টাকাপয়সা বা মুদ্রা শুধু প্রদর্শনীর জন্য কেউ অকাতরে বিলিয়ে দিলে কপাল কুঁচকে উঠতেই পারে। তবে এই কাজই করছেন টাকা জাদুঘর ডোনার ক্লাবের সদস্যসহ অন্য সংগ্রাহকেরা। তাঁরা টাকাপয়সা, বিভিন্ন দেশের মুদ্রা, ব্যাংকনোট দান করছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের টাকা জাদুঘরে।
বাংলাদেশে আনুমানিকভাবে ডাকটিকিট, গ্রামোফোন, দেশলাই, মুদ্রা বা কয়েনসহ সব ধরনের সংগ্রাহকের সংখ্যা ৪ থেকে ৫ হাজার। এর মধ্যে মুদ্রা সংগ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। মুদ্রা সংগ্রাহকদের সংগঠন নিউমেসম্যাটিক কালেক্টর অব বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশ নিউমিসম্যাটিক কালেক্টর সোসাইটির সদস্যসংখ্যা সারা দেশে প্রায় ৬০০।
২০১৩ সালের ৫ অক্টোবর কয়েকজন মুদ্রা সংগ্রাহক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সহায়তায় রাজধানীর মিরপুর ২ নম্বরে বাংলাদেশ ব্যাংক ট্রেনিং একাডেমির দ্বিতীয় তালায় টাকা জাদুঘরের উদ্বোধন করা হয়। তখন কয়েকজন মুদ্রা সংগ্রাহক এই টাকা জাদুঘরের জন্য তাঁদের সংগ্রহে থাকা মুদ্রা উপহার দেন। জাদুঘর প্রতিষ্ঠার তিন মাস পর টাকা জাদুঘর ডোনার ক্লাবের জন্ম। এ ক্লাবের ১১ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি আছে। বর্তমানে সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন মোহাম্মদ আবুল কাশেম। এ পর্যন্ত ১১০ জন ডোনার তাঁদের সংগ্রহ থেকে জাদুঘরে মুদ্রা বা ব্যাংকনোটসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন জিনিস উপহার দিয়ে উপহারদাতা হিসেবে নাম লিখিয়েছেন।
টাকা জাদুঘর ডোনার ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ রশিদ আলম, ‘টাকা জাদুঘরের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক হলো ভালোবাসা লেনদেনের। বড় কথা হলো, আগে আমার শখের জমানো মুদ্রা শুধু আমি বা আমার আত্মীয়রা দেখতে পেত, জাদুঘরে দেওয়ার পর তা দেখছে অসংখ্য দর্শনার্থী। মুদ্রা হলো জীবন্ত ইতিহাস, আর এর মধ্য দিয়ে আমরা শিক্ষার্থীদের বিশ্বের ইতিহাসের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছি।’
গত বছর ৫ অক্টোবর টাকা জাদুঘরের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ছিল। এই উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ডোনার ক্লাব ১৯৭৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাজারে ছাড়া ঢেঁকির ছবি-সংবলিত এক টাকার নোটের প্রচারপত্র বিতরণ করে। প্রচারপত্রে এক টাকার নোটের পুরো ইতিহাস উল্লেখ করা হয়েছে।
শুধু বিশেষ দিনেই নয়, প্রতি শনিবার নিয়মিত রশিদ আলম হাজির হন টাকা জাদুঘরে। কিছু না কিছু উপহার দেন জাদুঘর দেখতে আসা শিক্ষার্থীদের। বললেন, ‘মুদ্রা হাতে পেয়ে শিক্ষার্থীরা খুশি হয়, মুদ্রা সম্পর্কে তাদের জানার আগ্রহ আরও বাড়ে।’
গত ১৩ জানুয়ারি টাকা জাদুঘরে নতুন উপহারদাতা হিসেবে নাম লেখায় নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী ইউসুফ রহমান খান আকিব। সে যুক্তরাষ্ট্রের ১ সেন্টের নমুনা ধাতবমুদ্রা উপহার দেয়। তার নিজের সংগ্রহে আছে ৭৮টি দেশের ব্যাংক নোট এবং ৪২টি দেশের কয়েন।
টাকা জাদুঘরের আরেক সংগ্রাহক এবং উপহারদাতার কথাও জানা গেল। তিনি হলেন জাতীয় ক্রিকেট দলের আম্পায়ার শরফুদুল্লাহ সৈকত। তিনি বাংলাদেশ ব্যাংক নোট সংগ্রাহক। এই আম্পায়ার যখন যে দেশে যান, সঙ্গে থাকে ব্যাংক নোট। বিদেশি বন্ধুদের সঙ্গে তা বিনিময় করেন। সৈয়দ রশিদ আলমের সংগ্রহে আছে ২৬৪টি দেশের ব্যাংক নোট এবং ধাতব মুদ্রা। তিনি টাকা জাদুঘরে যেসব মুদ্রা, ব্যাংকনোট ও মুদ্রা-সংক্রান্ত বই দিয়েছেন তা একটি কাচের বাক্সে প্রদর্শিত হচ্ছে।
হোসেন চৌধুরী হতে চান সবাই
একাধিক মুদ্রা সংগ্রাহকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, তাঁরা একেকজন ‘হোসেন চৌধুরী’ হতে চান। টাকা জাদুঘরে হোসেন চৌধুরীর ছবি ও তাঁর সংগ্রহের বর্ণনা রয়েছে। ১৯২২ সালে হোসেন চৌধুরীর জন্ম। তিনি ১৯৪০ সালে ফায়ার সার্ভিসে কর্মজীবন শুরু করেন।
টাকা জাদুঘরে গেলে দেখা মিলবে এমন ধাতব ও কাগুজে মুদ্রার। ছবি: খালেদ সরকার১৯২৮ সাল থেকে তিনি মুদ্রা ও অন্যান্য
শৌখিন দ্রব্য সংগ্রহ করা শুরু করেন। ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত নিউমিসম্যাটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৪ সালে তিনি টাকা
জাদুঘরে ১ হাজার ১৮০টি স্বর্ণ, রৌপ্য, তাম্র ও অন্যান্য ধাতব মুদ্রা এবং ১৭৫টি কাগুজে মুদ্রা উপহার দেন।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কারেন্সি ম্যানেজমেন্ট বিভাগের উপমহাব্যবস্থাপক রাজেন্দ্র লাল তালুকদার বলেন, ‘ডোনার ক্লাব নিজ উদ্যোগে টাকা জাদুঘরের প্রসারে প্রচার চালাচ্ছে। জাদুঘর থেকে স্মারক মুদ্রা বিক্রি করা হয়, সংগ্রাহকেরাই মূলত তা কেনেন।’
শখের টানেই মুদ্রা সংগ্রহ করে সংগ্রাহকেরা। আর সেগুলো জাদুঘরে দিয়ে ইতিহাস জানাতে চান পরের প্রজন্মকে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।