ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে এআই চ্যাটবট – BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, সকাল ৮:৫৪, ১৩ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ


 

ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে এআই চ্যাটবট

newsup
প্রকাশিত মে ২০, ২০২৫
ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস ভেঙে দিচ্ছে এআই চ্যাটবট

অনলাইন ডেস্ক:

মানুষের মধ্যে ষড়যন্ত্রতত্ত্বের প্রতি একধরনের আকর্ষণ বা কৌতূহল অনেক আগে থেকেই বিদ্যমান। কেউ বিশ্বাস করেন, চাঁদের মাটিতে মানুষের পা রাখা আসলে সাজানো নাটক—নাসার গোপন পরিকল্পনায় আমেরিকার প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব দেখানোর জন্য এমনটি করা হয়েছিল। কারও মতে, ওষুধ কোম্পানিগুলো রোগের প্রকৃত চিকিৎসা লুকিয়ে রাখে, যাতে অকার্যকর টিকা বিক্রি করে লাভ করা যায়। কেউ বলেন, ৯/১১-এর হামলা মার্কিন সরকার ইচ্ছাকৃতভাবে হতে দিয়েছিল, যাতে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়। কেউ আবার ভাবেন, নেভাদার এরিয়া ৫১ ঘাঁটিতে এলিয়েন এবং তাদের মহাকাশযান লুকিয়ে রাখা হয়েছে।

এমন বিশ্বাস মানুষের পরিচয় ও দৃষ্টিভঙ্গির গভীরে গেঁথে যায়। বহু বছর ধরে বিভিন্নভাবে ষড়যন্ত্রতত্ত্ব ভাঙানোর চেষ্টা হয়েছে—যুক্তির মাধ্যমে বা বিশ্লেষণমূলক চিন্তায় মানুষকে প্ররোচিত করে। ২০২৩ সালের একটি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, ষড়যন্ত্রমূলক বিশ্বাস পরিবর্তনের লক্ষ্যে পরিচালিত ২৫টি গবেষণার মধ্যে অধিকাংশই ফলপ্রসূ হয়নি।

তবে ২০২৪ সালে এমআইটি ও কর্নেল ইউনিভার্সিটির দুই মনোবিজ্ঞানীর গবেষণায় দেখা যায়, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) যথেষ্ট তথ্য ও যুক্তি দিয়ে কাউকে বোঝাতে পারলে ষড়যন্ত্রতত্ত্বে বিশ্বাস কমে যেতে পারে।

প্রথম গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে ‘সায়েন্স’ সাময়িকীতে। সেখানে হাজারেরও বেশি অংশগ্রহণকারী নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ওপর বিশ্বাস নিয়ে চ্যাটজিপিটি-৪ টার্বো নামের এক চ্যাটবটের সঙ্গে আলাপ করার পর গড়ে ২০ শতাংশের মতো বিশ্বাস কমে যায়।

এই চ্যাটবট তৈরি করেছে ওপেনএআই। গবেষণা চলাকালীন এই মডেল ২০২৩ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ইন্টারনেটে উপলব্ধ তথ্য ও জ্ঞান থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছিল।

আমেরিকান ইউনিভার্সিটির সহকারী অধ্যাপক এবং গবেষণার প্রধান লেখক টমাস কস্টেলো বলেন, ‘চ্যাটজিপিটি ইন্টারনেটের অসংখ্য নির্দিষ্ট তথ্য ব্যবহার করে মানুষের বিশ্বাস পরিবর্তন করতে পারে।’

গবেষকেরা অংশগ্রহণকারীদের মনে কোনো ষড়যন্ত্রতত্ত্ব জোর করে বসিয়ে দেননি। বরং, তাঁদের বলা হয়, এমন একটি উদাহরণ কল্পনা করতে এবং ব্যাখ্যা করতে, যেখানে কোনো শক্তিশালী গোষ্ঠী গোপনে ও খারাপ উদ্দেশ্যে কাজ করছে। এদের মধ্যে কিছু অংশগ্রহণকারীর উত্তর ষড়যন্ত্রতত্ত্বের ধরন মেনে চলেছিল। সেসব অংশগ্রহণকারীকে বলা হয়, ১ থেকে ১০ স্কেলে জানাতে, তাঁরা সেই তত্ত্বের ওপর কতটুকু বিশ্বাস করে।

এরপর চ্যাটজিপিটি যুক্তি ও তথ্যে সমৃদ্ধ বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপের মাধ্যমে তাঁদের বিশ্বাস ভাঙানোর চেষ্টা করে। আলাপের শেষে অংশগ্রহণকারীদের আবার জিজ্ঞেস করা হয়, তাঁরা এখন সেই তত্ত্বে কতটা বিশ্বাস করেন। এর দুই মাস পর আবার ফলোআপ করা হয়, যাতে বোঝা যায়, তাঁদের বিশ্বাসে কোনো স্থায়ী পরিবর্তন এসেছে কি না।

গবেষণায় দেখা যায়, এভাবে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে আলোচনার পর এক-চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারীর বিশ্বাসের মাত্রা ৫-এর নিচে নেমে এসেছে—অর্থাৎ, তাঁরা আগের তুলনায় বিশ্বাস হারিয়েছেন। তবে অন্য এক-চতুর্থাংশ অংশগ্রহণকারী কিছুটা দ্বিধায় রয়েছেন। কস্টেলো বলেন, ‘যাঁরা নিজেদের ষড়যন্ত্রতত্ত্বে খুব দক্ষ বলে মনে করতেন, তাঁদের মধ্যেও দ্বিধা দেখা গেছে।’

গবেষণাটি গণমাধ্যমে ব্যাপক আলোচিত হয়। ওয়াশিংটন পোস্টে মনোবিজ্ঞানী ও পোকার চ্যাম্পিয়ন অ্যানি ডিউক লেখেন, এআইয়ের সঙ্গে কথা বলার মানুষ বেশি খোলামেলাভাবে নিজের কথা বলতে পারে। ‍ কারণ এটি মানুষের মতো নয়, তাই পরিচয় বা আত্মমর্যাদার সংঘাত হয় না। তিনি বলেন, ‘এখানে আপনি এমন কাউকে বিপক্ষে পাচ্ছেন না, যার সঙ্গে তর্কে হারলে ব্যক্তিগত পরাজয় মনে হতে পারে।’

বিষয়টি আরও ভালোভাবে বোঝার জন্য নতুন একটি গবেষণা পরিচালনা করেন কস্টেলো ও তাঁর সহকর্মীরা। তবে এই গবেষণা এখনো পর্যালোচনার অপেক্ষায় আছে। সেখানে অংশগ্রহণকারীদের স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়, এআই (চ্যাটজিপিটি) তাদের বিশ্বাস ভুল প্রমাণ করার চেষ্টা করবে। একইভাবে, অংশগ্রহণকারীদেরও চেষ্টা করতে হবে এআই–কে বোঝাতে যে, তাঁদের বিশ্বাসই সঠিক।

এভাবে পুরো আলাপ এক ধরনের তর্ক বা প্রতিযোগিতার মতো হয়ে যায়, যেখানে দুই পক্ষেরই লক্ষ্য একে অন্যকে ভুল প্রমাণ করা। অর্থাৎ, পরিবেশটা আর বন্ধুত্বপূর্ণ বা নিরপেক্ষ ছিল না, বরং পক্ষপাতদুষ্ট ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক।

তবে ফলাফল আগের মতোই ছিল। অর্থাৎ, অংশগ্রহণকারীরা এআইয়ের অভিপ্রায় সম্পর্কে জানলেও তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা স্বীকার করেন। কস্টেলো বলেন, ‘আমাদের গবেষণায় দেখা যায়, মানুষ এআইয়ের ওপর বিশ্বাস রাখার জন্য নয়, বরং তথ্য গ্রহণ করায় তাদের ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নিয়ে বিশ্বাস বদলায়।’

তবে চ্যাটজিপিটির সঙ্গে কথা বললেই যে সবাই সহজে নিজের বিশ্বাস বদলে ফেলবেন—বিষয়টি এতটা সরল তা নয়।

প্রিন্সটনের কগনিটিভ বিজ্ঞানী কেরেম অকতার বলেন, অনেক বিশ্বাস মানুষের সামাজিক পরিচয়, ধর্ম, রাজনীতি বা পরিবারের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত থাকে। একে ‘ফাংকশনাল বিলিভ’ বা কার্যকরী বিশ্বাস’ বলে। এ ধরনের বিশ্বাস বদলাতে গেলে সামাজিক বা পারিবারিক বন্ধন ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

অকতার আরও বলেন, কিছু ‘অস্তিত্বগত বিশ্বাস’ আছে, যেমন—জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে সন্দেহকারীরা মনে করেন, আবহাওয়া এতটাই জটিল যে বিজ্ঞানের পক্ষে তা পুরোপুরি বোঝা সম্ভব নয়। এর ফলে তারা বিজ্ঞানের তথ্য ও ঐকমত্যকে অগ্রাহ্য করতে পারেন।

কস্টেলোও স্বীকার করেন, কেবল একটি চ্যাটজিপিটি আলাপেই সব ষড়যন্ত্রতত্ত্ব দূর হবে না। তবে তাঁদের গবেষণা এটুকু প্রমাণ করে, সঠিক তথ্য ও যুক্তি থাকলে মানুষের মত বদলানো সম্ভব। তাঁর কথায়, ‘যদি যথেষ্ট তথ্য দেওয়া যায়, বিশ্বাসীরা তাঁদের মতামত সংশোধন করতে পারেন।’

ডেস্ক: এস

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।