শেয়ারবাজারে সাম্প্রতিক দরপতন ও আসন্ন বাজেট প্রসঙ্গে
২০ মে ২০১৯, ০১:০৮ অপরাহ্ণ

শেয়ারের দরপতন নিয়ে সরকার উত্কণ্ঠিত। দফায় দফায় অনেক বৈঠক করেছে, উদ্দেশ্য অনেকটা এই রকম যে, কেন শেয়ারের মূল্যের পতন হচ্ছে তা জানা। এবং দরপতন ঠেকানো যায় কীভাবে। এসব বৈঠক ও বিবৃতি দেখে মনে হলো, শেয়ারবাজারের দরপতন ঠেকানোই নীতিনির্ধারকদের একটা মুখ্য কাজ। আর এই ফাঁকে শেয়ারবাজারের অন্য মৌলিক ইস্যুগুলোকে যেন পেছনেই ঠেলে দেয়া হচ্ছে। শেয়ারের মূল্য বাড়তে পারে আবার পড়তেও পারে—এ নিয়ে বিচলিত হওয়ার কিছু নেই। তবে সত্য হলো, উঠতি শেয়ারবাজারের সুযোগ নেয়ার ক্ষেত্রে কিছু প্রতারক উদ্যোক্তা এবং থোক বরাদ্দপ্রাপ্ত প্লেসমেন্টধারীই অগ্রগামী। আজকে আবার অর্থ ঢেলে শেয়ারবাজারকে যদি কয়েকশ পয়েন্ট বাড়ানো হয়, তাহলে তা থেকে উপকৃত হবে কারা! যদি এমন হতো যে, শেয়ারমূল্য বৃদ্ধি পেতে থাকলে ভালো কোম্পানিগুলো আইপিও বিক্রয় করে শেয়ারবাজারমুখী হচ্ছে, তাহলে সেটা ছিল অনেক গ্রহণযোগ্য একটা বিষয়। কিন্তু বাস্তবতা হলো, শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে ভালো কোম্পানির শেয়ারবাজারে আসার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে অন্য নিরেট সত্য হলো, ভালো মৌলভিত্তির কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার জন্য তেমন উদ্যোগও গ্রহণ করা হয়নি। ১০ বছর আগে বরং তালিকাভুক্ত কিছু কোম্পানি এখনকার চেয়ে ভালো মুনাফা দিত।
এখন অনেক অজানা কারণে তাদের মুনাফা প্রদানের হার কমে গেছে। কয়েক বছর আগে পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান আইসিবির ম্যানেজমেন্টের অধীনে আটটি চাঙ্গা মিউচুয়াল ফান্ড ছিল। রেগুলেটর বিএসইসির এক হুকুমে এগুলোকে তালিকাচ্যুত করা হলো। সেই থেকে মিউচুয়াল ফান্ডে বিনিয়োগ করার সুযোগ (অপশন) অনেক কমে গেছে। বর্তমানে মিউচুয়াল ফান্ডগুলো যে আস্থাহীনতায় ভুগছে, তার জন্য রেগুলেটরও আংশিকভাবে দায়ী। রেগুলেটরই তো অনুমতি দিয়েছে যে, ইউনিটহোল্ডারদের নগদ (ক্যাশ) প্রদানের পরিবর্তে অতিরিক্ত (আরআইইউ) ইউনিট দেয়া যাবে। অর্থাৎ মিউচুয়াল ফান্ডেও বোনাস দেয়া যাবে। আজকে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। কোন বিনিয়োগকারী পারতে এগুলোর দিকে ফিরে তাকায়! শেয়ারবাজারে মিউচুয়াল ফান্ডে সেগমেন্টটা অনেকটা মৃত। অন্যদিকে বেশকিছু কোম্পানি নানা কৌশলে তাদের খুদে শেয়ার বিনিয়োগকারীদের শুধুই ঠকিয়েছে। ঠকানোর বা প্রতারণার মূল হাতিয়ারটা ছিল উদ্যোক্তাদের শেয়ার বিক্রি। লাখ লাখ শেয়ার বেচে দিয়ে তারা শত শত কোটি টাকা বাজার থেকে নিয়ে গেল, ওই টাকা পুনর্ভরণ কে করবে? সরকারকে বারবার শেয়ারবাজারের জন্য অর্থ দিতে হবে? আর যদি দেয়ও, সে অর্থে অতি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা কি আদৌ উপকার পাবে? প্রিমিয়ামে আইপিও ইস্যু করে মাত্র তিন-চার বছরের মধ্যে দেখা গেছে কোম্পানির অফিসে তালা। এ দায় কে নেবে! গত ১০ বছরে যেসব কোম্পানি আইপিও বিক্রয় করেছে, ওইসব কোম্পানির শেয়ার ধারণ করে কি সাধারণ বিনিয়োগকারীরা আদৌ কোনো উপকার পেয়েছে? এগুলো এতটাই জাংক যে, এগুলোর স্টক নিয়ে জুয়া খেলা হয়। কেউই এগুলোয় দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ করার জন্য সাহস পায় না। শেয়ারের মূল্য পড়ে গেল, সেটা তো অংকের হিসাব মাত্র। শুধু এপ্রিলেই কথিত উদ্যোক্তারা আর প্লেসমেন্টধারীরা বাজার থেকে শেয়ার বেচে ৭০০ কোটি টাকা নিয়ে গেছে! অর্থমন্ত্রী মহোদয় কি গত এক বছরে শেয়ারবাজার থেকে কে কী পরিমাণ অর্থ নিয়ে গেছে, তার একটা অনুসন্ধানী হিসাব দিতে আদেশ দেবেন? যদি দেন, দেখবেন শেয়ার বেচে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা বাজার থেকে তেমন কোনো অর্থ নেয়নি। যে সামান্য অর্থ তারা নিতে পারে, তা হলো ক্ষোভে-দুঃখে তাদের অনেকেই সব শেয়ার বেচে বিও হিসাবকে বন্ধ বা অকেজো করে রাখার মাধ্যমে। সরকার শেয়ারবাজারকে মজবুত ও শক্তিশালী দেখতে চায়। এ ভাবনাটা অবশ্যই ঠিক। কিন্তু গত কয়েক বছরে প্রকৃত অর্থে এ বাজারকে মজবুত-শক্তিশালী করার লক্ষ্যে কোনো পদক্ষেপ কি গ্রহণ করা হয়েছে? কতগুলো অখ্যাত-কুখ্যাত কোম্পানির আইপিও বিক্রির অনুমোদনের মাধ্যমে তালিকাভুক্তির বোর্ডকেই শুধু ভারী করা হয়েছে। আর অডিট রিপোর্টগুলো কী বলব! এগুলো প্রায় পূর্ণাঙ্গভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছে। আমরা আশা করি, নবগঠিত এফআরসি (ফিন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিল) অডিট বিভাগকে জবাবদিহির মধ্যে আনতে কার্যকর পন্থা অবলম্বন করবে। যখন তখন বোনাস বা স্টক ডিভিডেন্ড দিয়ে শেয়ারের সরবরাহ বাড়ানো হয়েছে। অন্যদিকে উদ্যোক্তারা ফান্ড প্রায় খালি করে দিয়ে শেয়ারের সরবরাহ আরো বাড়িয়েছে। কিন্তু সেই সঙ্গে বাজারে নতুন করে কোনো অর্থ প্রবেশ করছে না। তা ওইসব শেয়ারের মূল্য কোথায় যাবে? এজন্য কি অংকের ক্লাসে ভর্তি হয়ে নতুন করে অংক শিখতে হবে? নতুন করে বাজারে কখন অর্থ প্রবেশ করে? যখন অর্থ দেখে তার ব্যবহারজনিত আয় (অপরচুনিটি কষ্ট) শেয়ারবাজারে বেশি, তখন অর্থ আপনাআপনি এ বাজারে প্রবেশ করবে। কিন্তু বর্তমানে কী অবস্থায় আছে? ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ কয়েকটি কোম্পানির ক্ষেত্রে নতুন করে অনুসন্ধান করবে বলে জানিয়েছে। অনুসন্ধানটা ভালো। তবে এই পথ অনুসন্ধান অনেক আগেই করা উচিত ছিল। এখন অবস্থা এমনই যে, রোগী মরে গেছে, তারপর ডাক্তার এসেছে। সবার বোঝার জন্য একটা কথা বলব, আমাদের শেয়ারবাজারের সমস্যা অর্থসংক্রান্ত বা তারল্যের অভাব নয়। আমাদের বাজারের মূল সমস্যা হলো, বিনিয়োগ উপযোগী ভালো শেয়ারের অভাব। আপনারা সবাই চেষ্টা করে ভালো ব্যবসা করছে, এমন কিছু কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে আনুন, দেখবেন শেয়ারবাজার প্রকৃত অর্থেই উপকৃত হবে। আমাদের সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলতে পারে কিন্তু উদ্যোগটা নিতে হবে উচ্চপর্যায় থেকে। আমাদের অর্থনীতিতে শত শত কোটি টাকার ব্যবসা করবে অথচ জনগণকে তার ইকুইটির সামান্যতম মালিকানাও দেয়া হবে না, এটা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বিশ্বের কোথাও এটা গ্রহণযোগ্য হয়নি। সর্বত্রই জনস্বার্থে তাদের শেয়ারবাজারে আসতে বাধ্য করা হয়েছে। আর কোনো কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে না এনে শুধু বর্তমান শেয়ারবাজারকে অধিক অর্থ ঢেলে ঊর্ধ্বে নিতে চাইলে সেটা টিকবে না। দিন শেষে শেয়ারের মূল্য নির্ধারণ হয় যে কোম্পানির শেয়ার জনগণ কিনছে, তার আয়ের ওপর এবং ওই আয় থেকে কতটা প্রকৃত মুনাফা এই জনগণকে দেয়া হয় তার ওপর।
আরো প্রতারণার কৌশল যেসব কোম্পানি নিয়েছে, তাদের শেয়ার পানির মূল্যে পাওয়া গেলেও সেসব শেয়ার থেকে দূরে থাকা বিজ্ঞতার কাজ হবে। আমি সবিনয়ে বিনিয়োগকারীদের অনুরোধ করব, আপনাদের স্বার্থ রেগুলেটর বা অন্য কেউ দেখবে, এটা ভাবার কোনো কারণ নেই।
নিজেরা নিজেদের জ্ঞানটুকু কাজে লাগান এবং আত্মরক্ষার ভালো উপায় হলো, জ্ঞানকে প্রয়োগ করা। এ বাজারের উলফদের সঙ্গে খেলতে গিয়ে আপনারা টিকবেন না। উপদেশ হবে যতটা পাওয়া যায়, ভালো মৌলভিত্তির শেয়ারে বিনিয়োগ করুন। তবে এও সত্য, কিছু কথিত ভালো কোম্পানির শেয়ারও আপনাদের ঠকিয়েছে। কিন্তু যে ঠকায়, সে একবার ঠকায়; সে কেন আপনাদের বারবার ঠকাতে পারবে? শেয়ারবাজারের একটা বড় অংশ জুড়ে আছে গ্রামীণফোন, যেটা এ শ্রেণীর মধ্যে একমাত্র তালিকাভুক্ত কোম্পানি। সম্প্রতি এসএমপি (সিগনিফিকেন্ট মার্কেট পাওয়ার) রেগুলেশনের নামে রেগুলেটর বিটিআরসি এ কোম্পানির ব্যবসার ওপর অনেক বিধি-নিষেধ আরোপ করেছে। বিধি-নিষেধগুলো প্রকৃত অর্থে প্রতিযোগিতার সঙ্গে কোনো সম্পর্ক আছে বলে মনে হয়নি। আজকে যদি গ্রামীণফোনকে প্রতিযোগিতার ভিত্তিতে ব্যবসা করতে না দেয়া হয়, তাহলে ক্ষতি হবে কার? ক্ষতি হবে এর শেয়ারে যারা বিনিয়োগ করেছে, তাদের; ক্ষতি হবে সরকারেরও। কারণ সরকার এ কোম্পানি থেকে যে ঊর্ধ্বগতির রাজস্ব পেত, তা পাবে না। নতুন প্রডাক্ট যদি গ্রামীণফোন বাজারে না আনতে পারে, আর সেজন্য বিজ্ঞাপনও না দিতে পারে, তাহলে সরকার বা এ ফোনের গ্রাহকরা কীভাবে লাভবান হবেন! অথচ এ দেশের হাজার হাজার বিনিয়োগকারী এই গ্রামীণফোনের শেয়ার কিনেছে। সরকারও কিনেছে লাখ লাখ শেয়ার, আইসিবি ও সাধারণ বীমা কোম্পানির মাধ্যমে একসময় গ্রামীণফোনের শেয়ার ট্রেড হতো ৫০০-৫২০ টাকার মধ্যে। আজকে এসএমপি রেগুলেশনের ভয়ে তা নেমে এসেছে ৩৫০-৩৫৫ টাকার মধ্যে। শেয়ারবাজারের লোকেরা বুঝতে অক্ষম হচ্ছে, তারা এ শেয়ারে কখন বিনিয়োগ করবে। আশা করি, সংশ্লিষ্ট সবাই গ্রামীণফোনের এসএমপির বিষয়টা সুরাহা করবে।
সামনে বাজেট পেশের সময় আসছে। আমরা আশা করি, বাজেট প্রস্তাবনায় পুঁজিবাজারের ইস্যুগুলোর প্রতি যথাযথ নজর দেয়া হবে। নগদ অর্থ না দিয়ে সিস্টেমে করজনিত কিছু প্রণোদনা দিলে শেয়ারবাজার উপকৃত হবে। সব প্রণোদনারই লক্ষ্য হওয়া উচিত, যাতে করে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলো আরো বেশি করে বণ্টনজনিত মুনাফা ঘোষণা করে। একসময় যে কোম্পানি বেশি মুনাফা দিত, তাদেরকে ট্যাক্স রিবেইটের মাধ্যমে বেশি মুনাফা বণ্টনের জন্য উৎসাহ দেয়া হতো। পরে রাজস্ব বোর্ডের লোকেরা সেটা উঠিয়ে নিয়েছে। সেটা আবার পুনঃস্থাপন করা যেতে পারে। শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হলে করপোরেট আয়করের আরো ছাড়ের কথা বিবেচনা করা যেতে পারে। আর ব্যক্তি পর্যায়ে উেস যে ১০ শতাংশ আয়কর ডিভিডেন্ড থেকে কেটে নেয়া হচ্ছে, সেটাকেও ফাইনাল কর হিসাবে বিবেচনা করা যেতে পারে। শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রে আয়কর যদি ট্যাক্স-সম্পর্কিত কোনো প্রণোদনা দিতে চায়, তাহলে সেই প্রণোদনা যাতে এমন হয় যে, এর থেকে সাধারণ বিনিয়োগকারীরা উপকৃত হয়। সত্য হলো, আমাদের শেয়ারবাজারকে যে পর্যায়ে নিয়ে বিশ্বাসযোগ্য করানোর দরকার ছিল, সেই পর্যায়ে আমরা নিতে পারেনি। বরং ক্ষণে ক্ষণে দেখা গেছে এটা আরো পেছনে চলে গেছে।
লেখক:আবু আহমেদ, অর্থনীতিবিদ; অনারারি অধ্যাপক
অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়