ডেস্ক রিপোর্ট:
একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলার মামলায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত তারেক রহমান ও মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ সব আসামিকে খালাস দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতের রায়কেও বাতিল ঘোষণা করেছেন আদালত। তবে ২০০৮ সাল থেকে বহুল আলোচিত এই মামলায় সব আসামির খালাসের পেছনে উঠে এসেছে কিছু পর্যবেক্ষণ।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেছেন, এ মামলায় ২০১১ সালে আসামি মুফতি হান্নানের জবানবন্দির ভিত্তিতে সম্পূরক চার্জশিট দেওয়া হয়। ওই চার্জশিটের ভিত্তিতে বিচারিক আদালত বিচার করেন, যা আইনগতভাবে গ্রহণযোগ্য ছিল না। এজন্য বিচারিক আদালতের রায়ও বেআইনি ও অবৈধ।’
‘এ ধরনের মামলায় পরস্পর কেউ দেখেছেন, কেউ স্বচক্ষে দেখেছেন, এই মর্মে কোনও এভিডেন্স নেই। যাদের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে, তাদের টর্চার করে জবানবন্দি নেওয়া হয়েছে’ বলেও পর্যবেক্ষণে উল্লেখ করেছেন উচ্চ আদালত।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আরও বলা হয়েছে, ‘মুফতি হান্নানের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির কোনও এভিডেনশিয়াল মূল্য নেই। এটি জোর করে নেওয়া হয়েছিল এবং সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে যথাযথভাবে যাচাই করা হয়নি।’
তাই পর্যবেক্ষণমূলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় সব আসামিকে খালাসের রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আওয়ামী লীগের সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাটি চালানো হয়। অল্পের জন্য ওই হামলা থেকে প্রাণে বেঁচে যান আওয়ামী লীগ সভাপতি ও তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা। তবে হামলায় আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক, সাবেক রাষ্ট্রপতি (প্রয়াত) জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভী রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন। আহত হন দলের তিন শতাধিক নেতাকর্মী।
ঘটনার পরদিন মতিঝিল থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) ফারুক আহমেদ বাদী হয়ে মামলা করেন। তদন্ত শেষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ২০০৮ সালের ১১ জুন দেওয়া অভিযোগপত্রে বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টু, তার ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন ও হুজি নেতা মুফতি আব্দুল হান্নানসহ ২২ জনকে আসামি করা হয়। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পর অধিকতর তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।
জানা গেছে, দুই বছর তদন্তের পর ২০১১ সালের ৩ জুলাই ৩০ জনকে আসামি করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। এর ফলে এ মামলায় মোট আসামির সংখ্যা হয় ৫২। মোট ৫২ আসামির মধ্যে আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও মুফতি হান্নান এবং তার সহযোগী শাহেদুল ইসলাম বিপুলের মৃত্যুদণ্ড অন্য মামলায় কার্যকর হয়। তিনজনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হওয়ায় এ মামলার আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৪৯ জনে। এ ৪৯ জনের মধ্যে রায় দেওয়ার সময় ৩১ জন কারাগারে ছিলেন। পলাতক ছিলেন বাকি ১৮ জন। তারা হলেন— তারেক রহমান, হারিছ চৌধুরী, কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদ, এটিএম আমিন, সাইফুল ইসলাম জোয়ার্দার, খান সাঈদ হাসান, ওবায়দুর রহমান, মুফতি শফিকুর রহমান, মুফতি আবদুল হাই, রাতুল বাবু, মোহাম্মদ হানিফ, আবদুল মালেক, শওকত ওসমান, মাওলানা তাজউদ্দিন, ইকবাল হোসেন, মাওলানা আবু বকর, খলিলুর রহমান ও জাহাঙ্গীর আলম।
২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বিচারিক আদালত সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর ও বিএনপি নেতা আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনের মৃত্যুদণ্ড দেন। একই সঙ্গে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান (বর্তমানে ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান) তারেক রহমানসহ ১৯ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয় অপর ১১ আসামিকে। পরে ওই বছরের ২৭ নভেম্বর মামলার বিচারিক আদালতের রায় প্রয়োজনীয় নথিসহ হাইকোর্টের ডেথ রেফারেন্স শাখায় পৌঁছে। পাশাপাশি কারাবন্দি আসামিরা আপিল করেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে এ মামলার আপিল শুনানি বিচারপতি সহিদুল করিমের নেতৃত্বাধীন বেঞ্চে শুরু হয়। এর মধ্যে ওই বেঞ্চ পুনর্গঠন হয়। এ কারণে নতুন বেঞ্চে আবার মামলাটির শুনানি শুরু হয়।
এদিকে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার পরিবর্তনের পর চার কার্যদিবস মামলাটির শুনানি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় পূর্বনির্ধারিত দিন অনুসারে রবিবার (১ ডিসেম্বর) মামলার ডেথ রেফারেন্স ও আপিলের ওপর রায় ঘোষণা করলেন বিচারপতি এ কে এম আসাদুজ্জামান ও বিচারপতি সৈয়দ এনায়েত হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ।
রায়ের প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির আইনজীবী জয়নুল আবেদীন বলেন, আওয়ামী লীগ সেদিন (২১ আগস্ট) স্থান পরিবর্তন করে জনসভা করেছিল। সরকারকে (তৎকালীন বিএনপি সরকার) কিছু না জানিয়ে এই জনসভা করেছিল। এটা ছিল তার (তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনা) সরকারি দলকে বেকায়দায় ফেলার উদ্দেশ্যে এই কাজটি করেছিলেন। সেজন্য যে গ্রেনেড হামলা হয়েছিল, আমাদের বিশ্বাস রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিকল্পিতভাবে এই গ্রেনেড হামলা ঘটানো হয়েছিল। মামলায় তারেক রহমানের নাম উল্লেখ ছিল না। কিন্তু সম্পূরক চার্জশিট দিয়ে তারেক রহমানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। মামলায় চাক্ষুস সাক্ষি ছিল না। আইনে আছে, চাক্ষুস সাক্ষী ছাড়া মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার বিধান নেই। তাই আদালত মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো কোনও এভিডেন্স পায়নি, তাই মামলার সব আসামিদের খালাস দেওয়া হয়েছে।
আসামিপক্ষের আরেক আইনজীবী মোহাম্মদ শিশির মনির বলেন, ‘একইসঙ্গে মুফতি হান্নান দুটি স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। শুনানিকালে আমরা বলেছিলাম, ৪০০ বছরের ইতিহাসে ভারতীয় উপমহাদেশে দ্বিতীয় জবানবন্দির ওপর ভিত্তি করে কাউকে সাজা দেওয়ার নজির নেই। আজ আদালত বললেন, ‘দ্বিতীয় জবানবন্দি তিনি যেটি করেছিলেন, সেটিও পরে তিনি প্রত্যাহার করেন। এজন্য এ জবানবন্দির কোনও আইনগত ভিত্তি নেই। এর ফলে হাইকোর্ট বিচারিক আদালতের রায় বাতিল করেন।’
শিশির মনির আরও বলেন, ‘বিচারিক আদালতের রায়ে ৪৯ জনকে সাজা দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১৯ জনকে যাবজ্জীবন এবং বাকিদের বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু সবার আপিল মঞ্জুর করেছেন হাইকোর্ট। রুল যথাযথ ঘোষণা করেছেন। এ জন্য সবাইকে মামলা থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।