জেলিসা যখন পৃথিবীতে এসেছিল তখন চিকিৎসকরা বলেছিলেন, তার জীবনটা আর পাঁচটা ছেলে-মেয়ের মতো হবে না। এমন কথা বলার কারণও ছিল।
জন্মের পরই দেখা যাচ্ছিল, তার পায়ে উরুর পরই রয়েছে পায়ের পাতা। মাঝখানের হাঁটু থেকে গোড়ালির অংশটা নেই। হাতেও কনুই থেকে কব্জির অংশটা নেই।
শুধু চিকিৎসকদের কথায় নয়। সন্তানকে দেখেও ভেঙে পড়েছিলেন জেলিসার মা ডেবরা। যেমনটা হয় প্রতিবন্ধী সন্তানের জন্ম দেয়া যে কোনো মায়ের ক্ষেত্রেই।
তবে আজকের ৩০ বছরের জেলিসা অস্টিন প্রমাণ করেছেন, সব প্রতিবন্ধকতাই হারিয়ে দেওয়া যায় আত্মবিশ্বাস দিয়ে। সেদিনের ভেঙে পড়া মায়ের কাছে আজ আর জেলিসা কোনো ব্যর্থতা নন, জেলিসা তার গর্ব।
জেলিসার মা ডেবরা সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, ‘আমি ভেবেছিলাম ও খুবই বড় বড় পা নিয়ে জন্মাবে। ও যেভাবে লাথি মারত আমার পেটের ভিতরে ‘
কিন্তু মায়ের আশা পূরণ হয়নি। পরিবর্তে জেলিসার জন্মের পরে ডেবরাকে গ্রাস করেছিল একরাশ হতাশা।
কিন্তু মায়ের হতাশা জেলিসা বুঝতেই পারেনি। সে নিজেই দিব্যি নিজের মতো লড়াইয়ের উপায় বের করেছিল। যে বয়সে শিশুদের মা ছাড়া এক পা চলে না, সেই বয়স থেকে জেলিসা নিজের কাজ নিজেই করে নিত। তার মতো করেই।
তার মা-বাবা অবশ্য হাল ছাড়েননি। একের পর এক ডাক্তার দেখিয়েছেন তারা। কিন্তু ডাক্তাররা প্রতিবন্ধকতার নির্দিষ্ট কারণ জানাতে পারেননি। শুধু বলেছেন, জেলিসা সাধারণ জীবনযাপন করতে পারবে না কোনো দিন।
পা-হাত ছাড়াই তিন বছর বয়সে জেলিসা ভর্তি হলো স্কুলে। আশ্চর্যের ও সৌভাগ্যের কথা, জেলিসার স্কুল জীবন খুবই আনন্দের ছিল। সবার ভালোবাসা পেয়েছিল সে। একদিনের জন্যও স্কুলে কোনো কটূক্তি শুনতে হয়নি তাকে।
জেলিসা সেই দিনগুলোর কথা জানাতে গিয়ে বলেছেন, আমায় পুরো স্কুল ভালোবাসত। সবাই বলতো, আমি নাকি পুতুল-পুতুল ছিলাম।
কিন্তু স্কুল আর স্কুলের বাইরের পরিবেশ এক ছিল না। রাস্তাঘাটে জেলিসাকে তার উচ্চতা আর প্রতিবন্ধকতার জন্য লাঞ্ছনার মুখোমুখি হতে হয়েছে বারবারই। এই লাঞ্ছনাই বাড়িয়েছে জেলিসার জেদ। কোনো কিছুই দমাতে পারেনি তাকে। সেই জেদেই আজ জেলিসা একজন সফল ব্যবসায়ী।
আর পাঁচটা মেয়ের মতোই জেলিসার জীবনে এসেছে প্রেমও। তার প্রেমিক জোনাথন শর্টারের সঙ্গে প্রায় ১৩ বছর আগে, এক বন্ধুর বাড়িতে প্রথম দেখা। পরিচয়ের পরে বন্ধুত্ব এবং তার পরে প্রেম এসেছে নিয়ম মেনেই। তবে প্রেম নিবেদন করেছিলেন জেলিসা নিজেই।
জোনাথন বলেন, জেলিসা আমায় বলেছিল, ও আমায় ভালোবাসে। আমি প্রথমে চুপ করে ছিলাম। জেলিসা অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল। ও ভেবেছিল, আমি ওকে ফিরিয়ে দেব। ভেবেছিল, আমি ঘর থেকে বেরিয়ে যাব। আর ফিরব না ওর জীবনে। চোখ ভরেছিল জলে। ও হাত দিয়ে মুখ ঢাকতে যাচ্ছিল, কিন্তু আমি ওকে জড়িয়ে ধরেছিলাম সঙ্গে সঙ্গে। হাউ মাউ করে কেঁদে ফেলেছিল জেলিসা।
এখন টেক্সাসে সাজানো গোছানো অ্যাপার্টমেন্টে থাকেন জেলিসা-জোনাথন। জোনাথন জানিয়েছেন, জেলিসা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক একজন মানুষ। সে পায়ের অংশ দিয়েই সব কাজ করে। দাঁত মাজা থেকে ই-মেইল করা, সব কিছুতেই স্বচ্ছন্দ জেলিসা। তবে জোনাথন প্রায়ই জেলিসাকে খাইয়ে দেন আদর করে। উঁচু তাক থেকে জিনিসপত্র পেড়ে দেন, পাঁচজন সঙ্গীর মতোই। গাড়িতে উঠতেও সাহায্য করেন। ব্যাস ওইটুকুই।
জোনাথনের দাবি, এর বেশি সাহায্য করতে গেলে নাকি জেলিসার ভ্রু কুঁচকে যায়। জোনাথন বলেছেন, ওর হাত বা পা নেই অথবা ও যে ছোট্ট, এটা আমার কাছে কোনো ব্যাপার নয়। এই ক্ষুদ্র জিনিসগুলো আমাদের ভালোবাসায় কোনো দিন অন্তরায় হয়নি, আর হবেও না। আমি ওকে স্বাভাবিক একজন মানুষ হিসেবেই ভালোবাসি ও ব্যবহার করি। তাতেই আমরা ভালো আছি। সহানুভূতির চেয়ে ভালোবাসা অনেক বড়।
জেলিসা বলছেন, ‘আমি আর জোনাথন খুব ভালো আছি। দারুণ মিল আমাদের। আমি আশাই করিনি আমার জীবনে জোনাথনের মতো প্রেমিক পাব। জোনাথন আমার পাশে আছে ভাবতেই ভালো লাগে।
তবু জোনাথনের মনে সামান্য হলেও অভিযোগ আছে। না জেলিসার প্রতি নয়, সমাজের প্রতি। সাধারণ মানুষ যখন তাদের দুজনকে দেখেন, তখন অনেকে জোনাথনকে বলে, ধন্যবাদ, দারুণ কাজ করেছ। আবার অনেকে জোনাথনকে ‘বোকা’ বলেন।
জেলিসার গভীর চোখের দিকে তাকিয়ে জোনাথন কেবল বলেন, কিন্তু আমি কাউকে বোঝাতে পারি না যে আমি জেলিসার চেয়ে ভালো মন পাইনি। তাই তো আমি ওকে ভালোবেসেছি। জেলিসা একজন সেরা মানুষ ও সেরা বন্ধু। দেখলেই আপনার ওকে ভালোবাসতে ইচ্ছা করবে।
জেলিসা নিজেও সমালোচনাকে কখনও পাত্তা দেননি, এখনও দেন না। তিনি একগাল হেসে বলেন, মাকে বলা হয়েছিল, আমার হাত আর হাঁটু নেই। আমার বৃদ্ধি স্বাভাবিক হবে না। আমি হাঁটতে পারব না। এমনকি আমি বেশি দিন বাঁচব না। এখন আমার বয়স ৩০। দিব্যি বেঁচে আছি, সব কাজ করছি।
জেলিসা তার পোশাকের ব্যবসা দিব্যি সফল ভাবে চালান। তার ক্লায়েন্টদের জন্য সদ্য একটি ওয়েবসাইটও চালু করেছেন তিনি। পা দিয়েই নিয়মিত আপডেট করেন ওয়েবসাইটটি।
তিনি বলেন, পা দিয়ে আমি সব কিছুই প্রায় করতে পারি। আমার ডিকশনারিতে ‘পারব না’ কথাটা নেই। আমি আজ যেখানে, হাত, হাঁটু আর উচ্চতা থাকলেও এখানেই আসতাম। তাই ও সব না থাকার সামান্যতম দুঃখও নেই। এই মুহূর্তে জোনাথনকে বিয়ে করা ছাড়া অন্য কিছু ভাবছি না।
এই বছরের গ্রীষ্মেই জেলিসা আর জোনাথন বিয়ে করবেন বলে ঠিক করেছেন। জেলিসা এখন ব্যস্ত নিজের, অর্থাৎ কনের পোশাক ডিজাইন করতে।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।