বিশ্ব কি আরেকটি মহামন্দা দেখতে যাচ্ছে?   - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ১:২৬, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

বিশ্ব কি আরেকটি মহামন্দা দেখতে যাচ্ছে?  

ADMIN, USA
প্রকাশিত মে ৬, ২০২০
বিশ্ব কি আরেকটি মহামন্দা দেখতে যাচ্ছে?  

তারেক শামসুর রেহমান :গেল এপ্রিলে করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের চার মাস পার হয়েছে। কিন্তু ভাইরাসটি পুরোপুরিভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলা যাবে না। পহেলা মে পর্যন্ত যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তাতে দেখা যায়, বিশ্বে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ৩৩ লাখ ৫ হাজার ৮০৬ জন। আর মারা গেছেন ২ লাখ ৩৩ হাজার ৯৬৬ জন, সুস্থ হয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন ১০৩৯১৪৪ জন (Worldometer)। সবচেয়ে যা আতঙ্কের তা হচ্ছে- এ ভাইরাসটি পৃথিবীর ২১০টি দেশ ও অঞ্চলকে আক্রান্ত করেছে।

স্প্যানিশ ফ্লু’র কথা আমরা ইতোমধ্যে জেনেছি। স্প্যানিশ ফ্লু দীর্ঘায়িত হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, ৩৬ মাস। ওই সময় ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যা ওই সময়ের বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিনভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় ১ কোটি ৭০ লাখ থেকে ৫ কোটি। বলা হয়, সমসাময়িককালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারী ছিল সেটা। এর একশ’ বছর আগে অটোমান সাম্রাজ্যের সময় ১৮১২-১৮১৯ সময়সীমায় প্লেগে মারা গিয়েছিলেন ৩ লাখ মানুষ। কিংবা শতাব্দীর মাঝামাঝি ১৯৫৭-১৯৫৮ সালে এশিয়ান ফ্লু’র কথাও আমরা জানি, যখন বিশ্বব্যাপী এ মহামারী ইনফ্লুয়েঞ্জায় (এইচ২এন২) মারা গিয়েছিলেন ১০ থেকে ৪০ লাখ মানুষ। ২০০৯-২০১০ সালে আরেক ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জার (এইচ১এন১) খবরও আমরা জানি, যা মহামারী আকারে বিশ্বের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিল এবং তাতে মারা গিয়েছিলেন ৫ লাখের ওপর মানুষ। এর অর্থ হচ্ছে- প্রকৃতিতে এ ধরনের ভাইরাস বারবার ফিরে আসে। কিন্তু এবারের করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব একটি ব্যতিক্রমধর্মী। ছড়িয়ে গেছে বিশ্বের প্রতিটি অঞ্চলে। এখন যে প্রশ্নটি উঠেছে, তা হচ্ছে এর প্রতিক্রিয়ায় বিশ্ব কি আরেকটি মন্দা প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছে? ইতোমধ্যে গবেষকরা সম্ভাব্য একটি অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের কথা বলেছেন। উৎপাদন ব্যবস্থায় ধস, বেকার সমস্যা বৃদ্ধি পাওয়া, জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাসের যে চিত্র অর্থনীতিবিদরা উপস্থাপন করেছেন, তা বিভিন্ন দেশের সরকারপ্রধানদের চিন্তার খোরাক জোগাবে যথেষ্ট। বাংলাদেশও এর বাইরে থাকবে না। বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদেরও দীর্ঘমেয়াদি স্ট্র্যাটেজি গ্রহণ করতে হবে।

আমরা করোনাভাইরাসজনিত সংকটকে ১৯৩০-এর দশকের মহামন্দার (Great depression) সঙ্গে তুলনা করতে পারি। এ মহামন্দায় আক্রান্ত হয়েছিল যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেট। তারপর তা সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। আর এর সূত্র ধরেই জার্মানিতে হিটলারের উত্থান ঘটে, যার পরিণামে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূত্রপাত হয়। শিল্পোন্নত দেশগুলোর জন্য এটা ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, যা স্থায়িত্ব পায় ১৯২৯ থেকে ১৯৩৯ সাল পর্যন্ত। ১৯২৯ সালের অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটের পতনের পরই এ মহামন্দার সূত্রপাত হয়। স্টক মার্কেটের পতনের মধ্য দিয়ে লাখ লাখ বিনিয়োগকারী মুহূর্তের মধ্যে নিঃস্ব হয়ে যান, তারা সবকিছু হারিয়ে গরিব হয়ে যান। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে অনেক কোম্পানি বন্ধ হয়ে যায় এবং হাজার হাজার লোক বেকার হয়ে যায়। শিল্প উৎপাদনে ধস নামে। ১৯৩৩ সালের হিসাব অনুযায়ী, প্রায় ১৫ মিলিয়ন অর্থাৎ দেড় কোটি মানুষ বেকার হয়ে যায় এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্ধেক ব্যাংক দেউলিয়া হয়ে যায়। এখানে বলা প্রয়োজন যে, ১৯২০ সালের দিকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যথেষ্ট বৃদ্ধি পেয়েছিল এবং ওই সময় অর্থাৎ ১৯২০ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। অনেকে ওই সময়টাকে চিহ্নিত করেন ‘The Roaring Twenties’ হিসেবে। যুক্তরাষ্ট্রের স্টক মার্কেটের মূল কেন্দ্র ছিল নিউইয়র্কে। অর্থনীতিতে গতি আসায় বড় বড় পুঁজিপতিরাসহ সাধারণ মানুষও স্টক মার্কেটে প্রচুর বিনিয়োগ করেন। ফলে স্টক মার্কেটের আকার বৃদ্ধি পেয়ে ১৯২৯ সালে সর্বোচ্চ পর্যায়ে উপনীত হয়েছিল। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল শিল্পোৎপাদনে। উৎপাদন কমতে থাকল, বাড়তে থাকল বেকার সমস্যা। এতে স্টক মার্কেটে নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার আসল মূল্যের চেয়ে অনেক বেড়ে গেল। অথচ শিল্পগুলো কর্মীদের বেতন কমাতে থাকল আর সাধারণ মানুষের পক্ষে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস ক্রয় করা কঠিন হয়ে দাঁড়াল। একই সময় প্রচণ্ড খরায় আক্রান্ত হল কৃষি। কৃষকরা উৎপাদিত পণ্যের দাম পাচ্ছিলেন না। ব্যাংকগুলো যেসব ঋণ দিয়েছিল, তা আদায় করতে পারছিল না। আমেরিকার অর্থনীতি ধীরে ধীরে মন্দার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। মানুষ তার ক্রয়ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল। শিল্পে উৎপাদিত পণ্য বিক্রি হচ্ছিল না এবং তা জমা হতে থাকল। বাধ্য হয়ে অনেক শিল্পপ্রতিষ্ঠান তাদের উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও স্টক মার্কেটের শেয়ারের দাম বেড়ে যাচ্ছিল। এরকম পরিস্থিতিতে ১৯২৯ সালের ২৪ অক্টোবর বিনিয়োগকারীরা পাগলের মতো দ্রুত তাদের শেয়ার অতিমূল্যে বিক্রি করে দিচ্ছিলেন। ফলে স্টক মার্কেট ক্রাশ করে। ওই একদিনে ১২ দশমিক ৯ মিলিয়ন অর্থাৎ ১ কোটি ২৯ লাখ শেয়ার ‘হাত বদল’ হয়েছিল। এজন্য ওইদিনকে বলা হয় ‘Black Thursday’। মানুষের মাঝে এমনভাবে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছিল যে, এক সপ্তাহের মাথায় ২৯ অক্টোবর (Black Thursday) আবার ১ কোটি ৬০ লাখ শেয়ার হাতবদল হয়েছিল। অনেক শেয়ার মূল্যহীন হয়ে গেল, শুধু একখণ্ড কাগজে পরিণত হল। অনেক বিনিয়োগকারী মুহূর্তের মধ্যে ‘রাস্তার ফকির’ হয়ে গেল। এর ধাক্কা গিয়ে লাগল বিভিন্ন শিল্পপ্রতিষ্ঠানে। এদের অনেকেই ঋণ নিয়ে শিল্পপ্রতিষ্ঠান করেছিলেন। তারা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিক্রি করতে না পারায়, ফ্যাক্টরিগুলো ‘লে-অফ’ ঘোষণা করল, কর্মীদের একসঙ্গে ছাঁটাই করতে শুরু করল। ফলে এক ধরনের ‘পেনিক’ এর সৃষ্টি হল। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র। যারা ওই সময় টিকে থাকতে পারল, তারা কর্মীদের বেতন অনেক কমিয়ে দিল। ফলে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা অনেক কমে গেল। ফলে অনেক আমেরিকান নাগরিক গরিব হয়ে গেল, ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়ল, ঋণ করে তাদের সংসার চালাতে হতো। এমনকি তাদের পক্ষে সম্ভবও ছিল না ঋণ পরিশোধ করার। এমনকি এক পরিস্থিতিতে ১৯৩৩ সালের ৫ জুন কংগ্রেস একটি আইন পাস করে, যাতে স্বর্ণকে বিনিময় মুদ্রা ব্যবহারের যে নীতি, তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। জনসাধারণের কাছে যেসব স্বর্ণমুদ্রা ছিল, তা ফেডারেল ব্যাংকে জমা দিতে বলা হয়। ১৮৭৯ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র মুদ্রার বিনিময় মূল্য হিসেবে সোনা ব্যবহার করে আসছিল। জমা দেয়া সোনার মুদ্রা বিনিময় অর্থও নির্ধারণ করে দেয়া হয় (এক আউন্স ২০.৬৭ ডলার)। ১০ মে’র মধ্যে সরকার ৩০ কোটি ডলারের সমমানের স্বর্ণমুদ্রা ও ৪ কোটি ৭০ লাখ ডলার সমমানের স্বর্ণ সার্টিফিকেট (Gold Certificate) বাজার থেকে তুলে নেয়। ১৯৩৪ সালে সরকার স্বর্ণের নতুন বিনিময় হার (এক আউন্স ৩৫ ডলার) নির্ধারণ করে দেয়। স্বর্ণের এ মুদ্রামান ১৯৭১ সাল (১৫ আগস্ট) পর্যন্ত বহাল ছিল। ওই সময়ের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এক ঘোষণায় বলা হয়েছিল স্বর্ণের জন্য যে নির্ধারিত মূল্য, তা যুক্তরাষ্ট্র আর মেনে চলবে না। এটাকে বলা হতো Gold Stadard, যা বাতিল হয়ে যায়।

মহামন্দার সময় যুক্তরাষ্ট্রের বেকার সমস্যা চরমে উঠেছিল। ১৯৩০ সালে ৪০ লাখ মানুষ কাজ খুঁজলেও, কোনো কাজ তারা পায়নি। ১৯৩১ সালে এ সংখ্যা ৬০ লাখে গিয়ে উপনীত হয়েছিল। বেকার সমস্যা তখন চরমে উঠেছিল আর শিল্পে উৎপাদন অর্ধেক কমে গিয়েছিল, তখন সর্বত্র Soup kitchens (বিনামূল্যে রুটি ও স্যুপ বিতরণ) চালু হয়েছিল। কৃষি ক্ষেত্রে চরম অরাজকতা বিরাজ করায়, কৃষিতে কোনো ‘কাজ’ না থাকায় উপরন্তু খরা দেখা দেয়ায় ব্যাপক সংখ্যক কৃষিজীবী মানুষ শহরে আসতে থাকল। ব্যাপক সংখ্যক মানুষের কৃষি ফার্ম ত্যাগ করার ঘটনাকে আখ্যায়িত করা হয়েছে Dust Bowl হিসেবে।

মহামন্দার বিষয়টি আমরা আলোচনা করলাম এ কারণে যে খোদ মার্কিন মিডিয়ায়ই বলা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান পরিস্থিতি আজ সেদিকেই যাচ্ছে! মহামন্দা না হলেও এ ধরনের মন্দায় পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ঘুরেফিরে তাই মহামন্দার কথাটাই আসছে। কয়েক লাখ মানুষ সেখানে বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছেন। অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। হোটেল, রেস্টুরেন্টের মতো ছোট ছোট ব্যবসায় বড় ধরনের ধস নেমেছে। প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প এপ্রিলের শেষের দিকে ছোট ছোট ব্যবসা খুলে দেয়ার একটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বটে; কিন্তু তারা আদৌ ‘কাস্টমার’ পাবে কিনা, তাতে রয়েছে নানা সন্দেহ। হাসপাতালগুলোর পরিস্থিতি উন্নতির চেষ্টা করা হচ্ছে। হাসপাতালগুলো এখনও ভেন্টিলেটর সংকটে আছে। রাশিয়ার কোনো কোনো কোম্পানির ওপর ট্রাম্প প্রশাসন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও তারাই এখন যুক্তরাষ্ট্রে ভেন্টিলেটর সরবরাহ করছে। জার্মানির জন্য পাঠানো মাস্ক যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক হাইজ্যাক করার ঘটনাও সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছে। নিউইয়র্ক শহরে কবর দেয়ার জায়গাও নেই, তাই রাজ্য সরকার Staten দ্বীপটি বেছে নিয়ে সেখানে গণকবর দিচ্ছে। বিশ্বের বড় অর্থনীতির দেশের এ পরিস্থিতি কি কল্পনা করা যায়? তাই নোয়াম চমস্কি মন্তব্য করেছেন, কোভিড-১৯ শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রকে একটি ‘ব্যর্থ রাষ্ট্রে’ পরিণত করেছে।

করোনাভাইরাসের কারণে ইতোমধ্যে বিশ্বব্যাপী ১৯৫ মিলিয়ন মানুষ চাকরি হারিয়েছে। প্রতি ৫ জন মানুষের মাঝে ৪ জন চাকরি ঝুঁকিতে আছে। যুক্তরাষ্ট্রের অর্থবছরে প্রথম কোয়ার্টারে অর্থনীতি ৪ দশমিক ৮ ভাগ সংকুচিত হয়েছে। অর্থাৎ জিডিপি প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেয়েছে। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে অর্থাৎ এপ্রিল-জুনে বড় ধরনের অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। ৩৮ লাখ লোক বেকার ভাতার জন্য আবেদন করেছে। একটা মহামন্দা অনিবার্য। এ মহামন্দায় আক্রান্ত হবে গোটা বিশ্ব। আইএমএফ বলছে, এ বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে দরকার হবে ২ দশমিক ৫ ট্রিলিয়ন ডলার। এ অর্থ বিশ্বের সামগ্রিক অর্থনীতিকে আদৌ আগের জায়গায় ফিরিয়ে আনতে পারবে কি না, সেটাই এখন বড় প্রশ্ন।

ড. তারেক শামসুর রেহমান : প্রফেসর ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।