই অন্যরকম, সংস্কৃত যিনি পড়ান, তিনিও বিশুদ্ধ ইংরেজি বলেন-ঘণ্টা বাজলে তাঁরা যখন লম্বা করিডর দিয়ে দিগ্বিদিকে ছোটেন, তাঁদের গম্ভীর মুখ আর গর্বিত চলন দেখে মনে হয় বিশ্বজগতের সব দায়িত্বই তাদের কাঁধে ন্যস্ত। এসব দেখে-শুনে আমারও আত্মসম্মান বাড়লো, এ-সংসারে আমিও যে আছি সে-বিষয়ে অতিমাত্রায় সচেতন হয়ে উঠলুম। মন গেলো নিজের চেহারার দিকে, কেশবিন্যাস ও বেশভূষা সম্বন্ধে মনোযোগী হলুম। শার্ট ছেড়ে পাঞ্জাবি ধরলুম, সদ্যোজাত দাড়িগোফের উপর অকারণে ঘন-ঘন ক্ষুর চালিয়ে ছ-মাসের মধ্যেই মুখমন্ডলে এমন শক্ত দইড় গজিয়ে তুললুম যে আজ পর্যন্ত কামাতে বসে চোখের জলে সেই স্বকর্মের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তখন অবশ্য ভবিষ্যতের ভাবনা মনে ছিল না, বালকত্বের খোলশ ছেড়ে খুব চটপট যুবাবয়সের মূর্তি ধারণ করাই ছিল প্রধান লক্ষ্য।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।