সতর্ক করেই দায়মুক্তি

Daily Ajker Sylhet

newsup

০৮ ডিসে ২০২৩, ০৯:১১ পূর্বাহ্ণ


সতর্ক করেই দায়মুক্তি

নিউজ ডেস্ক: দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক হেভিওয়েট প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের প্রমাণ পেয়েছে সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। তবে প্রথমবারের কারণে প্রায় সবাইকে ‘সতর্ক’ করে দায়মুক্তির সুপারিশসহ নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে কমিটি।

এর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত দিতে যাচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। যদিও এসব অপরাধে সতর্ক করা ছাড়াও প্রার্থীকে জরিমানা এমনকি প্রার্থিতা বাতিলের মতো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া হয়েছে। ইসি সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

জানা গেছে, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রায় একশ’ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের বিভিন্ন অভিযোগ তদন্তাধীন বলে ইসিকে জানিয়েছে সংশ্লিষ্ট কমিটি। শোডাউনসহ মনোনয়নপত্র দাখিল, প্রচার চালানো, প্রতিপক্ষ প্রার্থী ও সমর্থকদের হুমকি-ধামকি দিয়ে বক্তব্য দেওয়ার মতো অভিযোগে এসব তদন্ত চলছে।

নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করে এবং ইসি সূত্রে জানা গেছে, নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ-সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, মাগুরা-১ আসনের প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবর রহমান চৌধুরী (নিক্সন চৌধুরী) এবং সুনামগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকসহ ১৫-২০ জন প্রার্থীর বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ তদন্ত করে প্রতিবেদন নির্বাচন কমিশনে পাঠানো হয়েছে। প্রায় সব প্রতিবেদনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণের কথা বলা হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ যুগান্তরকে বলেন, নির্বাচনে আচরণবিধিমালা প্রতিপালনে নির্বাচন কমিশন অত্যন্ত কঠোর। এবারই প্রথম প্রতিটি আসনের জন্য পৃথক ৩০০টি নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা মাঠে কাজ করছেন। তারা যেসব প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন, সেগুলো কমিশনের সিদ্ধান্তের জন্য উপস্থাপন করা হচ্ছে। কমিশন যে সিদ্ধান্ত দেবে, তা সংশ্লিষ্টদের জানিয়ে দেওয়া হবে।

জানা গেছে, গত ১৫ নভেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল। তফসিল ঘোষণার পরপরই নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি গঠন করে ইসি। একই সঙ্গে আট শতাধিক ম্যাজিস্ট্রেট মাঠে রয়েছেন। নির্বাচনে অনিয়ম ও আচরণবিধি তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার এখতিয়ার নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির। ওই প্রতিবেদনের ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে।

গোলাম দস্তগীর গাজী : নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে যেসব প্রতিবেদন এসেছে তার একটি নারায়ণগঞ্জ-১ আসনের। এ আসনে আওয়ামী লীগ দলীয় বর্তমান সংসদ-সদস্য এবং বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী গত ৩০ নভেম্বর অস্ত্রধারী কর্মীসহ বিশাল শোভাযাত্রা করে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। এতে আচরণ বিধিমালার লঙ্ঘন হয়েছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশিত হয়।

এ অভিযোগ তদন্ত করে আংশিক সত্যতা পেয়েছেন ওই আসনের নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির প্রধান ও নারায়নগঞ্জের সিনিয়র সহকারী জজ শেখ আনিসুজ্জামান। প্রতিবেদনে গোলাম দস্তগীর গাজী ও তার কর্মী-সমর্থকরা যাতে আচরণবিধি লঙ্ঘন না করে সেজন্য তাকে কঠোরভাবে ‘সতর্ক’ করার সুপারিশ করেছে অনুসন্ধান কমিটি। একই সঙ্গে কাঞ্চন পৌরসভা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গোলাম রসুল কলি অস্ত্রধারী দেহরক্ষী নিয়ে শোডাউন করেন।

এর দায়ে এবারের নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পক্ষে তিনি যাতে প্রচারণায় অংশ না নেন সেজন্য নির্দেশনা দেয়ার সুপরিশ করা হয় প্রতিবেদনে। এতে আরও বলা হয়, রূপগঞ্জ থানায় অনেক মানুষের হাতে বৈধ অস্ত্র রয়েছে। এসব অস্ত্র দ্রুত থানায় জমার নির্দেশনা জারির প্রস্তাব করেন শেখ আনিসুজ্জামান।

সাকিব আল হাসান : মাগুরা-১ আসনের প্রার্থী ক্রিকেটার সাকিব আল হাসানের বিরুদ্ধে গত ২৯ নভেম্বর বিশাল গাড়ির বহরসহ শোডাউন করে নির্বাচনি এলাকায় যাওয়ায় আচরণবিধি লঙ্ঘনের অভিযোগ আনেন ওই আসনের নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। শোডাউনের কারণে সেখানে জনসাধারণের চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। ওই ঘটনা তদন্তে ‘আংশিক সত্যতা’ পেয়েছেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির প্রধান সত্যব্রত শিকদার। প্রতিবেদনে আচরণ বিধিমালার ৬ (ঘ), ৮(ক), ১০(ক) এবং ১২ ধারার বিধান প্রথমবার লঙ্ঘন করায় তাকে ‘সতর্ক’ থাকার নির্দেশনা দিয়ে অব্যহতির সুপারিশ করেন।

ড. মোহাম্মদ সাদিক : সুনামগঞ্জ-৪ আসনের আওয়ামী লীগের সংসদ-সদস্য প্রার্থী নির্বাচন কমিশনের সাবেক সচিব ড. মোহাম্মদ সাদিকের বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে নির্বাচন কমিশনে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ওই আসনের নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। এতে প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘন করে গত ২৯ নভেম্বর সুনামগঞ্জ শহরের প্রধান প্রধান সড়কে মোটরসাইকেল ও গাড়ির বহর নিয়ে শোভাযাত্রা করার অভিযোগ আনা হয়।

ওই অভিযোগের জবাবে ড. মোহাম্মদ সাদিক নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটিকে দেওয়া বক্তব্যে উৎসাহী জনসাধারণ তাদের ভালোবাসা জানাতে সমবেত হয়ে তাকে স্বাগত জানান বলে উল্লেখ করেন। এ ঘটনায় দুঃখ প্রকাশ করে আইন মেনে চলার অঙ্গীকার করেন। প্রতিবেদনে এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধি লঙ্ঘনের আংশিক সত্যতা পাওয়া গেছে বলে উল্লেখ করেন কমিটির প্রধান যুগ্ম জেলা ও দায়রা জজ কাঁকন দে। তাকে আচরণ বিধিমালা লঙ্ঘনের ঘটনায় ‘সতর্ক’ করে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ করেন।

নিক্সন চৌধুরী : ফরিদপুর-৪ আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী মজিবর রহমান চৌধুরীর (নিক্সন চৌধুরী) আচরণবিধিমালা লঙ্ঘন করে গাড়ির বহর নিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক ঘুরে জেলা পরিষদে যাওয়ার প্রমাণ পেয়েছে নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর আচরণবিধিমালার ৮(ক)(খ) ধারা অনুযায়ী কেউ মনোনয়নপত্র দাখিলের সময়ে শোডাউন করতে পারবে না। ১২ ধারা অনুযায়ী ভোটের তিন সপ্তাহ আগে প্রচার শুরু করতে পারবে না। এসব কার্যক্রম চালালে আরপিওর ৯১(খ)(২) ধারা অনুযায়ী ভোটপূর্ব অনিয়ম হিসেবে গণ্য হবে। প্রতিবেদনে আচরণবিধি লঙ্ঘনের অপরাধ প্রমাণ হওয়ায় তাকে ‘সতর্ক’ করার সুপারিশ করেছেন নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির প্রধান মোহাম্মদ মঈন উদ্দীন চৌধুরী। একই সঙ্গে নিক্সন চৌধুরী যেন আচরণবিধি মেনে চলেন সেই নির্দেশনা দিতে অনুরোধ জানান তিনি।

ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিন : চট্টগ্রাম-১৫ আসনে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ আনেন একই আসনের আরেক প্রার্থী আব্দুল মোতালেব। তবে সব অভিযোগের সত্যতা মেলেনি। তবে প্রতিপক্ষকে হুমকি দিয়ে বক্তব্য ও স্লোগান দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পেয়েছে কমিটি। এ ঘটনায় ড. আবু রেজা মুহাম্মদ নেজামুদ্দিনকে জরিমানাসহ সতর্ক করার সুপারিশ করেছে কমিটি।

গাজী মাঈনুদ্দীন : চাঁদপুর-৫ আসনের স্বতন্ত্র প্রার্থী গাজী মাঈনুদ্দীনের বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ করেন এ নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসক। এ ছাড়া জাকির হোসেন নামের আরেক ব্যক্তিও একই ধরনের অভিযোগ করেন। অভিযোগ তদন্ত করে আংশিক সত্যতা পেয়েছেন এ নির্বাচনি আসনের অনুসন্ধান কমিটির প্রধান মোস্তফা পারভেজ। নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ে পাঠানো প্রতিবেদনে এ প্রার্থীকে ‘সতর্ক’ থাকার নির্দেশনা দিয়ে অব্যাহতির সুপারিশ করেন তিনি।

মোস্তাফিজুর রহমান : চট্টগ্রাম-১৬ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থী মোস্তাফিজুর রহমান গত ৩০ নভেম্বর বিশাল শোডাউন করে মনোনয়নপত্র দাখিল করেন। ওই সময়ের চিত্র গ্রহণ করায় বেসরকারি একটি টেলিভিশনের সাংবাদিকদের মারধর এবং ক্যামেরা ভাঙচুরের অভিযোগ করা হয় তার বিরুদ্ধে। অভিযোগের তদন্ত করেন সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটির চেয়ারম্যান আবু সালেম মোহাম্মদ নোমান। প্রতিবেদনে সাংবাদিক মারধর ও ক্যামেরা ভাঙচুরের প্রমাণ পাননি বলে উল্লেখ করেন। তবে এ প্রার্থী আচরণবিধিমালা লঙ্ঘন করেছেন বলে এতে উল্লেখ করা হয়। এ প্রার্থীর বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালার ৮(খ) ধারা লঙ্ঘনের অভিযোগ প্রমাণ হওয়ায় তার বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়।

অভিযোগ বেশি সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিরুদ্ধে : জানা গেছে, আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে আচরণবিধিমালা লঙ্ঘনের অভিযোগ বেশি এসেছে। ওইসব ঘটনায় সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি অনুসন্ধান কমিটি তাদের শোকজ করেছে। স্থানীয়ভাবে তদন্ত করে প্রতিবেদন দেবে কমিটি। এ পর্যন্ত যাদের শোকজ করা হয়েছে তাদের মধ্যে সরকারদলীয় প্রার্থীরা হলেন-বরিশাল-৫ আসনের সংসদ-সদস্য পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী জাহিদ ফারুক শামীম, গাইবান্ধা-১ আসনের আফরুজা বারী, ফরিদপুর-৩ আসনের শামীম হক, মাদারীপুর-৩ আসনের ড. আব্দুস সোবহান গোলাম, ফরিদপুর-১ আসনের মো. আব্দুর রহমান, নাটোর-২ আসনে শফিকুল ইসলাম শিমুল, নাটোর-৩ আসনে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনে র, আ, ম, উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী প্রমুখ।

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।