রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ (পর্ব -০১) - BANGLANEWSUS.COM
  • নিউইয়র্ক, বিকাল ৩:৪৬, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ


 

রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ (পর্ব -০১)

banglanewsus.com
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৪
রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশ (পর্ব -০১)

আবুল কালাম আজাদ :: ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত, আদিবাসী রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীদের নিয়ে বিভিন্ন লেখকের বইপুস্তক পড়ে, ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক এই জাতি সম্পর্কে যত জেনেছি ততই বিস্মিত হয়েছি। মায়ানমার সরকার কর্তৃক নির্যাতিত ও বিতাড়িত এই জাতি বর্তামানে বাংলাদেশের জন্য গলার কাটা হিসেবেই আটকে রয়েছে। পাঠকদের সুবিধার্থে রোহিঙ্গাদের নিয়ে কয়েকটি পর্ব সাজিয়েছি, যেখানে থাকবে রোহিঙ্গাদের ইতিহাস, মায়ানমার সহ বিভিন্ন দেশ থেকে নির্যাতনের শিকার হয়ে বিতাড়িত হওয়া, বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের ভবিষ্যত, রোহিঙ্গা সংকট নিরষনে করণীয় ইত্যাদি। তাহলে চলুন আজকের পর্ব শুরু করি-

অষ্টম শতাব্দীতে আরবদের আগমনের মধ্য দিয়ে আরাকানে মুসলমানদের বসবাস শুরু হয়। আরব বংশোদ্ভূত এই জনগোষ্ঠী মায়্যু সীমান্তবর্তী অঞ্চলের (বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের নিকট) চেয়ে মধ্য আরাকানের নিকটবর্তী ম্রক-ইউ এবং কাইয়্যুকতাও শহরতলীতেই বসবাস করতে পছন্দ করতো। এই অঞ্চলের বসবাসরত মুসলিম জনপদই পরবর্তীকালে রোহিঙ্গা নামে পরিচিতি লাভ করে।

রোহিঙ্গা আদিবাসী জনগোষ্ঠী পশ্চিম মায়ানমারের রাখাইন রাজ্যের একটি উলেখযোগ্য নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী। এরা ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত। রোহিঙ্গাদের আলাদা ভাষা থাকলেও তা অলিখিত। মায়ানমারের আকিয়াব, রেথেডাং, বুথিডাং মংডু, কিয়ক্টাও, মাম্ব্রা, পাত্তরকিল্লা এলাকায় এদের বাস। ২০১২ সালের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৮,০০,০০০ রোহিঙ্গা মায়ানমারে বসবাস করে। মায়ানমার ছাড়াও ৫ লক্ষের অধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে এবং প্রায় ৫লাখ সৌদিআরবে বাস করে বলে ধারনা করা হয়। যারা বিভিন্ন সময় বার্মা সরকারের নির্যাতনের কারণে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। জাতিসংঘের তথ্যমতে, রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নির্যাতিত জনগোষ্ঠী।

রোহিঙ্গা কারা?
বর্তমান মিয়ানমারের রোহিং (আরাকানের পুরনো নাম) এলাকায় এ জনগোষ্ঠীর বসবাস। ইতিহাস ও ভূগোল বলছে, রাখাইন প্রদেশের উত্তর অংশে বাঙালি, পার্সিয়ান, তুর্কি, মোগল, আরবীয় ও পাঠানরা বঙ্গোপসাগরের উপকূল বরাবর বসতি স্থাপন করেছে। তাদের কথ্য ভাষায় চট্টগ্রামের স্থানীয় উচ্চারণের প্রভাব রয়েছে। উর্দু, হিন্দি, আরবি শব্দও রয়েছে। রাখাইনে দুটি সম্প্রদায়ের বসবাস ‘মগ’ ও ‘রোহিঙ্গা’। মগরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। মগের মুল্লুক কথাটি বাংলাদেশে পরিচিত। দস্যুবৃত্তির কারণেই এমন নাম হয়েছে ‘মগ’দের। এক সময় তাদের দৌরাত্ম্য ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। মোগলরা তাদের তাড়া করে জঙ্গলে ফেরত পাঠায়।

রোহিঙ্গাদের সম্পর্কে একটি প্রচলিত গল্প রয়েছে এভাবে_ সপ্তম শতাব্দীতে বঙ্গোপসাগরে ডুবে যাওয়া একটি জাহাজ থেকে বেঁচে যাওয়া লোকজন উপকূলে আশ্রয় নিয়ে বলেন, আল্লাহর রহমে বেঁচে গেছি। এই রহম থেকেই এসেছে রোহিঙ্গা।

তবে,ওখানকার রাজসভার বাংলা সাহিত্যের লেখকরা ঐ রাজ্যকে রোসাং বা রোসাঙ্গ রাজ্য হিসাবে উল্লেখ করেছেন।

তবে ইতিহাস এটা জানায় যে, ১৪৩০ থেকে ১৭৮৪ সাল পর্যন্ত ২২ হাজার বর্গমাইল আয়তনের রোহিঙ্গা স্বাধীন রাজ্য ছিল। মিয়ানমারের রাজা বোদাওফায়া এ রাজ্য দখল করার পর বৌদ্ধ আধিপত্য শুরু হয়।

এক সময়ে ব্রিটিশদের দখলে আসে এ ভূখণ্ড। তখন বড় ধরনের ভুল করে তারা এবং এটা ইচ্ছাকৃত কিনা, সে প্রশ্ন জ্বলন্ত। তারা মিয়ানমারের ১৩৯টি জাতিগোষ্ঠীর তালিকা প্রস্তুত করে। কিন্তু তার মধ্যে রোহিঙ্গাদের নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল না। এ ধরনের বহু ভূল করে গেছে ব্রিটিশ শাসকরা।

১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি মিয়ানমার স্বাধীনতা অর্জন করে এবং বহুদলীয় গণতন্ত্রের পথে যাত্রা শুরু হয়। সে সময়ে পার্লামেন্টে রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিত্ব ছিল। এ জনগোষ্ঠীর কয়েকজন পদস্থ সরকারি দায়িত্বও পালন করেন। কিন্তু ১৯৬২ সালে জেনারেল নে উইন সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করলে মিয়ানমারের যাত্রাপথ ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হতে শুরু করে। রোহিঙ্গাদের জন্য শুরু হয় দুর্ভোগের নতুন অধ্যায়। সামরিক জান্তা তাদের বিদেশি হিসেবে চিহ্নিত করে। তাদের নাগরিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। ভোটাধিকার কেড়ে নেওয়া হয়। ধর্মীয়ভাবেও অত্যাচার করা হতে থাকে। নামাজ আদায়ে বাধা দেওয়া হয়। হত্যা-ধর্ষণ হয়ে পড়ে নিয়মিত ঘটনা। সম্পত্তি জোর করে কেড়ে নেওয়া হয়। বাধ্যতামূলক শ্রমে নিয়োজিত করা হতে থাকে। তাদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসেবার সুযোগ নেই। বিয়ে করার অনুমতি নেই। সন্তান হলে নিবন্ধন নেই। জাতিগত পরিচয় প্রকাশ করতে দেওয়া হয় না। সংখ্যা যাতে না বাড়ে, সে জন্য আরোপিত হয় একের পর এক বিধিনিষেধ।

মিয়ানমারের মূল ভূখণ্ডের অনেকের কাছেই রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ‘কালা’ নামে পরিচিত। বাঙালিদেরও তারা ‘কালা’ বলে। ভারতীয়দেরও একই পরিচিতি। এ পরিচয়ে প্রকাশ পায় সীমাহীন ঘৃণা।

মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলমান রোহিঙ্গাদের ওপর দমন পীড়ন, নির্যাতন ও বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে গত অর্ধযুগেরও বেশী সময় ধরে আমরা বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে নানা বিষয় জেনে আসছি। কিন্তু রোহিঙ্গাদের ইতিহাস সম্পর্কে আমরা কতটুকু জানি?
রোহিঙ্গাদেরও রয়েছে অভূতপূর্ব ইতিহাস ঐতিহ্য।
রোহিঙ্গাদের আবাসভূমি আরাকান ছিল স্বাধীন রাজ্য। ১৭৮৪ সালে বার্মার রাজা বোডপায়া এটি দখল করে বার্মার অধীন করদ রাজ্যে পরিণত করেন।
আরাকান রাজ্যের রাজা বৌদ্ধ হলেও তিনি মুসলমান উপাধি গ্রহণ করতেন। তার মুদ্রাতে ফার্সি ভাষায় লেখা থাকতো কালেমা।
আরাকান রাজ দরবারে কাজ করতেন অনেক বাঙালি মুসলমান। বাংলার সাথে আরাকানের ছিল গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সম্পর্ক।
ধারণা করা হয় রোহিঙ্গা নামটি এসেছে আরাকানের রাজধানীর নাম ম্রোহং থেকে: ম্রোহং>রোয়াং>রোয়াইঙ্গিয়া>রোহিঙ্গা। তবে মধ্য যুগের বাংলা সাহিত্যে আরাকানকে ডাকা হতো রোসাং নামে।
১৪০৬ সালে আরাকানের ম্রাউক-উ রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা নরমিখলা ক্ষমতাচ্যুত হয়ে বাংলার তৎকালীন রাজধানী গৌড়ে পলায়ন করেন। গৌড়ের শাসক জালালুদ্দিন শাহ্ নরমিখলার সাহায্যে ৩০ হাজার সৈন্য পাঠিয়ে বর্মী রাজাকে উৎখাতে সহায়তা করেন। নরমিখলা মোহাম্মদ সোলায়মান শাহ্ নাম নিয়ে আরাকানের সিংহাসনে বসেন। ম্রাউক-উ রাজবংশ ১০০ বছর আরাকান শাসন করেছে।
মধ্যযুগে বাংলা সাহিত্যচর্চ্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল রোসাং রাজ দরবার। মহাকবি আলাওল রোসাং দরবারের রাজ কবি ছিলেন। তিনি লিখেছিলেন মহাকাব্য পদ্মাবতী। এছাড়া সতী ময়না ও লোর-চন্দ্রানী, সয়ফুল মুল্ক, জঙ্গনামা প্রভৃতি কাব্যগ্রন্থ রচিত হয়েছিল রোসাং রাজদরবারের আনুকূল্যে।
ভাই আওরঙ্গজেবের সাথে ক্ষমতার দ্বন্দ্বে পরাজিত হয়ে মোগল যুবরাজ শাহ্ সুজা ১৬৬০ সালে সড়ক পথে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার হয়ে আরাকানে পলায়ন করেন। তৎকালীন রোসাং রাজা চন্দ্র সুধর্মা বিশ্বাসঘাতকতা করে শাহ্ সুজা এবং তার পরিবারকে নির্মমভাবে হত্যা করেন। এর পর আরাকানে যে দীর্ঘমেয়াদী অরাজকতা সৃষ্টি হয় তার অবসান ঘটে বার্মার হাতে আরাকানের স্বাধীনতা হরণের মধ্য দিয়ে।

বৌদ্ধ-শাসকরা মোগলদের অনুকরণে নিজেদের পদবীতে যোগ করে বহু ফারসি শব্দ। মোগল শাসনের শেষ সময় পর্যন্ত এ অঞ্চলের মানুষের অবাধ যাতায়াত ছিল আরাকানে।
সপ্তদশ শতাব্দীতে আরাকানে বসবাসরত পর্তুগীজ জলদস্যুরা প্রায়ই বাংলায় অভিযান চালিয়ে লুটপাটে লিপ্ত ছিল। এদের কাহিনী বাংলা সাহিত্য বহুভাবে উল্লেখ রয়েছে এবং হার্মাদ আর বর্গীদের নিয়ে বাংলা পুঁথি ও ছড়া এখনও গ্রামের মায়েদের মুখে হয়তো শোনা যায়। ওই সময়ে পর্তুগীজরা বহু বাঙালিকে ধরে নিয়ে আরাকানে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করেছে যার মধ্যে পরবর্তীতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিখ্যাত হয়ে উঠা নামও রয়েছে। এমনই একজন বিখ্যাত কবি ও সাহিত্যিক আলাওয়াল (১৬০৭-১৬৭৩)।
আলাওয়ালের পিতা ছিলেন তৎকালীন ফতোয়াবাদ (ফরিদপুরের সন্নিকটে) রাজার দরবারের মন্ত্রী। আলাওয়াল মালেক জয়েশ মোহাম্মদের রচিত চিতোরের রানী ‘পদ্মাবতী’ নিয়ে রচিত পদ্মাভাত কাহিনী পুঁথি আকারে প্রকাশ করেন। বাল্যবয়সে আলাওয়াল তার পিতার সাথে নৌপথে সফরকালে ফরিদপুরের সন্নিকট হতে পর্তুগীজ দস্যুরা অপহরণ করে এবং আরাকানে বিক্রি করে। আলাওয়াল পরবর্তীতে রাজদরবারের বডিগার্ড হিসেবে কিছুদিন কাজ করার সুবাদে দরবারে পরিচিত হয়ে উঠেন। ওই সময়ে সুলেমান নামক মারুক ইউ-এর শাসক সান্দা তুধামার দরবারের মন্ত্রী আলাওয়ালকে নিজের তত্বাবধানে রাখেন। আলাওয়াল কবি হিসেবে সমগ্র আরাকানে বিখ্যাত হয়ে উঠেন। ওই সময়, ১৬৫৯ সালে তিনি দরবারের পূর্বতন কবি দৌলত কাজী (১৬০০-১৬৩৮) রচিত অসম্পূর্ণ কাব্যগ্রন্থ ‘সতী ময়না’র রচনা শেষ করেন। দৌলত কাজীও ছিলেন চট্টগ্রাম রাউজানের বাসিন্দা। তার জন্মস্থানে কবি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না হতে পেরে তিনি আরাকান রাজত্বে চলে যান, পরে রাজদরবারে ঠাঁই পান। তিনি তাঁর কাব্য ও কবিতা বাংলায় রচনা করেছিলেন, যদিও তিনি আরাকান দরবারে ছিলেন। তারই অভধী (তৎকালীন হিন্দুস্থানের ওউধ রাজ্যের ভাষা) ভাষায় প্রথম রচিত ‘লোরচন্দ্রানী ও সতীময়না’ কাব্যগ্রন্থদ্বয় যা তিনি মৃত্যুর পর্বে শেষ করতে পারেননি, পরবর্তীতে শেষ করেছিলেন কবি আলাওয়াল। (সংক্ষেপিত)
– আবুল কালাম আজাদ
লেখক, সাংবাদিক ও সংগঠক

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।