ডেস্ক রিপোর্ট: ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছেড়েছেন শেখ হাসিনা। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে দায়িত্ব নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এমন পরিস্থিতিতে অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টিকে সামনে রেখে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পগুলো কাটছাঁট হতে পারে। এর প্রভাব পড়তে পারে মেগাপ্রকল্পেও। সংশ্লিষ্টদের ধারণা, আওয়ামী লীগ সরকারের নেওয়া চলতি অর্থবছর এবং পরের মিলে সম্ভাব্য ৩৩২৫টি উন্নয়ন প্রকল্পের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়তে পারে। এগুলোর মধ্যে চলতি (২০২৪-২৫) অর্থবছরে ১২২১টি প্রকল্পের জন্য ২ লাখ ৫৫ হাজার ৪১ কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হবে জানিয়ে সম্প্রতি অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ব্যবসা-বাণিজ্য ও জীবন-জীবিকার প্রকল্প চালু রাখা হবে। বড় বা মেগা প্রকল্পের অর্থছাড় বড় হয়। তাই এ বিষয়ে পরে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বাংলাদেশের অর্থ অপচয় বন্ধ করতে হবে। স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা ছাড়া কিছু চলবে না। বিশ্লেষকরা বলছেন, মেগাপ্রকল্পের কাজ অন্তর্বর্তী সরকারের নীতির ওপর নির্ভর করছে। আওয়ামী লীগ সরকার এসব প্রকল্প তার দৃশ্যমান উন্নয়নের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে চেয়েছিল। এজন্য তারা প্রকল্পগুলোতে বেশি অগ্রাধিকার দিয়ে আসছিল। অর্থনীতিবিদরা বারবার এসব প্রকল্পে গুরুত্ব কম দেওয়ার পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। তাঁদের মধ্যে অন্তর্বর্তী সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টাও রয়েছেন। পরিকল্পনা কমিশন সূত্রে জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে (এডিপি) গুরুত্ব পাওয়া মেগাপ্রকল্পের মধ্যে রয়েছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এই প্রকল্পের বরাদ্দ রয়েছে ১০ হাজার ৫০২ কোটি টাকা। এটিতে রাশিয়ার বৈদেশিক ঋণ আছে। ২০২৩ সালের জুন পর্যন্ত এ প্রকল্পের আওতায় খরচ হয়েছে ৬৪ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। এরপর রয়েছে মেট্রো রেল লাইন-৬ প্রকল্প। চলতি অর্থবছরে এই প্রকল্পে বরাদ্দ এক হাজার ৯৭৫ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৭৫৭ কোটি টাকা। মেট্রো রেল লাইন-১ প্রকল্পে বরাদ্দ আছে এক হাজার ৯৪২ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে এক হাজার ৫৮৫ কোটি টাকা। মেট্রো রেল লাইন-৫ নর্দান রুট প্রকল্পে বরাদ্দ ৯৬৮ কোটি টাকা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেল সেতুর জন্য বরাদ্দ দুই হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত খরচ হয়েছে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। এসব প্রকল্পে জাপানসহ বিভিন্ন সংস্থার ঋণ রয়েছে। পদ্মা সেতুতে রেল সংযোগ প্রকল্পে বরাদ্দ তিন হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে ঋণ দিচ্ছে চীন। দোহাজারী-রামু-ঘুমধুম রেললাইন প্রকল্পের জন্য বরাদ্দ এক হাজার ৪৫৩ কোটি টাকা। এ পর্যন্ত ব্যয় সাত হাজার ১৭২ কোটি টাকা। এটি বাস্তবায়নে চীন ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণ রয়েছে। আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্প হচ্ছে মাতারবাড়ী বন্দর উন্নয়ন, পায়রা বন্দরের অবকাঠামো উন্নয়ন, সাপোর্ট টু ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ এবং সাসেক সংযোগ সড়ক প্রকল্প: এলেঙ্গা-হাটিকুমরুল-রংপুর মহাসড়ক চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প। এদিকে মেগাপ্রকল্পের পাশাপাশি অনিশ্চয়তা রয়েছে চলতি অর্থবছরে এডিপিতে অনুমোদন পাওয়া এক হাজার ৩২১টি প্রকল্পে। এসব প্রকল্পের মধ্যে বিনিয়োগ প্রকল্প এক হাজার ১৩৩টি, কারিগরি সহায়তার ৮৭টি এবং সমীক্ষা প্রকল্প ২১টি। এদিকে বিগত সরকারের আমলে প্রয়োজন না থাকলেও প্রভাব খাটিয়ে অনেক প্রকল্পের অনুমোদন নেওয়ারও অভিযোগ রয়েছে। পরিকল্পনা কমিশনের আপত্তি সত্ত্বেও প্রভাব খাটিয়ে এসব প্রকল্প নেওয়া হয়। এরকম একটি হলো ‘শেখ হাসিনা নকশিপল্লি, জামালপুর (প্রথম পর্যায়)’ নামে একটি প্রকল্প। জানা যায়, সাবেক প্রতিমন্ত্রী ও জামালপুর-৩ (মেলান্দহ-মাদারগঞ্জ) আসনের সংসদ সদস্য বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মির্জা আজম প্রভাব খাটিয়ে নিজ এলাকায় এই অনুমোদন করিয়ে নেন বলে। হস্তশিল্প, কারুশিল্প, কুটিরশিল্প, তাঁতিদের প্রশিক্ষণ দেওয়া ও দারিদ্র্য বিমোচনের নামে ৭৭২ কোটি টাকা প্রকল্পটিতে ব্যয় হবে। কমিশন সূত্র জানায়, বর্তমানে জামালপুরের সবগুলো উপজেলায়ই এ শিল্পের কাজে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ৩০০ প্রতিষ্ঠান/উদ্যোক্তা। সবাই নিজের মতো করে কাজ করেন। সবাইকে একত্র করার কথা বলে প্রকল্পটি নেওয়া হয়। অথচ প্রকল্পটি নেওয়ার ফলে তাঁতিদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিসহ সবাইকে একত্র করাও সম্ভব নয়। ফলে ৭৭২ কোটি টাকা পুরোটাই গচ্চা যাবে বলে প্রতিবেদন দিয়েছিল পরিকল্পনা কমিশন। তারপরও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশন থেকে অনুমোদন করিয়ে নেন মির্জা আজম। এদিকে দেশের ৩০০ সংসদ সদস্যের নির্বাচনী এলাকার উন্নয়নে একটি প্রকল্প জমা পড়েছিল পরিকল্পনা কমিশনে। প্রকল্পের আওতায় প্রত্যেক সংসদ সদস্য উন্নয়নের অঙ্গীকার পূরণে ২০ কোটি করে টাকা পাওয়ার কথা। এ ছাড়া প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় ছয়টি করে মাদ্রাসা ভবন নির্মাণের পরিকল্পনা নেওয়া হয়। মন্ত্রীদের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার কথা আরও দুইশ মাদ্রাসা নির্মাণের টাকা। পুরো প্রকল্পটিতে খরচ ধরা হয় ৭ হাজার ৫৯৫ কোটি টাকা। এসব প্রকল্প আশার আলো দেখার সম্ভাবনা কম বলে জানায় কমিশন। এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, আমাদের কাছে একাধিক প্রকল্প আছে যেগুলোতে জনকল্যাণের পরিবর্তে এক গোষ্ঠীর কল্যাণ বেশি হবে। এসব প্রকল্পে নেতিবাচক রিপোর্ট দিয়েও কোনো কাজ হয়নি। প্রভাব খাটিয়ে পরিকল্পনা কমিশন থেকে এসব প্রকল্প অনুমোদন করা হয়। আমরা সেগুলোর তালিকা তৈরি করছি। যে সব প্রকল্পে জনসম্পৃক্ততা কম সে সব প্রকল্প বাতিল হয়ে যাবে। জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের খরচ কমানোর বড় জায়গা বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি)। এডিপির মধ্যে বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। এ ছাড়া প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলোও পুনর্বিবেচনা করা যেতে পারে। এ প্রসঙ্গে বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশ আবাসিক মিশনের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, সরকার কী করবে আমরা জানি না। তবে রাজনৈতিক বা প্রশ্নবিদ্ধ প্রকল্পগুলো পুনরায় বিবেচনা করা উচিত। কারণ সরকার আর্থিক সংকটে আছে, রাজস্ব আদায়েও ঘাটতি। জুলাই মাসে অর্থনীতি বিকল ছিল, এক মাসে রেভিনিউ কালেকশন কম ছিল। দোকানপাট বন্ধ ছিল। সরকারকে ব্যয় কমাতে হবে। ব্যয় কমানোর বড় জায়গা এডিপি। এডিপির মধ্যে ব্যয় কমানোর বড় জায়গা মেগা প্রকল্প। পল্লি উন্নয়ন ও আর্থ-সামাজিক খাতে কিছু ছোট প্রকল্প আছে যেগুলো প্রশ্নবিদ্ধ। এসব প্রকল্প বাদ দেওয়াই ভালো হবে।
সুত্র:এফএনএস ডটকম
Related
সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন।