নিউজ ডেস্ক: মিতসুকো তোতোরি বিমানবালা হিসেবে তাঁর চাকরিজীবন শুরু করেছিলেন। গত জানুয়ারিতে তাঁকে যখন জাপান এয়ারলাইনসের নতুন প্রধান ঘোষণা করা হয়েছিল, তখন জাপানের করপোরেট খাতে বেশ আলোচনার জন্ম দিয়েছিল। বলা যায়, জাপানের করপোরেট জগতে বেশ বড় ধরনের ঝাঁকুনি দিয়েছিল এই ঘটনা।
মিতসুকো কেবল জাপানের এই উড়োজাহাজ প্রতিষ্ঠানের প্রথম নারী প্রেসিডেন্ট নন, বরং নারী বিমানবালা হিসেবেও তিনি এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম কাজ শুরু করেছিলেন।
ওই সময় জাপানের গণমাধ্যমে মিতসুকোকে নিয়ে নানা শিরোনাম করা হয়েছিল। যেমন—‘প্রথম নারী’, ‘প্রথম সাবেক বিমানবালা’, ‘অস্বাভাবিক’, ‘কোনো উপায় নেই!’ ইত্যাদি।
একটি ওয়েবসাইট তো মিতসুকোকে ‘অস্বাভাবিক এক অণু’ বা ‘একটি পরিবর্তন’ বলে বর্ণনা করেছে। ওই ওয়েবসাইট তাঁর জাপান এয়ার সিস্টেমে (জেএএস) কাজ করার কথাও উল্লেখ করেছে। খুবই ছোট এই উড়োজাহাজ কোম্পানিকে দুই দশক আগে জেএএল কিনে নিয়েছিল।
মিতসুকো হেসে বিবিসিকে বললেন, ‘আমি অস্বাভাবিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু জানি না।’
সংক্ষেপে বলতে গেলে, মিতসুকো ব্যবসায়ীদের অভিজাত দলের কোনো মানুষ নন, যাঁরা প্রথাগতভাবে নিজেদের ক্যারিয়ার শুরু করেন বড় কোনো পদে।
জাপান এয়ারলাইনসের শীর্ষ পদে যে ১০ জন দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁদের ৭ জনই দেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। কিন্তু মিতসুকো পড়ালেখা করেছেন খুবই সাধারণ একটি কলেজে।
মিতসুকো এই পদে যোগ দেওয়ার মাধ্যমে জাপানের যে মাত্র ১ শতাংশ প্রতিষ্ঠান নারীর নেতৃত্বে পরিচালিত হচ্ছে, সেই তালিকায় যোগ দিল জেএএল।
মিতসুকো বলছিলেন, ‘এমন পদে আমি নিজেকে প্রথম নারী মনে করি না বা প্রথম সাবেক বিমানবালা এমন পদে এসেছেন—সেটাও মনে করি না। আমি একজন ব্যক্তি হিসেবে কাজ করতে চেয়েছি। সুতরাং আমি এভাবে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারব—এমনটা কখনো প্রত্যাশা করিনি।’
জেএএলের এই নারী প্রেসিডেন্ট আরও বলেন, ‘তবে আমি উপলব্ধি করি, সাধারণ মানুষ বা আমার সহকর্মীরা আমাকে নিয়ে এমনটা ভাবে না।’
মিতসুকোর নিয়োগের আগে টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরে অবতরণের সময় জাপানের এই প্রতিষ্ঠানের একটি উড়োজাহাজের সঙ্গে উপকূল রক্ষী বাহিনীর একটি ছোট্ট উড়োজাহাজের সংঘর্ষ হয়েছিল। তবে উড়োজাহাজ থেকে সব যাত্রীকে নিরাপদে বের করতে বিমানবালাদের ভূমিকা ছিল প্রশংসনীয়। ওই ঘটনার দুই সপ্তাহ পর তিনি জেএএলের প্রধান হিসেবে নিয়োগ পান।
ওই ঘটনায় উপকূল রক্ষী বাহিনীর উড়োজাহাজের ছয় আরোহীর পাঁচজনই নিহত হয়েছিলেন। ক্যাপ্টেন গুরুতর আহত হয়েছিলেন। তবে সংঘর্ষের কয়েক মিনিটের মধ্যে জেএএলের উড়োজাহাজের ৩৭৯ যাত্রীর সবাই নিরাপদে বেরিয়ে আসেন।
এরপরই জেএএলের বিমানবালাদের কঠোর প্রশিক্ষণের বিষয়টি সামনে চলে আসে। একজন সাবেক বিমানবালা হিসেবে মিতসুকো বিমান চলাচলের প্রাথমিক নিরাপত্তার গুরুত্বের বিষয়ে ওয়াকিবহাল ছিলেন।
১৯৮৫ সালে মিতসুকো বিমানবালা হিসেবে যোগ দেওয়ার চার মাস পর জাপান এয়ারলাইনসের একটি উড়োজাহাজ মাউন্ট ওসুতাকায় ভয়াবহ দুর্ঘটনার কবলে পড়ে। ওই দুর্ঘটনায় ৫২০ ব্যক্তি নিহত হয়েছিলেন।
মিতসুকো বলেন, ‘জেএএলের প্রত্যেক কর্মীকে মাউন্ট ওসুতাকায় ওঠার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে যাঁরা জানেন, তাঁদের সঙ্গে কর্মীদের কথা বলার ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছিল।’
এই নারী প্রধান আরও বলছিলেন, ‘আমাদের নিরাপত্তা উন্নয়ন কেন্দ্রে ওই দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্ত উড়োজাহাজের ধ্বংসাবশেষ প্রদর্শনীর জন্য রেখেছি। শুধু বই পড়ে নয়, যাতে কর্মীরা ওই দুর্ঘটনা সম্পর্কে হাতে–কলমে সবকিছু জানতে পারেন, শিক্ষা নিতে পারেন।
জেএএলের শীর্ষ পদে মিতসুকোর নিয়োগ বিস্ময়কর ঘটনা বটে। আরেকটা বিষয়ও কম বিস্ময়ের নয়। ২০১০ সালে জেএএল দেউলিয়া হয়ে গিয়েছিল প্রায়, যাকে জাপানের করপোরেট খাতে বিরাট এক ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছিল। তবে সেই অবস্থা থেকে প্রতিষ্ঠানটি দ্রুতি বেরিয়ে এসেছে।
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় জেএএল আকাশে উড্ডয়ন অব্যাহত রাখতে পেরেছে। এরপর তারা প্রতিষ্ঠান ব্যবস্থাপনায় আমূল পরিবর্তন এনেছে।
জাপান সরকার এক দশক ধরে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদে নারীদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করে আসছে।
সরকার এখন চাচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বড় বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে যাতে অন্তত এক–তৃতীয়াংশ নারী নেতৃত্ব থাকে। অবশ্য এই লক্ষ্য অর্জনে ২০২০ সময়সীমা থাকলেও ওই সময়ে লক্ষ্য অর্জনে সরকার ব্যর্থ হয়।
মিতসুকো বলেন, ‘এটা শুধু করপোরেট নেতৃত্বের মানসিকতার বিষয় নয়, বরং ব্যবস্থাপক পদে আসার বিষয়ে নারীদের মধ্যেও আস্থা থাকতে হবে।’
জেএএলের প্রধান বলেন, ‘আমি আশা করি, জেএএলে আমাকে শীর্ষ পদে নিয়োগ দেওয়ার বিষয়টি অন্য নারীদের উৎসাহিত করবে।’
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।