বাংলাদেশকেন্দ্রিক বিদেশী চক্রান্ত - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ৮:৫৮, ১৭ই এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

বাংলাদেশকেন্দ্রিক বিদেশী চক্রান্ত

প্রকাশিত মে ১৯, ২০১৯
বাংলাদেশকেন্দ্রিক বিদেশী চক্রান্ত

এমন একটি সময় ছিল, যখন বাংলাদেশের রাজনীতিবিদেরা সিআইএ’র নাম শুনলে থরথর করে কেঁপে উঠতেন। পরবর্তীতে আইএসআই এবং সাম্প্রতিক কালে র’ সিআইএ’র সেই জায়গা শুধু দখলই করেনি বরং নিত্যনতুন কৌশল, সন্ত্রাস এবং স্বার্থরক্ষার ব্যাপারে নিষ্ঠুরতম আচরণকে পেছনে ফেলে তৈরি করা রেকর্ডের ওপর যেই না তারা সফলতার মাইলস্টোন স্থাপন করতে যাবেন, অমনি চীন দেশীয় গোয়েন্দারা তাদের হটিয়ে বাংলাদেশে কী কাণ্ড ঘটিয়ে চলেছে তা বুঝার জন্য ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের প্রহসন তথা বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জীবনবিনাশী ক্যান্সার অথবা মরণব্যাধি এইডস বলে স্বীকৃতি পাওয়া রাতের আঁধারের পুতুল নাচের চুপকথার ভয়াবহ চলচ্চিত্রের কাহিনী মূল্যায়ন করলেই সবকিছু স্পষ্ট হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের সবক্ষেত্রে চীনের দাপা-দাপিতে এ দেশের সরকারবিরোধীরা চুপচাপ বসে থাকলেও সিআইএ এবং র’ কিন্তু বসে নেই। তারা বাংলাদেশকে কেন্দ্র করে চীন-রাশিয়া এবং তাদের দোসরদের সব তৎপরতা রুখে দেয়ার জন্য যে মহাপরিকল্পনা নিয়ে এগোবে তা নিঃসন্দেহে আগামী দিনে আমাদের রাজনীতি, অর্থনীতি ও সামাজিক সংহতি তছনছ করে দেবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে আমরা সাধারণত মঞ্চের ওপর নৃত্যরত পুতুলরূপী কিছু অভিনেতা-অভিনেত্রী এবং তাদের সাঙ্গ-পাঙ্গ-চ্যালা-চামুণ্ডাদের ক্রীড়া-কৌতুকই দেখতে পাই। কিন্তু মঞ্চের পেছনে বা পর্দার আড়ালে থেকে যেসব কুশীলব পুতুলদের হাতে-পায়ে-নাকে এবং ঠোঁট-জিহ্বা-চোখে সুতা পরিয়ে দিয়ে কিভাবে নৃত্যনাট্য পরিচালনা করতে পারে তার নমুনা আমরা দেখতে পাই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হওয়ার পর। কয়েকজন অনুসন্ধিৎসু দেশী-বিদেশী সাংবাদিক ১৯৭৫ সালের পনেরোই আগস্টের পূর্বাপর ঘটনা নিয়ে যেসব অনুসন্ধানী বই-পুস্তক রচনা করেছেন তাতে বিদেশী গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর অপতৎপরতা, প্রতিশোধ গ্রহণের নোংরা স্পৃহা এবং মঞ্চের ওপর থেকে পুরনো পুতুলদের সরিয়ে দেয়ার যে কাহিনী জানতে পারা যায়, তা রীতিমতো বিস্ময়কর এবং ভয়াবহও বটে।

বাংলাদেশের এ যাবৎকালের রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ, বিএনপি এবং জাতীয় পার্টি যেমন রাষ্ট্রক্ষমতা পরিচালনা করেছে, তেমনি খোন্দকার মোশতাক এবং তার গ্যাং ছাড়াও সেনাবাহিনী পরোক্ষ ও প্রত্যক্ষভাবে রাষ্ট্র চালিয়েছে। রাষ্ট্রক্ষমতার স্বাদ আহলাদ, সুখ-দুঃখ এবং লাভক্ষতি কেবল রাজনীতিবিদদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি বরং বহুমুখী দেশী-বিদেশী চক্রান্তের কারণে দেশীয় রাজনীতিতে যে সুনামি-টর্নেডো, কালবৈশাখীর তাণ্ডব চলেছে তাতে অনেকেই প্লাবিত হয়েছে। ঝড়-বন্যা, বৃষ্টি ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে মানুষের সহায়-সম্পত্তি, জীবন যেমন নাশ হয় তেমনি অনেক কিছুর স্থানচ্যুতি বা বাস্তুচ্যুতি ঘটে। বন্যার তোড়ে গেরস্থের ঘরে বিষাক্ত সাপ ঢুকে যায়। কখনোবা গরু-ছাগল-মহিষ-মানুষ এবং বন্য হিংস্র পশুরা এক জায়গায় আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। ফলে যেকোনো প্রকৃতিক দুর্যোগ-পরবর্তী সময়ে মানুষের মন-মানসে বিরাট এক বেদনাময় স্মৃতি জাগরুক থেকে এবং বহুমুখী রোগবালাইয়ে শরীর আক্রান্ত হয়ে পড়ে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো রাজনৈতিক দুর্যোগগুলোও আমাদের জনজীবনে নানামুখী ক্রিয়া প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে। মহান মুক্তিযুদ্ধ যেমন আমাদের গর্বের ধন তেমনি আমাদের অস্তিত্ব, মান-মর্যাদা এবং জাতীয়তাবোধের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধকে নিয়ে বাঙালির সেই অহঙ্কারকে ভারতীয় দক্ষিণপন্থী গ্রুপ কোনো দিন মেনে নিতে পারেনি। অধিকন্তু কিছু ভারতীয় রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা মনে করেন, ভারতের দয়া-দাক্ষিণ্য এবং সামরিক হস্তক্ষেপ ছাড়া বাংলাদেশ সৃষ্টি হতো না। তাই তারা তাদের যাবতীয় ইতিহাসে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ‘ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ’ বলে লিপিবদ্ধ করেছেন। তারা বঙ্গবন্ধুর সরকারকে একটি আশ্রিত কলোনিয়াল রাষ্ট্র বানানোর অপচেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হওয়ার পরই সর্বশক্তি নিয়োগ করেন এ দেশের রাজনীতিতে অস্থির; সঙ্ঘাতময় এবং কলঙ্কময় বানানোর জন্য। বঙ্গবন্ধুর পরে যত সরকারই ক্ষমতায় এসেছে তারা সবাই বিদেশী শক্তিগুলোর সাথে মোটামুটি ভারসাম্য রক্ষা করে ক্ষমতায় টিকে ছিলেন। কিন্তু তাদের মধ্যে কেউ কেউ যখন কোনো কারণে ভারত অথবা মার্কিনিদের রোষানলে পড়েছেন তখনই তাদেরকে বেইজ্জতি করে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে।

আমাদের দেশের সাম্প্রতিক ইতিহাস যারা জানেন তারা নিশ্চয়ই স্বীকার করবেন, গত দশটি বছর ধরে বাংলাদেশের সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল অবধি বাংলাদেশ-মার্কিন সম্পর্কের অবনতির মূল কারণ ছিল মূলত ড: মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক। ২০১৪ সালের পর সেই খারাপ সম্পর্কের মূলে আরো একটি উপাদান যুক্ত হয়। আর সেটি হলো- ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচন। দশম সংসদের অবৈধতা-অনৈতিকতা নিয়ে মার্কিনিদের উচ্চকণ্ঠ। এ ছাড়া বিরোধী দলের ওপর দমন-পীড়ন, রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে দলীয়করণ, বিচারব্যবস্থায় হস্তক্ষেপ, মানধিকার লঙ্ঘন, অর্থ পাচার, কুশাসন, গণতন্ত্রহরণ ইত্যাদি অভিযোগ এনে মার্কিন সরকার এবং সেই দেশের সিভিল সোসাইটি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তাদের পূর্বতম অবস্থান আরো সুদৃঢ় করে।

২০১৮ সালের মাঝামাঝি এসে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করে তাদের ভারতমুখী পররাষ্ট্রনীতি ত্যাগ করে চীনের প্রতি ঝুঁকে পড়ে। চীন দীর্ঘদিন থেকে অনবরত চেষ্টা চালিয়ে আসছিল বাংলাদেশের ওপর তাদের একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তারের। কিন্তু অতীতকালে তারা কৌশলগত কারণে সেই সুযোগ পায়নি। কারণ পৃথিবীর অন্যান্য দেশে তারা যেভাবে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে সেই রকম পরিস্থিতি তারা ২০১৮ সালের পূর্বে বাংলাদেশে পায়নি অথবা সৃষ্টি করতে পারেনি। বিষয়টি পরিষ্কার করার জন্য সাম্প্রতিক দুনিয়ায় চীনের আধিপত্য নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা দরকার। চীন সাধারণত দুইভাবে গত তিন দশক ধরে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করে আসছে। তারা সারা দুনিয়াকে দুইটি ভাগে ভাগ করেছে। এক ভাগকে তারা কেবলমাত্র অর্থনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য ব্যবহার করবে আর অন্য অংশকে ব্যবহার করবে অর্থনৈতিক-সামরিক-ভৌগোলিক এবং কৌশলগত রাজনীতির স্বার্থে। চীন তাদের অর্থনৈতিক আধিপত্য পৃথিবীর সব দেশে ইতিমধ্যে বিস্তার করে ছেড়েছে, যুক্তরাষ্ট্র, ভারত, রাশিয়া, তুরস্ক, জাপান প্রভৃতি প্রতিদ্বন্দ্বী দেশে চীনা অর্থনীতির দাপট এত বেশি যে, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোকে চীনা প্রভাব এড়ানোর জন্য রীতিমতো যুদ্ধের কথা কল্পনা করতে হচ্ছে।

পশ্চিমা দেশগুলো ছাড়াও চীন সাব সাহারার কিছু আফ্রিকান দেশ, আরব অঞ্চলের কয়েকটি দেশ, মধ্য এশিয়ার দেশগুলো এবং দক্ষিণ-পূর্ব ও উত্তর-পূর্ব এশিয়ার কয়েকটি দেশকে রীতিমতো নিজেদের অর্থনৈতিক কলোনি বানিয়ে ফেলেছে, যারা চীনের মতের বাইরে এক কদম এগোবার সাহস করে না। চীন এশিয়ার যেসব অঞ্চলকে সামরিক ও অর্থনৈতিক বিবেচনায় গুরুত্বপূর্ণ মনে করে সেসব দেশের মধ্যে উত্তর কোরিয়া, পাকিস্তান, মিয়ানমার, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং নেপালকে ইতিমধ্যে কব্জা করে নিয়েছে। কিন্তু তাদের চীর প্রতিদ্বন্দ্বী ভারতকে মোকাবেলা ও নাস্তানাবুদ করার জন্য ওসব দেশের চেয়েও তাদের কাছে বেশি গুরুত্বপূর্ণ হলো বাংলাদেশ।

বাংলাদেশকে নিয়ে মহাচীনের মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সমস্যা সৃষ্টি করা হয় এবং প্রায় বারো লাখ রোহিঙ্গাকে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করানো হয়। বাংলাদেশের বৃহত্তম চট্টগ্রাম জেলা এবং কুমিল্লার কিছু অংশকে ব্রিটিশ জমানার পূর্বে মিয়ানমারের রোঙ্গিলা অঞ্চল তথা রোসাঙ্গ রাজের অধিভুক্ত দেখিয়ে চীনের মদদে মিয়ানমার সেনাবাহিনী একটি মাস্টারপ্লান তৈরি করে, যেখানে বাংলাদেশের সর্বনাশ ঘটিয়ে মিয়ানমারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে। অন্য দিকে, ভারতের সাতটি রাজ্যকে বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের সঙ্গে একটি কনফেডারেশন তৈরির দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা তৈরি করে চীন এই অঞ্চলকে পাকিস্তানের মতো সামরিকভাবে শক্তিশালী করার পরিকল্পনা করেছে।

চীন যেসব দেশে সামরিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করে যেসব অঞ্চলকে রেড জোন আখ্যা দিয়ে সেখানকার সব কিছুর সূচক নিজেদের অনুকূলে আনার চেষ্টা করে। এ ক্ষেত্রে তাদের প্রথম পছন্দ সেনাবাহিনী। তারা পাকিস্তান, মিয়ানমার এবং থাইল্যান্ডের মতো করে সেনাবাহিনীকে নিজেদের কব্জায় নেয়ার চেষ্টা করে রেড জোনগুলোতে ত্রিমাত্রিক তৎপরতা চালাতে থাকে। তাদের দ্বিতীয় পছন্দ হলো- উত্তর কোরিয়ার কিম, মালয়েশিয়ার নাজিব রাজাক, রাশিয়ার পুতিন, ভেনিজুয়েলার প্রয়াত হুগোস্যাভেজ এবং বর্তমানের মাদুরোর মতো কর্তৃত্ববাদী একনায়ক এবং একনায়কের তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল ও গোষ্ঠী। তারা রেড জোনগুলোতে তাদের প্রয়োজনীয় নেয়ামকগুলো পেয়ে গেলে সর্বশক্তি নিয়োগ করে অক্টোপাসের মতো সংশ্লিষ্ট দেশ-জাতিকে কব্জা করে নেয়।

বাংলাদেশের সঙ্গে চীনের সাম্প্রতিক সম্পর্ক বিবেচনা করলে এ কথা স্পষ্ট যে, তারা গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে তাদের মনের মতো দোসর পেয়ে গেছে। পত্রিকায় খবর বের হয়েছে, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও চীনা কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে নজিরবিহীনভাবে একটি এমওইউ স্বাক্ষর হয়েছে। এটি নজিরবিহীন প্রধানত দু’টি কারণে। প্রথমত, দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশের রাজনৈতিক দলের সাথে এর আগে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি কোনো এমওইউ স্বাক্ষর করেনি। দ্বিতীয়ত, একটি গণতান্ত্রিক বলে প্রচারিত দল কোনো স্বৈরাচারী কমিউনিস্ট দলের সঙ্গে এমওইউ স্বাক্ষরের ঘটনাও আমার জানা নেই। রাষ্ট্রীয়ভাবে চীন এবং বাংলাদেশ ইতোমধ্যে প্রায় পঞ্চাশ বিলিয়ন ডলার অর্থাৎ প্রায় সাড়ে চার লাখ কোটি টাকা সমমূল্যের বাণিজ্যিক প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে। চীন তার অন্যান্য রেড জোন ঘিরে যেসব দীর্ঘমেয়াদি সামরিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রকল্পগুলো বাস্তবায়ন করে সেসব প্রকল্পের অনেকগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশে দৃশ্যমান হয়েছে।

চীনের সাথে বাংলাদেশের সাম্প্রতিক মাখামাখিমূলক সম্পর্ক ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে কতটা বিক্ষুব্ধ করেছে তা সহজেই অনুমেয়। বিগত দিনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে খারাপ সম্পর্ককে মোকাবেলা করা হয়েছে ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা ও স্বার্থসংশ্লিষ্ট লেনাদেনার মাধ্যমে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র-ভারতের প্রভাবে বাংলাদেশের অনেক কিছু মেনে নিয়েছিল অথবা মানতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চীনের কারণে ভারত বাংলাদেশের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের যে নতুন রসায়ন সৃষ্টি হয়েছে তা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সুযোগ করে দিয়েছে বাংলাদেশের বিষয়ে তাদের অতীতের রাগ-ক্ষোভ ও বিতৃষ্ণার প্রতিশোধ গ্রহণ করে মনের ঝাল মেটানোর। এই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার আগে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের সাম্প্রতিক মিথ নিয়ে কিছু বলা আবশ্যক।

বাংলাদেশের সর্বত্র এ কথা সর্বজনীনভাবে আলোচিত হয় যে, আওয়ামী লীগ হলো ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের অকৃত্রিম বন্ধু। হরিহর আত্মা এবং এ দেশে কংগ্রেসের স্বার্থরক্ষাকারী বান্ধব, অন্য দিকে প্রবীণ কংগ্রেস নেতা প্রণব মুখার্জি যে আওয়ামী পরিবারের প্রধানতম অভিভাবক সে কথা নতুন করে কাউকে বলার দরকার নেই। ফলে ভারতে কংগ্রেসের শাসনকালে ২০০৮ সারের ২৯ ডিসেম্বরের বাংলাদেশী সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে বিপুল বিজয় লাভ করে তার পেছনে ভারতের প্রভাব রয়েছে বলে বিরোধী দলগুলো প্রচার চালাত। ফলে নবম সংসদের অধীনে গঠিত মন্ত্রিপরিষদ তথ্য সরকারকে ভারতীয় তাঁবেদারের বদনাম সহ্য করতে হয়েছিল। তা সত্ত্বেও বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আওয়ামী লীগের শ্রেণী চরিত্র এবং দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ মোটামুটি সহনীয় ছিল। কিন্তু ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতা ও বিনা ভোটারের অবাস্তব, নজিরবিহীন ও সর্বমহলের ঘৃণিত নির্বাচনে ভারতীয় মদদ এত প্রকাশ্য এবং এত অশ্লীলভাবে প্রকাশিত হয়ে পড়ে, যার কারণে বিশ্বের সর্বত্র ভারত ব্যাপকভাবে সমালোচিত ও নিন্দিত হতে থাকে। এমনকি ভারতের অভ্যন্তরেও বাংলাদেশের ৫ জানুয়ারি নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার ঝড় ওঠে।

৫ জানুয়ারির নির্বাচন নামের অদ্ভুত কার্যকারণের ফলে সৃষ্ট সরকারের ওপর ভারতীয় কর্তৃত্ব কেমন হতে পারে তা রাজনীতির একজন শিশুও গড়গড় করে বলে দিতে পারে। অন্য দিকে, বাংলাদেশের সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও সম্ভাবনায় ভাগ বসানোর জন্য পশ্চিমা দেশগুলো বাংলাদেশের ব্যাপারে নমনীয় হতে বাধ্য হয়। ফলে ২০১৪ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে আওয়ামী লীগ সরকার পশ্চিমা দেশগুলো এবং তাদের এশীয় মিত্র যথা জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সৌদি আরব, দুবাই, কাতার প্রভৃতি দেশের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করার সুযোগ পেয়ে যায়। রাশিয়াও বিভিন্ন কারণে বাংলাদেশকে উদারভাবে ব্যাকআপ দিতে থাকে। এদিকে, দীর্ঘদিন ওঁৎ পেতে থাকা চীনও আওয়ামী লীগকে লুফে নেয়। তখন সার্বিক বিবেচনায় আওয়ামী লীগের কাছে ভারতের চেয়ে চীনকে কৌশলগত অংশীদার হিসেবে নির্ভরযোগ্য ও লাভজনক মনে হয়। উদ্ভূত পরিস্থিতিতে ভারতের কর্তৃত্ব ও তাঁবেদারি বহাল রেখে গোপনে চীনের সাথে সমঝোতার ফলে ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর বাংলাদেশে অদ্ভুত ও অভিনব ঘটনায় আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রক্ষমতায় থেকে যাওয়ার অছিলা পেয়ে যায়।

বাংলাদেশের উল্লিখিত প্রেক্ষাপট এবং বর্তমানের নির্মম বাস্তবতায় ভারত ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেদের কায়েমি স্বার্থ এবং এই অঞ্চলের আধিপত্যের ওপর মারাত্মক হুমকি বিবেচনা করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে কখন এবং কিভাবে কী কী ব্যবস্থা নেয়া যায় তা নিয়ে দিল্লি এবং ওয়াশিংটনের পররাষ্ট্র দফতর ও গোয়েন্দা অফিসগুলো রীতিমতো গরম সময় অতিবাহিত করছে। তারা চীনের নতুন এই রেড জোনে কোনো অবস্থাতেই চীনের কর্তৃত্ব স্থায়ী হতে না দেয়ার ব্যাপারে সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণে তৎপর হবে বলে রাজনৈতিক ও সামরিক বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করেছেন। ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে পুরনো দিনের মতো পুনরায় সিআইএ এবং র’-এর পদচারণা, পদভার এবং অপতৎপরতার আশঙ্কা করা হচ্ছে।

লেখক : গোলাম মাওলা রনি ,সাবেক সংসদ সদস্য

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।