সম্পাদকীয়:
মানবাধিকার সংস্কৃতির অপর নাম বৈষম্যহীন; সবার অধিকার ও মর্যাদায় বিশ্বাসী জীবনবোধ। মহাত্মা গান্ধী বলেছেন, একটি জাতি কতটা সভ্য, তা বোঝার উপায় সে জাতি বা দেশের সংখ্যালঘুদের অবস্থা কেমন, তা পরখ করে দেখা। অধিকার ভোগের ক্ষেত্রে তারা কতটা সংখ্যাগুরুর নিকটবর্তী, সেই হিসাবটা করা। ৫ আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের মূল কথাই ছিল বৈষম্যবিহীন সমাজ গড়ে তোলা। সম্ভবত তারই পরিপ্রেক্ষিতে এ বছর দুর্গাপূজা শান্তিপূর্ণভাবে পালনের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে সার্বিক নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। এটা নিঃসন্দেহে সন্তোষজনক এবং সাধুবাদ পাওয়ার দাবি রাখে। তা সত্ত্বেও এবার দুর্গাপূজার উৎসব আমেজে কিছুটা ভাটা পড়েছে বলে মনে করা অমূলক নয়।
৫ আগস্টের পর সাম্প্রদায়িক সহিংসতার যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলা হয়েছে, হামলাগুলোর কারণ যতটা ভুক্তভোগীর ধর্মীয় পরিচয়, তার চেয়ে বেশি আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ঘনিষ্ঠতা। এমনকি সরকারি মহল থেকেও একই কথা বলা হয়েছে, যা ভুক্তভোগীর ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করতে পারে। বিগত সরকারের আমলে যারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সমাজে বৈষম্য বাড়িয়ে তুলেছিল, তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে আইনের আওতায় আনা হোক– এটা সবাই চায়। কিন্তু আইনের শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে উপেক্ষা করে যে ঢালাও হামলা, মামলা ও গ্রেপ্তার চলছে, তাতে গণঅভ্যুত্থানের মূলমন্ত্রকেই অসম্মানিত করা হচ্ছে। বলা হয়েছিল, ‘নতুন বাংলাদেশে’ রাজনৈতিক পরিচয়, জাতি ও ধর্মগত ভিন্নতার কারণে কেউ বৈষম্যের শিকার হবে না। ক্ষমতার পালাবদলে সহিংসতার যে অপসংস্কৃতি এর আগে চালু ছিল, তা থেকে মুক্তি পাবে সব জনগোষ্ঠী।
আমরা কেউ কি চিন্তা করেছি, যেসব সনাতন ধর্মাবলম্বীর বাড়িতে হামলা হচ্ছে, সেসব বাড়িতে রয়েছে মা-বাবা, ছোট শিশু, কিশোর-কিশোরী, তরুণ-তরুণী, মাসি-পিসি, অসুস্থ ব্যক্তি, বৃদ্ধ ঠাকুরদা-ঠাকুরমা বা কোনো বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন ব্যক্তি; রয়েছে পারিবারিক উপাসনালয়। এই হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনার নেতিবাচক প্রভাব শুধু সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর পড়েনি; সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ভীত-সন্ত্রস্ত ও আতঙ্কগ্রস্ত করে তুলেছে, যা মানবাধিকারের চরম লঙ্ঘন। এই ভয়, উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা সংখ্যা দিয়ে পরিমাপযোগ্য নয়। মানবাধিকারকে সাধারণভাবে বুঝতে হলে বলা হয়, যে কোনো ধরনের ভয় থেকে মুক্ত থাকাই মানবাধিকার।
সম্প্রতি সাতক্ষীরায় সলিডারিটি ভিজিটে যাওয়ার সুবাদে জানতে পারি, সাতক্ষীরা জেলা কেন্দ্রীয় মন্দির এ বছর ২৩৩ বছর পূর্ণ করেছে। কেন্দ্রীয় মন্দির কমিটি দিবসটি উদযাপন উপলক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজায় ২৩৩টি প্রতিমা গড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মৃৎশিল্পীরা ১৩১টি প্রতিমা গড়েছিলেনও। কিন্তু ৫ আগস্টের পর তারা আর প্রতিমা গড়ার সাহস পাননি। পারেননি ২৩৩ জন ঠাকুরের আগমনের কাহিনি অবলম্বন করে পূজামণ্ডপ সাজাতে।
বহু স্থানে পূজামণ্ডপে ভক্ত-দর্শনার্থীর আগের মতো উপচে পড়া ভিড় ছিল না। ছিল আলোকসজ্জার ঘাটতি। আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে বেড়ানো, অলংকারে সজ্জিত হওয়ার প্রবল ইচ্ছা এবং পছন্দমতো শাড়ি ও টিপ পরা নিয়ে সংশয় ছিল। যে টিপ তাদের সংস্কৃতির অংশ, সে টিপ পরতেও দু’বার চিন্তা করতে হচ্ছে। হয়তো কেউ তাদের সরাসরি টিপ পরতে বারণ করেনি। কিন্তু টিপ নিয়ে, শাড়ি নিয়ে এমন বয়ান তৈরি হয়েছে যে, অনেকে আত্মসংযমের পথ বেছে নিয়েছেন।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।