রশীদ জামীলঃ
হুজুর! আমার বাবা তিনদিন থেকে সাকরাতে আছেন, খুব কষ্ট হচ্ছে। জানটা আরামের বের হয়ে যাওয়ার জন্য জলদি একটা তাবিজ দেন। হুজুর! অনেক গুনাহ করে ফেলেছি। একটি তাবিজ দেন, যাতে সব গুনাহ মাফ হয়ে যায়। শুনেছি কবরের আজাব বড় মারাত্মক। আমাকে এমন কোনো তাবিজ দেন, যে তাবিজ ব্যবহার করলে আমি কবরের আজাব থেকে মুক্তি পেতে পারি, অথবা এমন একটি তাবিজ দেন, যেটি গলায় ঝুলিয়ে পুলসিরাত পার হতে পারি— আমি আমার জীবনে এভাবে কাউকে বলতে শুনিনি। তাহলে সমস্যাটা আসলে কোথায়?
মানুষ তাবিজ ব্যবহার করে দুনিয়াবি সমস্যার কারণে। হতে পারে সেটা শারীরিক সমস্যা, বা পারিবারিক অথবা সামাজিক। মানসিকও হতে পারে। আর এসব সমস্যার সমাধানে তাবিজ দেওয়া হয় মেডিসিন হিশেবে। সুতরাং যেসব দলিলে মেডিসিন জায়েজ, সেসব দলিল তাবিজের বেলায় সামনে আসবে না কেন?
মেডিসিন একটি উপকরণ। বাহ্যিক রূপ আছে। কিন্তু তাবিজ তো জাস্ট কিছু অক্ষর। তাহলে মেডিসিনের সঙ্গে তাবিজকে কীভাবে তুলনা করা চলে—আজ থেকে 20/30 বছর আগে এমন প্রশ্ন করলে বোঝানো মুশকিল হতো। কিন্তু এই সময়ে, একুশ শতকে মেডিক্যাল সাইন্স যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তাতে মাঝারি মেধার মানুষকেও ব্যাপারটি চট করে বুঝিয়ে দেওয়া সম্ভব। চিকিৎসার জন্য শরিয়তসম্মত পন্থায় তাবিজ বা ঝাড়ফুঁকও যে একটি বিজ্ঞানসম্মত ব্যাপার, হিপনোটিজম, আকুপাংচার, মেডিটেশন বা হেলুসিনেশনের মতো ব্যাপারগুলোই তার প্রমাণ।
সমস্যা হল কোনটা দ্বীনের কাজ আর কোনটা দুনিয়ার— সেটা বুঝতে আমরা তালগুল পাকিয়ে ফেলি। যে কারণে পকেটে তৈরি করা থাকে রকমারি ফতওয়া। বিতরিত হতে থাকে, যত্রে এবং তত্রে, পাত্রে অথবা অপাত্রে।
যে কাজের লাভ-ক্ষতির সম্পর্ক মৃত্যুর পরের জীবনের সাথে, আখিরাতে যে কাজের একাউন্টেবিলিটি আছে, সেটা হল দ্বীনের কাজ। যেমন, নামাজ-রোজা, হজ্জ-জাকাত, হালাল-হারাম ইত্যাদি।
আর যেসব কাজের সম্পর্ক মৃত্যু পর্যন্ত জীবনের সাথে, আখিরাতে যে কাজের কোনা পুরস্কারও নেই, আজাবও নেই- সেটা হল দুনিয়ার কাজ। যেমন, জ্বর উঠলে নাপা এক্সট্রা খেলেন নাকি প্যারাসিটামল- এ ব্যাপারে কিয়ামতের দিন প্রশ্ন করা হবে না। এটা দুনিয়াবি কাজ। আলু ভর্তা করে খেলে সওয়াব বেশি, নাকি তরকারিতে দিয়ে- এই প্রশ্ন অবান্তর। খাক যার যেমন খুশি। এটা দুনিয়ার কাজ। গরুর মাংস শুটকি দিয়ে রান্না করে খাওয়া জায়েজ হবে কি না- এটা ফতওয়ার বিষয় না। এভাবে কেউ খায় কি না অথবা কারো রুচি এমন কি না- সেটা ভিন্ন বিষয়।
ব্যথানাশক ইনজেকশন বা ট্যাবলেটে এমন অনেক উপকরণ ইউজ করা হয় যা শরিয়াহসম্মত নয়। তবুও আমরা মেডিসিন হিশেবে সেটা ব্যবহার করি। এখানে কেউ ফতওয়া দিতে যাই না।
তার মানে এই না যে, হালাল-হারামের ধার না ধেরে অথবা শরিয়াহ-নিষিদ্ধ উপায় বা উপকরণ ব্যবহার করে তাবিজ দেওয়াকে জায়েজ বলবার চেষ্টা করা হচ্ছে! কিন্তু শরিয়াহসিদ্ধ দুআ-দুরুদ লিখে তাবিজ দিলে এটা নিয়ে কিতাব টানাটানির করতে হবে কেন?
আমরা যারা বড় বড় কিতাব ঘাটাঘাটি করতে পারি না, তারা ছোট্ট একটা কাজ করেত পারি। সদ্য অথবা সাবেক- কোনো শায়খ যখন বলবেন, তাবিজ ব্যবহার করা যাবে না, এটা শিরক, তখন তাকে বলতে পারি, শায়খ! তাবিজ যদি কোরআনের আয়াত দ্বারা লিখা হয়? শায়খ বলবেন, সেটাও বৈধ হবে না। হারাম। শিরক।
তারপর…
—আচ্ছা শায়খ। বুঝার জন্য বলছি। কোরআনের আয়াত কাগজে লেখা কি জায়েজ?
— অবশ্যই জায়েজ।
—আয়াত লেখা কাগজ যদি ঘরের দেয়ালে লাগিয়ে রাখা হয়?
—সমস্যা নাই।
—যদি ফ্রেইম করে লিভিংরুমে ঝুলিয়ে রাখি- অসুবিধা আছে?
—অসুবিধা থাকবে কেন?
এবার যথেষ্ট থেকে আরেকটু বেশি বিনয়ী হওয়ার চেষ্টা করে বলুন, শায়খ! কোরআনের আয়াত কাগজে লিখে রাখা জায়েজ, সেই কাগজ দেয়ালে লাগিয়ে রাখা জায়েজ, সেই কাগজ ঘরের দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা জায়েজ… কিন্তু গলায় ঝুলিয়ে নিলে শিরক— ব্যাপারটি কি একটু বুঝিয়ে বলবেন?
ইলাইহিল ওয়াসিলা
পৃষ্ঠা নং : ১১৯
প্রকাশিতব্য : জুলাই ২০২১
প্রকাশ করছে : কালান্তর প্রকাশনী
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।