বাংলাদেশের যাত্রাটা শুরু হয়েছিল কিছু স্বপ্নের মধ্য দিয়ে। একটা সাম্যের অর্থনীতি হবে, অর্থনৈতিক-সামাজিক এবং স্থানীয় বৈষম্য কম হবে; এমন স্বপ্ন আমরা মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছিলাম। তবে অর্থনৈতিক মুক্তির স্বপ্নই ছিল প্রধান।
একাত্তরে যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন- তাদের অধিকাংশই ছিলেন সাধারণ ঘরের সন্তান। তাদের প্রায় ৭৮ শতাংশ ছিলেন কৃষকের সন্তান। আর বাদবাকীরা মধ্যবিত্ত। যুদ্ধে যাওয়ার সময় তাদের ভাবনায় ছিল- এই পাকিস্তানিরা আমাদের উদ্যোক্তা গড়ে উঠতে দেয়নি। সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যের ঘাঁটি পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রশাসন, মিলিটারি সবকিছুতেই ৮০-৯০ ভাগ পাকিস্তানিরা। বাজেটের বৃহৎ অংশ তারা পেত। ডেভেপলমেন্ট বাজেটেরও বড় অংশ তারাই ব্যবহার করত। ইসলামাবাদে তারা বড় রাজধানী তৈরি করেছে কিন্তু আমাদের দেশে তখন কোনো উন্নয়ন করছে না। যারা বাংলাদেশে ব্যবসা-বাণিজ্য করতে আসতো তারাও পশ্চিম পাকিস্তানী। ইস্পাহানি, আদমজী জুট মিলস এর মালিক ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানী। এখান থেকে একে খান এবং পরবর্তীকালে জহুরুল ইসলাম ছাড়া আর কোনো উদ্যোক্তা গড়ে উঠতে পারেনি। যে কারণে বৈষম্য ছিলো আমাদের মাথাপিছু আয়ে। পাকিস্তান আমলে পশ্চিম পাকিস্তানের মাথাপিছু আয়ের থেকে আমাদের মাথাপিছু আয় প্রায় এক তৃতীয়াংশ কম ছিল। পরবর্তীকালে এটা দুই-তৃতীয়াংশ কমে গেল। এইভাবে যখন বৈষম্য বাড়ছিল তখন বঙ্গবন্ধু ছয় দফা দাবি উত্থাপন করলেন। তিনি বললেন, এটা দুই অর্থনীতির দেশ হয়ে গেছে। এক অর্থনীতির দেশ নেই। দেশের পূবার্শের মানুষের খেয়ে পরে বাঁচার সুযোগ নেই। বৈষম্য দূর করার জন্য তিনি ছয় দফা দিলেন। আমরা তখন প্রচুর পাট উৎপাদন করতাম। পাট বিদেশে বেশি রফতানি হতো। অনেক বৈদেশিক মুদ্রা আসত। অথচ আমরা বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবহার করতে পারতাম না। ব্যবহার করা হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। রাজস্ব বণ্টন, বিদেশি মুদ্রার ব্যবহারসহ নানা বিষয়ে ছয় দফা দাবি উত্থাপন করা হয়। উদ্দেশ্য একটাই বাঙালিকে উন্নত করা।
সমাজ, অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ প্রতিটি সেক্টরে উন্নতি করা। একপর্যায়ে পাকিস্তানীরা এটা বুঝে ফেলল যে, বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা মূলত বাঙালিকে পাকিস্তান থেকে আলাদা করার আন্দোলন। ফলে তাকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার মধ্যে ফেলে দেয়া হলো। পরবর্তীকালে এই দেশের মানুষ পাকিস্তানীদের ষড়যন্ত্রটা বুঝে ফেলল। তখন তারা ব্যাপক আন্দোলন করল। সেই আন্দোলনটা ছিল ফলপ্রসূ। সেই আন্দোলন শুধু বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত-ই করেনি একটি বড় আকাঙ্ক্ষারও জন্ম দিয়েছিল। পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে আমাদের থাকার কোনো সুযোগ নেই। সেই অনূভবের প্রতিফলন সত্তরের নির্বাচনে প্রকাশ্য হলো। সুযোগ পেয়ে সবাই ভোট দিলো বঙ্গবন্ধুর পক্ষে। বঙ্গবন্ধুকে জনগণ নির্বাচিত করলেন। উদ্দেশ্য, এ কথাটিই জানিয়ে দেয়া যে, বঙ্গবন্ধুই আমাদের নেতা। তিনি নিরঙ্কুশভাবে ক্ষমতায় গিয়ে আমাদের ভাগ্য পরিবর্তন করবেন। বিপুল ভোটে নির্বাচিত এই নেতাকে অস্বীকার করে যখন ঢাকায় নির্বাচিত সাংবিধানিক পরিষদের যে সভাটি হওয়ার কথা ছিল সেটি হঠাৎ করেই মার্চের ১ তারিখে বন্ধ করে দিলেন ইয়াহিয়া খান।
তখন বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের সংবিধান তৈরিতে ব্যস্ত ছিলেন। ছয় দফার আলোকে হোটেল পূর্বানীতে সংবিধান তৈরি করছিলেন। তিনি এবং তার সহ-নেতারা ইয়াহিয়ার সিদ্ধান্ত জানার পর প্রথমে সর্বাত্তক ধর্মঘটের ডাক দিলেন তিনি। এরপর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা দিলেন মুক্তির কথা। অর্থনৈতিক মুক্তি, সামাজিক মুক্তি-রাজনৈতিক মুক্তির কথা তিনি বললেন। সেই ঘোষণাকে গেরিলা যুদ্ধের একটা ঘোষণা বলা যেতে পারে। সেদিন তিনি ছোট গল্পের মতো সব কিছুই বললেন আবার কিছুই বললেন না। রাজনৈতিক কবির মতো ঘোষণা দিলেন। মানুষ বুঝতে পারলো এটা স্বাধীনতার ঘোষণা। এবং মানুষ তৈরি হয়ে গেল। একজন সাধারণ মানুষও যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলো স্বতঃস্ফূর্তভাবে। পাশাপশি তিনি অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন। ঐ আন্দোলনের মর্মকথাই ছিল বাঙালির জন্য প্রশাসনিক নির্দেশ আসবে বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে। কার্যত বাঙালিরা তখন স্ব-শাসনের স্বাদ পেয়েছিলেন। এই সময়টাতে ইয়াহিয়া-ভূট্টো গং আলাপ আলোচনার বাহানা কওে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বেশি করে সৈন্য অস্ত্র আনার ব্যবস্থা করেন।
২৫ তারিখে সন্ধ্যেবেলা গণহত্যা শুরু হলো। ২৬ তারিখ প্রথম প্রহরেই বঙ্গবন্ধু ইপিআরের ওয়ারলেসের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন। সেদিন থেকেই পাকিস্তান রাষ্ট্রটি বাঙালিদের লাশের নিচে মারা পড়ে গেল। একদম চাপা পড়ে মরে গেল।
শুরু হলো স্বাধীন বাংলাদেশের শুভযাত্রা। এরপরের ঘটনাতো আমরা সকলেই জানি, মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী আত্মসমর্পণ করল। বাঙালির জয় হলো। তখন বাঙালি দাবি তুলল- বঙ্গবন্ধু ফিরে না আসলে এই স্বাধীনতা পূর্ণ হবে না। তারপর তিনি ফিরে এলেন ১০ জানুয়ারি। এবং ফেরার পথে তিনি ভারতের নয়া দিল্লীর পালাম বিমান বন্দরে নামলেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং রাষ্ট্রপতি বরাহগিরি ভেঙ্কট গিরি তাকে সংবর্ধনা জানালেন।
কিন্তু তিনি একদণ্ডও সেখানে টিকতে চাচ্ছিলেন না। তখন টাইমস অব ইন্ডিয়ার এক সাংবাদিক বঙ্গবন্ধুকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘আপনি ঢাকায় যাওয়ার জন্য এতো অস্থির কেন?’ বঙ্গবন্ধু বললেন ‘ঢাকায় আমার জন্য সবাই অপেক্ষা করছেন। আমি আমার স্বাধীন দেশে ফিরে যেতে চাই। আমি দেশটাকে শান্তির, অগ্রগতির ও সমৃদ্ধির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।
তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শব্দ তিনি সেখানেই উল্লেখ করলেন: শান্তি, অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি। তিনি ঢাকায় বিমানবন্দরে এলেন। লাখ-লাখ মানুষ বঙ্গবন্ধুকে স্বাগত জানাল।
দারুণ আবেগাপ্লুত তিনি। দুচোখে আনন্দাশ্রু তিনি প্রথমেই সরাসরি এলেন রেসকোর্স ময়দানে। পরিবারের কাছে তিনি আগে গেলেন না। এলেন সাধারণ মানুষের কাছে। তিনি বললেন বাংলাদেশকে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হিসেবে গড়ে তুলবেন। তিনি বললেন, ‘আমাদের আছে মাটি ও মানুষ। এই মাটি ও মানুষকে ব্যবহার করে একটি দেশ গড়বো, যে দেশের কোনো বৈষম্য থাকবে না। শ্রমিক-কৃষক-দিন মজুর সকলের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করবো’।
আর সবাইকে বললেন, কাজে নেমে পড়ো। পরের দু’এক দিনের মধ্যেই তিনি সরকার গঠন করলেন। বঙ্গবন্ধু প্রধানন্ত্রী হলেন। তারপর সাড়ে তিন বছর তিনি বেঁচে ছিলেন, এই সময়ের মধ্যে একটি মিনিটও তিনি বিশ্রাম নেননি। সারাক্ষণ পরিশ্রম করেছেন। শুরু থেকেই তিনি সুদূরপ্রসারী অনেক পরিকল্পনা করেছেন। এই রকম সময়ে কী হয়? সাধারণত, খুব ক্ষণস্থায়ী তথা স্বল্পমেয়াদী কাজ হয়। তিনি তা করেননি। একদিকে সমস্ত বন্দর পরিষ্কার করেছেন, মাইন পরিষ্কার করেছেন, রেললাইন সচল করেছেন, রাস্তাঘাটের ব্রিজগুলো পুনঃনির্মাণ করছেন অন্যদিকে সংবিধান লিখেছেন। রচনা করছেন পঞ্চবার্ষীকি পরিকল্পনা। সংবিধানের দ্বিতীয়খণ্ডে রাষ্ট্র পরিচালনার মৌল যে নীতিমালা তিনি যুক্ত করেছেন তাতে খাদ্যের কথা, সুষম উন্নয়নের কথা। সংবিধানের তেরো নম্বর অনুচ্ছেদে সুস্পষ্টভাবে বলা হচ্ছে, বাংলাদেশের অর্থনীতি কেমন হবে। তাতে বলা হয়েছে তিনভাগে এই অর্থনীতি হবে: এক. সরকারি খাত/ দুই. ব্যক্তি খাত/ তিন. সমবায় খাত হবে। এই তিন খাতে দেশের অর্থনীতি পরিচালনা হবে। আরো বললেন, নারী-পুরুষ; গ্রাম-শহর; শ্রেণিতে-শ্রেণিতে কোনো রকম বৈষম্য থাকবে না। পাশাপাশি খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান, স্বাস্থ্য, শিক্ষা পাঁচটি মৌলিক অধিকার তিনি সংবিধানে যুক্ত করলেন। দেশের খ্যাতনামা শিক্ষাবিদ এবং বিজ্ঞানী কুদরত-ই-খুদাকে প্রধান করে কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠন করলেন। বললেন যে, আমাদের ছেলে-মেয়েকে শিক্ষা দিতে হবে, শিক্ষায় হবে কারিগরি শিক্ষা। একজন বিজ্ঞানীকে শিক্ষামন্ত্রী নিযুক্ত করলেন।
জ্ঞানীগুনী অর্থনীতিবিদ, গবেষক, শিক্ষকদের পরিকল্পনা কমিশনে জড়ো করলেন।
আমার অবাক লাগে এই ভেবে যে, ওই রকম একটা টালমাটাল সময়ে সরকার গঠন করার প্রথম দিনই তিনি কি করে পরিকল্পনা কমিশন গঠনের কথা ভাবলেন। অর্থনীতিবিদ প্রফেসর নূরুল ইসলাম স্যারকে কমিশনের প্রধান হিসেবে নিযুক্ত করলেন। বললেন, ‘আপনি আপনার সকল অর্থনীতিবিদ ও দেশের প্রকৌশলীদের নিয়ে বাংলাদেশকে কীভাবে তাড়াতাড়ি উন্নত করবো সেই প্রেসক্রিপশন দেবেন’। কাজ শুরু হল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা চমৎকার পরিকল্পনা। কৃষির উন্নয়ন, শিল্পের উন্নয়ন কীভাবে হবে তা সুন্দও ও সুস্পষ্টভাবে তিনি বলে দিয়েছিলেন।
একটা পর্যায় পর্যন্ত, এই পরিকল্পীত উদ্যোগের ফলে দেশটি অনেকদূর এগিয়ে যায়। আমাদের খাদ্য সংকট ছিল সবচেয়ে বড় সমস্যা। ১৯৭৩ সালে বিরাট বড় বন্যা হলো বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষাবনথা দেখা দিল । আমেরিকানরা আমাদেও খাদ্য সাহায্য দিতে চাইলেন না। আমরা তখন তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছি। সেই রকম এক কঠিন সময়ে তারা আমাদের খাদ্য সাহায্য দেয়নি। এক কোটি শরণার্থীকে তখন দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে। তাদেরকে পুনর্বাসন করতে হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ তখনো গৃহহারা। তাদেরকে সহায়তা দিতে হচ্ছে। আমাদের ৮০ ভাগ মানুষ দারিদ্রসীমার নিচে। তারা দু’বেলা ভাতও খেতে পারে না। এই রকম একটি সময় বঙ্গবন্ধু দায়িত্ব নিয়ে কাজ করছিলেন। এরপর, ১৯৭৪ সালে তিনি পরিস্থিতি খুব শক্তহাতে সামাল দিলেন। বঙ্গবন্ধ তবে মনে মনে খুবই ক্ষুব্ধ। খাদ্যে স্বয়ং সম্পূর্ণ হবার সংকল্প গ্রহণ করলেন। বঙ্গবন্ধু আহ্বান করলেন, ‘এক খণ্ড জমিও পতিত রাখবেন না। যদি পারেন স্কুলের মাঠেও ধান উৎপাদন করেন। বিভিন্ন জয়গা থেকে আমি ভিক্ষে করে খাদ্য আনছি। এটা আর আনতে চাই না। আপনার সকলে সহযোগিতা করেন’। এবং সকলেই সহযোগিতা করলেন। ‘৭৫সালে প্রচুর আমন ধানের উৎপাদন হল।
কিন্তু তিনি সেই ফসল ঘরে তুলতে পারলেন না। শত্রæরা বুঝতে পারলো, আমনের বাম্পার উৎপাদন হলে চালের দাম এবার কমে আসবে। বঙ্গবন্ধুকে মানুষ আরো বেশি পছন্দ করবে। এটা বুঝতে পেরেই ১৫ আগষ্ট বঙ্গবন্ধুকে নৃশংসভাবে আক্রমণ করলো-হত্যা করল। এর মাধ্যমেই অর্থনৈতিক মুক্তির যে পথনকশা তিনি এঁকেছিলেন তা থেকে দেশটাকে একেবারে বিচ্যুত করা হলো।
স্বাধীনতা বিরোধিদের হাতে চলে গেল দেশ। তারা আবার পাকিস্তানের সেই বৈষম্যমূলক অর্থনীতি চালু করার চেষ্টা করল। ধীরে ধীরে দেশ পরিণত হলো। উল্লেখ করা যেতে পারে বঙ্গবন্ধু বাণিজ্যখাতের প্রসারের বিরুদ্ধে ছিলেন না। আবার সাধারণ মানুষের কল্যাণের চেয়ে মুষ্টিমেয় মানুষের কল্যাণে ’৭৫সালের বাজেটে বঙ্গবন্ধু সরকারের অর্থমন্ত্রী বলেছেন ‘ব্যক্তিখাতকে আমরা শুরুতে সুযোগ দেইনি এই কারণে যে, বিদ্ধস্ত অর্থনীতিকে পুনর্গঠন করতে হবে। সেই জন্য আমরা রাষ্ট্রীয় খাতকে প্রাধান্য দিয়েছিলাম। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পশ্চিম পাকিস্তানের সব উদ্যোক্তা এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে। সুতরাং এই উদ্যোক্তাবীহিন রাষ্ট্রে সরকারি চাকরিজীবীদের দায়িত্ব আমাদের নিতে হয়েছিল’। বঙ্গবন্ধু সেই নীতিকেই চিরস্থায়ী নীতি বলেননি। বলেছেন, ‘আমরা এই জায়গা থেকে বের হয়ে আসতে চাই’।
শুরুতে বলা হয়েছিল, ২৫ লাখ টাকার বেশিÍ ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ করা যাবে না। পঁচাত্তরের বাজেটে বিনোয়োগের পরিমাণ তিনি নির্ধারণ করলেন তিন কোটি টাকা। তিনি কিন্তু ব্যাক্তিগত খাত উন্নয়নের দিকে নিচ্ছিলেন। এটা অনেকেই জানেন না পর্যন্ত। সমাজের চাহিদার সঙ্গে মিলিয়েই তিনি ওদিকে যেতেন। পরবর্তীকালে যারা ক্ষমতায় এলেন, তারাও ব্যক্তিখাতকেই প্রাধান্য দেয়া শুরু করলেন। কিন্তু এর শুরুটা যে বঙ্গবন্ধু করে দিয়ে গেছেন সেই স্বীকৃতিটা তাকে কখনো দেয়া হয়নি।
পরবর্তী সময়ে ব্যক্তিখাতকে প্রাধান্য দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য স¤প্রসারণ ও উদ্যোক্তা তৈরি করার চেষ্টা করা হয়েছে। এই চেষ্টাটা বঙ্গবন্ধুই শুরু করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধু ব্যক্তিখাতকে গুরুত্ব দেয়া সত্বেও তিনি সাধারণ মানুষের কল্যাণের কথা বলেছেন। মৌলিক অধিকারগুলোর বিষয়ে তিনি সমানভাবে সচেতন ছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলাদেশ একটা উঁচু হারের প্রবৃদ্ধির দেশ হবে। কিন্তু সেই অর্থনীতির সুফল সবাই পাবে। তার অনুপস্থিতিতে দেশ সে পথে যায়নি। তারপরের ঘটনা সেই রকম । মুষ্টিমেয় মানুষের কাছে, অর্থনীতি চলে গিয়েছিল। প্রায় একুশ বছর এভাবে চলেছে। একুশ বছর পর বঙ্গবন্ধুকন্যা দায়িত্ব নিলেন। এবং নির্বাচিত হয়ে ১৯৯৬ সালে ক্ষমতায় এলেন। এসেই বঙ্গবন্ধু অন্তভ’ক্তিমূলক অর্থনৈতিক মৌলধারাগুলোকে আবার ফেরত আনার চেষ্টা করলেন।
কিন্তু তিনিও বুঝতে পারলেন, শুধু রাষ্ট্রীয়খাতকে প্রাধান্য দিয়ে এই অর্থনীতিকে সামনে নেয়া যাবে না। তিনিও তাই ব্যক্তিখাতকে প্রাধান্য দিলেন। বিশেষ করে সকল ক্ষেত্রেই উদারীকরণ করলেন। এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির অনেকগুলো মুখ খুলে দেন।
কয়েকদিন আগেও একনেকের ভাষণে তিনি একথা বলেছেন যে, ‘‘আমি এসেই অর্থনীতির মুখগুলো খুলে দিলাম। কারণ, আমাদের বেশি-বেশি উদ্যোক্তা তৈরি করতে হবে।’’ সেই কাজগুলোর পাশাপাশি তিনি সমাজের একেবারে নিচের দিকের মানুষের জন্য অল্প করে হলেও সামাজিক ভাতা চালু করেছেন।
বয়ষ্কভাতা বিধবা ভাতা, মুক্তিযোদ্ধা ভাতা, প্রতিবন্দী ভাতা তারই চালু করা সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি।
কৃষিঋণের ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছেন, এমনকি ১৯৯৮ সালে যে বন্যা হলো সেই পরিস্থিতিও কঠিন হাতে মোকাবিলা করেছেন। সারাক্ষণ বন্যাপীড়িত মানুষের সঙ্গে কাজ করেছেন। তখন কেউ কেউ বলেছিল, দুই কোটি মানুষ না খেয়ে মরে যাবে। কিন্তু না খেয়ে মারা যাননি।
বাবার সেই অনুসৃত ইনক্লুসিভ অর্থনীতি বা অন্তর্ভ‚ক্তিম‚লক অর্থনীতি তিনি ফের চালু করলেন। এবং বন্যার পর বর্গাচাষিদের ঋণ দিলেন। কৃষকদেও ঋণের ব্যবস্থা করলেন। এমনকি হেলিকপ্টারে লিফলেট ছড়িয়ে দিয়ে- কৃষিঋণ কোথায় পাওয়া যাবে, কীভাবে পাওয়া যাবে সেসব তিনি জানানোর ব্যবস্থা করলেন। হাটে-বাজারে ছোট ছোট টেবিল-চেয়ারে বসে কৃষিঋণ দেয়া হয়েছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই আমরা ১৯৯৮-এর বন্যা মোকাবিলা করতে সক্ষম হলাম। এর পরের বছর কৃষিতে বাম্পার ফলন হলো। দেশ খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পন্ন হয়ে গেল। ২০০১ সালে নির্বাচনে শেখ হাসিনাকে হারানো হল। এরপর থেকে দেশ আবার উল্টো পথে যেতে শুরু করল। ‘অদ্ভ‚ত এক উটের পিঠে’ চলতে শুরু করলো বাংলাদেশ। পাকিস্তানী অর্থনীতি আবার চালু হল। ২০০৮ সালে বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় এলেন। ক্ষমতায় এসেই তার পুরোনো কাজগুলো শুরু করলেন। এবার তিনি নতুন স্লোগান নিয়ে আসলেন। সেটি হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ। তিনি বললেন যে, ‘প্রযুক্তির ব্যবহার করবো এবংসাধারণ মানুষের হাতে প্রযুক্তি তুলে দেব’। শুরুতে অনেকেই হাসাহাসি করেছে। মানুষ বলেছে ডিজিটাল বাংলাদেশ মানে কী? ডিজিটাল অর্থনীতি কী? এখন আমরা ১০ বছর পর ঠিক বুঝতে পারছি যে ডিজিটাল অর্থনীতি চালু না করলে আজ বাংলাদেশের অর্থনীতির ভেতরে যে সচলতা দেখতে পাচ্ছি সেটা সম্ভব হতো না। ডিজিটাল বাংলাদেশের একটি বড় লক্ষণ হলো, প্রত্যেককেই প্রযুক্তিতে ক্ষমতায়ন করতে হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে মানুষ তার নতুন নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করবে। সেই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। বঙ্গবনধুকন্যা এবার নতুন করে যে ক্ষমতায় এলেন, তখনো তিনি একটি ইশতেহার দিলেন। সেই ইশতেহারেও প্রত্যেকটা খাত সম্পর্কে তিনি কি করতে চান তার ব্যখা দিয়েছেন। সেই ব্যাখ্যার আলোকে যদি আমরা দেশের অর্থনীতি পরিচালনার নীতি গ্রহণ করি তাহলে শেখ হাসিনা যেমন ভাবছেন সেই রকম উন্নত দেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এবারের বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বে যে অর্থনীতি চালু আছে তার একটি বৈশিষ্ট্য হলো একই সঙ্গে উচ্চ প্রবৃদ্ধি এবং তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হতে হবে। প্রবৃদ্ধি নিশ্চয় বাড়াতে হবে। তার একই সঙ্গে সাধারণ মানুষকেও এই প্রক্রিয়ার মধ্যে যুক্ত করতে হবে। তাছাড়া – আমাদের সমাজ, সংস্কৃতি, ঐতিহ্যের সঙ্গে যুক্ত থাকবে। একই সঙ্গে আমরা প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশকে গড়ে তুলবো। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করা হবে অর্থনীতির কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে। এরপর তিনি বললেন, ‘একা করবো না এইসব কাজ। বেসরকারি সেক্টরকে সঙ্গে নেবো, এনজিওকে সঙ্গে নেবো। এমনকি বিদেশিদেরও সঙ্গে নেবো। কোলাবোরেটিভ স্ট্যাটেজি গ্রহণ করব’।
এই যে ত্রিমুখী উদ্যোগ প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেছেন এবং অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। তাকে আরো অর্থবহ করতে হলে গুণমানের বাস্তবায়নের দিকে বেশি নজর দিতে হবে। এই প্রক্রিয়াতে প্রথম যে কাজটি তিনি করেছেন, সেটি হল মেগা কতগুলো প্রকল্প হাতে নিয়েছেন। উদ্দেশ্যই হলো যে, গুণমানের সেবা দেয়া। ব্যবসায়ীকেও একটা সুযোগ দেয়া।
এই যে মেট্রোরেল, কর্ণফুলি ট্যানেল, এমনকি রূপপুর প্রকল্প, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল হচ্ছে সে সবের উদ্দেশ্য হলো- দেশের অবকাঠামোকে নয়া উচ্চতায় নিয়ে যাওয়া। আর এর মাধ্যমেই প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে সাহায্য করা। এবং প্রত্যেক উদ্যোক্তাকে এগিয়ে নেয়া। এই একশোটা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণের যে মেগা পরিকল্পনা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিয়েছেন, আমার প্রস্তাব থাকবে অন্তত ডজনখানিক অঞ্চলের কাজ দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করার। এতে পৃথিবীকে দেখানো যাবে যে- আমরা পারি। তখন বাকিগুলোর চাহিদা বেড়ে যাবে। এই যে, দশ বারোটা জোনের কথা বলছি, এগুলোর কিছু কিছু কিন্তু এই বাস্তবায়ন হয়ে গেছে।
সরকারিগুলো এখনো সম্পন্ন হয়নি। ব্যক্তিখাতের কয়েকটা চালু হয়ে গেছে। যেটা করা দরকার, এই ইকোনমিক জোনগুলোর সঙ্গে একটা বড় ব্যকওয়ার্ড লিঙ্কেজ স্থাপন করতে পারি। এখানে আমি যে পণ্য উৎপাদন করবো সেই পণ্য আমি যেন মংলাতে কিংবা চট্টগ্রাম বন্দরে দ্রæত নিয়ে যেতে পারি। সে জন্য রেল সংযোগ যেমন থাকতে হবে, যেমন রোডের সংযোগ থাকতে হবে, তেমনি নদী পথের সংযোগও থাকতে হবে। এই সংযোগ যদি তৈরি করতে না পারা যায় তাহলে কোন স্থানে একটি সুন্দর অর্থনৈতিক জোন তৈরি করলেও খুব একটা লাভ হবে না। পণ্য আনা নেয়ার সমস্যা দেখা দেবে।
নিঃসন্দেহে পায়রা বন্দর ব্যবসা-বাণিজ্য প্রসাওে বিরাট কাজ করবে। মহেশখালিতে আমরা একটি গভীর সমুদ্র বন্দর করছি, মাতারবাড়িতে। এইখানে জাপানীরা বড় অংকের বিনিয়োগ নিয়ে এসেছে।
অস্বীকার করার উপায় নেইযে সবাইকে নিয়ে কাজ করার একটি ইতিবাচক সংস্কৃতি গড়ে উঠছে। এটা যদি চালু থাকে বাংলাদেশের অর্থনীতি নিশ্চয় এগিয়ে যাবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ওপর থেকে টোন সেট করে দিচ্ছেন, মূল সুর বেঁধে দিচ্ছেন। এখন চ্যালেঞ্জ হলো সেই সুরের আলোকে অর্কেস্ট্রাটা কেমন হবে সেটার জন্য, মঞ্চে আলো ফেলার জন্য দ্বিতীয় কণ্ঠ মেলানোর জন্য, তৃতীয় সারির অনেক নেতাকেই অংশগ্রহণ করতে হবে।
কেউ যন্ত্র সংগীত বাজাবেন। কেউ কণ্ঠ দেবেন। কেউ আলো ফেলবেন। সংশ্লিষ্ট গ্রæপগুলো সেই কাজটি বোঝেন কিনা, সেটিই এখনকার বড় চ্যালেঞ্জ।
সম্প্রতি ইঞ্জিনিয়ারদের অনুষ্ঠানে গিয়ে প্রধামন্ত্রী বলেছেন ‘ আপনারা এমন কোনো প্রকল্প করবেন না যাতে আমাদের নদী-জলাশয় নষ্ট হয়’। এটা কিন্তু একটা মেগা নির্দেশনা। এই বড় নিদের্শনা ভেঙে টুকরো টুকরো করতে হবে। এর ভেতরে থাকা বৃহৎ তাৎপর্য বের করতে হবে। তা বাস্তবায়নে নিজ নিজ জায়গা থেকে সহায়তা করতে হবে। ছোট ছোট পদক্ষেপগুলো ঠিক ঠিক বাস্তবায়ন হচ্ছে কিনা তা দেখতে হবে মন্ত্রীদের। সরকারি কর্মকর্তাদেরও করার আছে অনেক। তাদের মন্ত্রীদেও কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
এখন তো সবকিছু বাস্তবায়ন করা সহজ। ডিএইচএল ট্র্যাকার দিয়ে সহজেই বলা যায়, কোন প্যাকেটটা কোথায় যাচ্ছে। কবে গন্তব্যে পৌঁছবে?।’ তাহলে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে যে ফাইলগুলো মুভ করবে সেটা কেন ট্রাক করতে পারবো না আমরা? । এটা করতে হলে গুণমানের সেবার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা), বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (বেজা) এরা কিন্তু অনেকটাই খোলস ছেড়ে বের হয়ে আসছে। এই মার্চ মাসেই তারা সিদ্ধান্ত দেবেন অন-স্টপ সার্ভিস, অনেকগুলো সার্ভিস এখন বিডা থেকেই পাওয়া যাবে। দশটা জায়গায় যেতে হবে না। আশা করি এই সিদ্ধান্তগুলো সত্যি সত্যি বাস্তবায়ন করা হবে। সবগুলো প্রশাসনের সবগুলো অঙ্গকে আমরা কো-অর্ডিনেট করে একসঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাব তেমনটাই হোক আমাদের প্রতীজ্ঞা। এটা যদি করতে পারি তাহলে কিন্তু বঙ্গবন্ধুকন্যা যে উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাচ্ছেন; সেটা সম্ভব। প্রধানমন্ত্রী তার ‘মাইলস্টোন’ সেট করে ফেলেছেন। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা, প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, এসডিজি পরিকল্পনা, এমনকি ভিশণ ২০৪১, ডেলটা প্ল্যান এগুলোর মাধ্যমে তিনি বলে দিয়েছেন কী কী করতে চান। এখন চ্যালেঞ্জ নিতে হবে তার মন্ত্রীদের এবং প্রশাসনের। কখন, কতদিন লাগবে, কে করবে এখন সেটা ঠিক করবে মন্ত্রী আমলারা। এ কাজগুলো কি একাই তারা করবে, নাকি ব্যক্তিখাতকে সঙ্গে নিয়ে করবেন, এই সিদ্ধান্তগুলো এখন নেয়ার সময় এসে গেছে। এই সিদ্ধান্তগুলো তারা নিশ্চয় নেবেন এবং সব কিছু মিলে একটা উন্নত বাংলাদেশ গড়ার জন্য আমরা সবাই মিলে কাজ করবো। ফলাফল নির্ভও একটা উন্নয়ন প্রক্রিয়ার দিকে আমরা যেতে চাই। বৃক্ষের পরিচয় তার ফলে। এ কথাটি সত্যি প্রমাণ করতে হলে আমাদেও কাজ করে তা দেখাতে হবে। সত্যি, সত্যি বাস্তবায়ন করে আমাদের দেখাতে হবে ‘আমরা পারি এবং আগামীদিনের বাংলাদেশ হবে উন্নত বাংলাদেশ’।
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।