আইএমএফের শর্তের ব্যাপারে যে কারণে সাবধানতা জরুরি - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, রাত ১:৪২, ২৯শে মার্চ, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

আইএমএফের শর্তের ব্যাপারে যে কারণে সাবধানতা জরুরি

banglanewsus.com
প্রকাশিত নভেম্বর ১৪, ২০২২
আইএমএফের শর্তের ব্যাপারে যে কারণে সাবধানতা জরুরি

ড. আশেক মাহমুদ :: দুই দুটি বিশ্বযুদ্ধ আর ১৯৩০ সালের বৈশ্বিক মহামন্দা ইউরোপের পুঁজিবাদী অর্থনীতিকে এক কঠিন পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেয়। এমনি সংকটাপন্ন অবস্থায় ইউরোপ-আমেরিকা সংঘবদ্ধ হয়ে উন্নয়নের এক নতুন রূপরেখা প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) আর বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার (ডব্লিউটিও) মতো বৈশ্বিক সংস্থাগুলো সারা বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক পুনর্বিন্যাসের প্রজেক্ট হাতে নেয়। দারিদ্র্যমুক্ত বিশ্ব গঠন, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা মোকাবেলা এবং টেকসই বৈশ্বিক অর্থনীতি বিনির্মাণের স্লোগান নিয়ে এসব প্রভাবশালী সংস্থা অর্থনৈতিক সংস্কারে হাত দেয়। বাংলাদেশও অন্য অনেক দেশের মতো বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন কার্যক্রমে নিজেকে যুক্ত করে। যদিও বাংলাদেশ বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে ঋণ নিয়ে বিনিয়োগ কার্যক্রম চালিয়ে আসছে, আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ নেয়ার প্রবণতা সে তুলনায় কম।
বিশ্বব্যাংক প্রতিটি দেশে ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে সব সময় সুনির্দিষ্ট শর্ত আরোপ করে, সে শর্তগুলো মেনে উন্নয়ন নিশ্চিত করতে গ্রাহক দেশকে অনেক বেগ পেতে হয়। সে তুলনায় আইএমএফের কাছ থেকে বড় অঙ্কের ঋণ নিতে হলে একটা দেশকে আরো অনেক বেশি ভাবতে হবে। হয়তো এজন্য যে, আইএমএফের পক্ষ থেকে যে শর্ত আরোপ করা হয় তা মেনে নিয়ে জনবান্ধব অর্থনীতি নির্মাণ করতে বহু দেশকে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছে। বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ জোসেফ স্টিগলিজ তার ‘বিশ্বায়ন ও এর অসন্তোষ’ নামক গবেষণাগ্রন্থে তথ্য-উপাত্ত দিয়ে প্রমাণ করেন যে, আইএমএফের কাছ থেকে যেসব দেশ শর্তাধীনে ঋণ নিয়েছে সেসব দেশ তাদের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে পারেনি। এর ফলে আইএমএফের টেকসই অর্থনীতি নির্মাণের প্রতিজ্ঞা ভেঙে পড়ে।
তবু একটা দেশ যখন আর্থিক সংকটের মধ্যে পড়ে অথবা বিনিয়োগের জন্য অর্থের প্রয়োজন দেখা দেয়, তখন ঋণদাতা সংস্থার প্রতি শরণাপন্ন হওয়ার প্রবণতা সৃষ্টি হয়। সে প্রবণতা থেকে বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের দিকে অনেক দেশ ঝুঁকে পড়ে। এর আগেও আমরা আইএমএফের কাছ থেকে ১০০ কোটি ডলারের বেশি ঋণ নিইনি। কারণ আইএমএফের শর্তগুলো বিশ্বব্যাংকের তুলনায় আরো বেশি কঠিন। সবচেয়ে বড় কথা, আইএমএফ ঋণছাড়ের আগে বড় ধরনের সংস্কারের জন্য চাপ প্রয়োগ করে, এমনকি ঋণ পরিশোধের সময়সীমা সীমিত করে দেয়। ভ্যাটনীতি আইএমএফের শর্ত থেকেই এসেছিল। এবার যখন আইএমএফের কাছ থেকে ৪৫০ কোটি মার্কিন ডলার ঋণ নেয়ার আগ্রহ প্রকাশ করা হয়, তখনই আইএমএফ দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সংস্কার আনতে শর্ত জুড়ে দেয়।
আইএমএফের শর্তের প্রধান যেসব দিক জানতে পারি তার মধ্যে অন্যতম হলো: ১) ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিতে হবে, এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ থাকবে না ২) তেল, গ্যাস, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমাতে হবে ৩) লোকসানি সংস্থাগুলোকে ভর্তুকির আওতা থেকে মুক্ত করে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দিতে হবে ৪) সরকারি বিনিয়োগ, রাজস্ব আদায় ও রাজস্ব ঝুঁকির তথ্য আইএমএফকে দিতে হবে ৫) আয়কর, ভ্যাট ও শুল্ক এ তিন খাতে কর অব্যাহতি কমাতে হবে ৬) ব্যাংক পরিচালনায় আমলানির্ভরতা কমাতে হবে ৭) সুদের হারের সীমা তুলে দিতে হবে ৮) সঞ্চয়পত্রে সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। এক্ষেত্রে প্রণোদনাসূচক ভর্তুকি বাদ দিতে হবে।
এসব শর্ত দেখে মনে হচ্ছে, আমরা শুধু অর্থনৈতিক চাপে আছি তা নয়; আমরা এখন আইএমএফের শর্তের চাপেও আছি। সব শর্তের একটা প্রধান দিক হলো—সরকারের বাজেট ঘাটতি কমানো, প্রতিষ্ঠানের বেসকারীকরণ ও অনিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থাপনা। মূলত আইএমএফ এ তিন মূলনীতির ভিত্তিতে অর্থনৈতিক সংস্কার চায়, সে আলোকে শর্তাবলি তুলে ধরে। এ প্রক্রিয়ায় সরকারের পরিচালনা ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে আর পুঁজিবাদী অর্থনীতি অসম নীতির মানদণ্ডে আলাদা একটা গতি পায়। স্বাভাবিকভাবে সরকারের নীতি হলো, অর্থনীতিকে রাজনৈতিক মানদণ্ডে পরিচালিত করা; অন্যদিকে আইএমএফের নীতি হলো পুঁজিবাদী অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণে রাজনীতিকে পরিচালিত করা। সে কারণে সরকারি রাজনৈতিক শক্তি আইএমএফের শর্তাবলির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করতে পারে না।
যেমন ডলারের দাম বাজারের হাতে ছেড়ে দিলে ডলারকেন্দ্রিক মুনাফা বাড়বে, টাকার অবমূল্যায়নও বাড়বে। রফতানিনির্ভর অর্থনীতিতে এটাকে সামাল দেয়া যায়, কিন্তু আমদানিনির্ভরতা বেশি হলে হিতে বিপরীত হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক এক্ষেত্রে ডলারের দামে নিয়ন্ত্রণ আনতে পারলে বিলাসী পণ্যের আমদানি কমে যাবে আর অতিপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি খরচ আরো কমাতে সক্ষম হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্ক কমাতে পারলে দ্রব্যমূল্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখার সুযোগ থাকে। কিন্তু আইএমএফের শর্তমতে যদি সরকারি প্রণোদনা কমানো হয়, সেক্ষেত্রে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি খরচ বাড়বে। ভুক্তভোগী হবে সাধারণ মানুষ।
শুধু তা-ই নয়, সঞ্চয়পত্রে যদি সরকারি প্রণোদনা হ্রাস করা হয়, সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ আরো কমে যাবে। এমনিতেই চলতি অর্থবছরের প্রথম তিন মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ কমেছে প্রায় সাড়ে ২৬ শতাংশ। সরকারি প্রণোদনা সরানো হলে পুঁজিবাজারের গ্রাসে সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ তলানিতে চলে আসবে। এ প্রক্রিয়ায় ঋণের জন্য সরকারের বিদেশনির্ভরতা আরো বাড়বে। আর সুদের সীমা তুলে দিলে নিজে দেশের শিল্প-কারখানায় বিনিয়োগ কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এমনিতেই জ্বালানি তেলের ওপর থেকে ভর্তুকি সরানোর পরিপ্রেক্ষিতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে গেছে। এর সঙ্গে যদি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও সারের ওপর সরকারের ভর্তুকি উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমানো হয়, মূল্যস্ফীতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে? গ্যাস, বিদ্যুৎ, আর সারে যদি ভর্তুকি কমানো হয়—দেশের শিল্প-কারখানা থেকে উৎপাদন আরো কমে যাবে; সময়মতো বেতন না পেলে শ্রমিকদের অসন্তোষ আরো বাড়বে। এমনকি কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে, কৃষিপণ্যের দাম আরো বাড়বে। ফলে জনগণের সঙ্গে সরকারের রাজনৈতিক দূরত্ব বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটা ঠিক, আয়কর বাড়ানোর ক্ষেত্রে রাজস্ব বিভাগকে আরো বেশি তত্পর হতে হবে। আয়ের মাত্রা অনুযায়ী আয়কর বাড়ানোর মধ্যে যুক্তি আছে। কিন্তু উচ্চ আয়ের মানুষের মধ্যে আয়কর ফাঁকি দেয়ার যে সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে তা শক্ত হাতে উচ্ছেদ করতে পারলে সরকারের রাজনৈতিক স্বচ্ছতা আরো সুদৃঢ় হবে। অন্যদিকে ভ্যাটের হার বাড়ানো হলে মূল্যস্ফীতি আরো বাড়বে। তবে ভ্যাটের হারের ক্ষেত্রে বিলাসীপণ্য আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মধ্যে পার্থক্য আনতে পারলে জনগণই লাভবান হবে। অথচ সেদিকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে না।
অন্যদিকে লোকসানি সংস্থাগুলোকে বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয়ার মধ্যে পুঁজিবাদী স্বার্থ রক্ষিত হবে ঠিকই, কিন্তু জনগণ এর সুফল কতটুকু পাবে? এটা সত্য, রাষ্ট্রায়ত্ত ১০টি প্রতিষ্ঠানের লোকসান যদি প্রায় ৫ হাজার কোটি টাকা গুনতে হয়, তার একটা সমাধান অবশ্যই প্রয়োজন। তাই বলে পিডিবি, টিসিবি, বিআরটিএর মতো সেবা খাতগুলোকে বেসরকারীকরণের মানেই হলো সাধারণ জনগণের অধিকার ও স্বার্থের দিককে গুরুত্বহীন করা। বরং কীভাবে এসব প্রতিষ্ঠানকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষা করা যায় তার জন্য বাস্তবমুখী কৌশল প্রণয়ন জরুরি। ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানগুলোকে আমলাদের প্রভাব থেকে রক্ষা করা যেমন দরকার, তেমনি প্রয়োজন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর সংস্কার। সংস্কার মানে ব্যবস্থাপনাকে কীভাবে দক্ষতা, যোগ্যতা আর জবাবদিহির ভিত্তিতে সাজানো সম্ভব সে পরিকল্পনা গ্রহণ করা। সে লক্ষ্যে প্রাতিষ্ঠানিক দুর্নীতির মাত্রা কমানোর ব্যাপারে তদারকি ও বিচার ব্যবস্থাকে আরো বেশি স্বচ্ছতা ও নৈতিকতাসম্পন্ন করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা ও নেতৃত্বে গুণগত পরিবর্তন সাধন অত্যাবশ্যক। অথচ আইএমএফ এ ধরনের জনবান্ধব নীতির বাস্তবায়নকে গুরুত্ব দিচ্ছে না। কেননা আইএমএফ চায় দেশকে বহুজাতিক কোম্পানির বাজারে পরিণত করতে, দেশের সম্পদ বিদেশে সঞ্চালন করতে আর সুদসহ ঋণের অঙ্ক দ্রুততার সঙ্গে আদায় করতে।
জনগণের অধিকারকে অগ্রাধিকার দেয়া সাপেক্ষে আইএমএফের কঠিন শর্ত নিয়ে রাজনৈতিক আলোচনা অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। আইএমএফের সঙ্গে চূড়ান্ত বৈঠকের আগে কয়েক দফা আন্তঃমন্ত্রণালয় আলোচনা, দেশের উচ্চমানের অর্থনীতিবিদ, রাজনীতি বিশেষজ্ঞ, সমাজতত্ত্ববিদ, নগরবিশেষজ্ঞ, কৃষিবিজ্ঞানীসহ সিভিল সোসাইটির উচ্চমানসম্পন্ন বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে আলোচনা করা অত্যাবশ্যক। আমাদের খুব সতর্কতার সঙ্গে দেশের স্বাধীনতা ও জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে পথ চলতে হবে। যেকোনো কঠিন পরিস্থিতি মোকাবেলার সামর্থ্য আমরা নিজেরাই অর্জন করতে সক্ষম। এ দৃঢ়তাই আমাদের স্বাধীনতার মূল চাবিকাঠি।

ড. আশেক মাহমুদ: সহযোগী অধ্যাপক, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।